ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চট্টগ্রামের সিআরবি

21

তপন কান্তি ধর

নান্দনিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম শহর চট্টগ্রাম। বলা হতো প্রাচ্যের রাণী। চট্টগ্রামে পাহাড়, সমতল, নদী, সমুদ্র সবকিছুর সম্মিলনে একাকার। শহরের প্রধান জনসমাগমস্থল শতবর্ষী বৃক্ষ, পাহাড়-উপত্যকা বেষ্টিত ও প্রাণি বৈচিত্র্যের কেন্দ্র সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণ এই এলাকার ঐতিহ্য ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধ্বংস করবে। কংক্রিটের আগ্রাসন গ্রাস করবে সবুজ। সাংস্কৃতিক এই সম্মিলন কেন্দ্রটি হারাবে বর্তমান রূপ। তাই চট্টগ্রামের ফুসফুসখ্যাত কেন্দ্রীয় রেলওয়ে ভবন (সিআরবি) এলাকা নয় বরং এমন কোনো স্থানে হাসপাতাল নির্মাণ করা হোক যেখানে প্রকৃতি ও পরিবেশের কোন রূপ ক্ষতি সাধন হবে না।
ঐতিহ্যমÐিত বৃক্ষরাজিবেষ্টিত সিআরবি এলাকায় শতশত মানুষ সেখানে ঘুরতে যায়, সকালে শরীরচর্চার জন্য হাঁটতে যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নির্ভর এই স্থানগুলোতে একটুখানি নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা ছিল ডিসি হিল, ফয়েজ লেক আর সিআরবি। ডিসি হিল ডিসিদের আওতায়। ফয়’স লেক দিয়ে দেওয়া হয়েছে বেনিয়াদের হাতে; যারা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এলাকাগুলো সম্পূর্ণ নিজের সম্পত্তিতে পরিণত করেছে। এবার সিআরবি ধ্বংসের নীল নকশা তৈরি ও যৌক্তিকতা দেখাতে ব্যস্ত তারা।
জানা যায়, গতবছর রেল মন্ত্রণালয় সিআরবি’র রেল বক্ষব্যাধি হাসপাতালসহ- এর পাশের ৬ একর জায়গা, ৫০ বছরের জন্য কর্পোরেট গ্রুপ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজকে লিজ দেওয়ার চুক্তি করে। গ্রুপটি এ স্থানে বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতাল, কলেজ ও নার্সিং ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করবে। এ সম্পর্কিত গৃহিত প্রকল্পের সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে এ এলাকায় হাসপাতালটি পরিচালনার ফলে বেশকিছু ব্যবসার ক্ষেত্র তৈরি হবে। যেমন- ফার্মেসি, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, জেনারেল স্টোর, ফুড স্টোর ইত্যাদি। বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পরিবেশের উপর ঝুঁকিপূর্ণ কোন প্রভাব পড়বে না, ‘মৃদু প্রভাব’ পড়বে। পরিবেশ অধিদপ্তর কর্মকর্তার ভাষ্য অনুসারে, সিআরবি একটি রিজার্ভ এলাকা। এখানে অনেক শতবর্ষী বৃক্ষ আছে। পরিবেশের ক্ষতি করে এখানে কোন ভবন নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হবে না। বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ক্রমাগত বাণিজ্যিক আগ্রাসনের কারণে পাহাড়, জলাভূমি ও শতবর্ষী বৃক্ষরাজি হারিয়ে এখন এক চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। নির্বিচারে কাটার কারণে চট্টগ্রাম শহরে পাহাড় ধস প্রতি বর্ষায় ঘটছে। হচ্ছে প্রাণহানী। প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংসে নানা প্রক্রিয়া এই শহরে চলমান। এমনকি সরকারি সংস্থার অধীনে পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণের মত ঘটনাও ঘটেছে। সিআরবি এলাকাটি বর্তমানে অখন্ড পাহাড় ঘেরা শতবর্ষী বৃক্ষের এক প্রাঙ্গণ। বহুতল হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ ও নার্সিং ইনস্টিটিউট নির্মাণ হলে এসব ঘিরে জন ও যানবাহন সমাগম ঘটবে বহুগুণ বেশি। এসব স্থাপনা ঘিরে আরও নতুন নতুন বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট। একবার গাছ কাটা ও প্রকৃতি ধ্বংসের কার্যক্রম শুরু হলে তা আশেপাশেও সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, সিআরবির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ শিরীষতলা ও শতবর্ষী বৃক্ষ না কেটে হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
সিআরবির শিরিষ তলায় বাঙালি সংস্কৃতির চিয়ায়ত অনুষঙ্গ পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজিত হয়। পাশাপাশি শিরিষ তলায় অন্যান্য সাংস্কৃতিক আয়োজনও হয়ে থাকে। সিআরবি এলাকায় বাণিজ্যিক হাসপাতালসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ হলে সেখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনও হুমকির মুখে পড়বে। বর্তমানে নগরীর একমাত্র উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ হিসেবে নিত্যদিন প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমণের জন্য মানুষ সিআরবিতে আসে। এছাড়া সাপ্তাহিক ছুটির দিন এমনকি বিভিন্ন ছুটির সময়ে মানুষ সিআরবির পাহাড় ও বৃক্ষছায়ায় আসে প্রশান্তির খোঁজে। সিআরবি চট্টগ্রামে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক অনুষঙ্গের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এখানে হাসপাতালের মত স্থাপনা নির্মাণ কোনোভাবে যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক