ইতিহাসে কী নামে বেঁচে থাকবেন এরশাদ

41

মৃত্যুর পর জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে কোন চোখে দেখা উচিত? তিনি বিদায় নেওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নিয়ে চলছে ভিন্নমত। ব্যক্তিগত আড্ডায় কারও চোখে তিনি খুনি, কারও চোখে স্বৈরাচার, আবার কেউ বলছেন স্বৈরাচারের সংজ্ঞা এখন আর তার জন্য সাজে না। তাকে মূল্যায়ন করতে হবে নিরপেক্ষভাবে।
এরশাদ বিদায় নিলেন গত ১৪ জুলাই ২০১৯, রবিবার সকাল পৌনে ৮টায়। দীর্ঘ নয় বছর তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, সেনাপ্রধান ছিলেন, সর্বশেষ ছিলেন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা। সবার ভাগ্যে এত পদ জুটে না। সেনাশাসক হিসেবে তার শাসনের নয় বছরে দেশ ছিল ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ, আন্দোলনমুখর। ছাত্রজনতা রাজপথ প্রকম্পিত করেছে তার শাসনের বিরুদ্ধে। তাদের বুকে গুলি ঝরিয়েছেন তিনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল দিনের পর দিন, সেশনজটের ঝামেলা ছিল স্মরণকালের। রাজনীতিকরা আরও অসৎ হয়েছেন। আমলারা চোর হয়েছেন। সমাজে বেড়েছে সুবিধাবাদী শ্রেণি। বিরোধী দলগুলো সম্মিলিতভাবে তাকে স্বৈরাচার হিসেবে আখ্যায়িত করতো। গণতন্ত্রের করসেবকরা তাকে গণতন্ত্র হত্যাকারী হিসেবেও আখ্যায়িত করেছেন।
কিন্তু জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে এবং দুর্নীতির দায়ে জেল খেটেও জেনারেল এরশাদ প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতা এবং ভোটের রাজনীতিতে নিজেকে প্রাসঙ্গিক রাখতে পেরেছিলেন। স্বৈরশাসক হিসেবে পতনের পরও ঘুরে দাঁড়িয়েছিলেন, যেটি ইতিহাসে বিরল। রাজনীতির প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি, উভয়েই নানা সময় তাকে নিয়ে টানাটানি করেছে। সেই টানাটানি তার মৃত্যুর পরও চলবে কিনা, সেটা নিয়ে আমি অবশ্য সন্দিহান। তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি রাজনীতিতে কতটা নিজের প্রভাব বজায় রাখতে পারবে, সেটাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ দলটিতে কখনই গণতন্ত্রের চর্চা হয়নি। মিস্টার আনপ্রেডিক্টিভ এরশাদ দল নিয়ে কখন কী করতেন তার কোনও দিশা ছিল না। এটি আদর্শভিত্তিক কোনও পার্টিও না। পুরোটাই এরশাদের ব্যক্তি ইমেজ নির্ভর পার্টি, অঞ্চল কেন্দ্রিক পার্টি। এখনও জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব পারিবারিক দ্ব›দ্বকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে রয়েছে।
এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা নিয়েছিলেন। অবশ্য প্রেসিডেন্ট সাত্তার বলেছেন বা তাকে দিয়ে বলানো হয়েছিল, সাত্তারের সরকার দুর্নীতিগ্রস্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যর্থ। মন্ত্রী আবুল কাশেমের সরকারি বাসভবন থেকে এক সন্ত্রাসীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। মন্ত্রীর বাসা থেকে যদি সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়, সেখানে যদি অপরাধী আত্মগোপন করে থাকে, তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে খারাপ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
সারা বিশ্বে সামরিক বাহিনী সরকারের নাজুক অবস্থা দেখলে খুশি হয়। তখন ক্ষমতা গ্রহণের প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়। তাই বলে এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের কোনও অভিলাষ ছিল না, তা নয়। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়, বিএনপির প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন বিচারপতি আবদুস সাত্তার, আর আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন ড. কামাল হোসেন। সেনাপ্রধানের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কোনও ভূমিকা থাকার কথা নয়, কিন্তু জেনারেল এরশাদ সাত্তারের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। প্রকাশ্যে কথাবার্তা বলেছেন। এরশাদ চেয়েছিলেন সাত্তার নির্বাচিত হোক, কারণ এই বুড়ো লোকটি নির্বাচিত হলে বিএনপির নেতাকর্মীরা কোনও কিছুর সীমানা মানবে না। তখন ক্ষমতা দখলের একটা পটভূমিকা তৈরি হবে। ড. কামাল নির্বাচিত হলে হয়তো তা হবে না।
এরশাদের চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। সাত্তার নির্বাচিত হওয়ার পর তার চাকরির মেয়াদ প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে এরশাদ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। বিচারপতি সাত্তার কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ছিলেন। শেরেবাংলার জুনিয়র হিসেবে আইন ব্যবসা করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেরেবাংলার অনুগ্রহে বিচারপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিচারপতির পদ থেকে অবসরের পর সাত্তার সাহেবকে বহু ক্ষমতাকাক্সক্ষী লোক ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। বিএনপির গঠনেও তার ভূমিকা ছিল। এরশাদও তাকে দিয়ে ক্ষমতায় গিয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের ভূমিকা সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ছিল না। সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিলে তারা বরং খুশি, নেতা-নেত্রীদের তখনকার কথাবার্তায় তা বুঝা যেত। শেষ পর্যন্ত তিনি ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সামরিক শাসন জারি করে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হলেন, আর অন্য এক বিচারপতি আহসান উদ্দিনকে রাষ্ট্রপতি করেছিলেন।
সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের একটা পদ্ধতি আছে। সে পদ্ধতির সবকিছু অনুসরণ করে এরশাদ শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। এগুলো প্রদর্শিত পথ। প্রথমে সামরিক আইন প্রশাসক হওয়া, ক’দিন পরে প্রেসিডেন্ট হওয়া, তারপর হ্যাঁ-না ভোট। এরশাদ তার আগের সেনাশাসক জিয়াউর রহমানকে অনুসরণ করে এসেছেন। জিয়া অনুসরণ করেছেন জেনারেল আইয়ুব খানকে।
প্রত্যেক সামরিক সরকার সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব শাসনতান্ত্রিকভাবে দিতে চেয়েছিলেন। মিজান চৌধুরীর প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় এই নিয়ে একটি বিল পাস হয়েছিল এবং উপপ্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর আহমেদ এরশাদের কাছে নিয়েও গিয়েছিলেন। সম্ভবত বিরোধী আওয়ামী লীগের অসন্তোষে শেষ পর্যন্ত এরশাদ তাতে স্বাক্ষর করেননি।
যা হোক, এরশাদ দীর্ঘ নয় বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার সময়ে দেশে অবকাঠামোর উন্নয়ন হয়েছিল খুবই সন্তোষজনক। এখনও অবকাঠামো উন্নয়নের কথা উঠলে এরশাদ আমলের কথা স্মরণ করে মানুষ। বাংলাদেশ ব্যাংক ভবন, সেনা কল্যাণ ভবন, শিল্প ভবন, জনতা ব্যাংক ভবন তার সময় হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ এসেছিল তার আমলে। মেঘনা ব্রিজ, দাউদকান্দি ব্রিজসহ অন্যান্য বড় ব্রিজ তার সময়ে হয়েছিল। যমুনা ব্রিজ নির্মাণের জন্যও তার সরকার সর্বস্তরের জনগণ থেকে ট্যাক্স কাটা আরম্ভ করেছিল।
ঢাকায় নগর ভবন হয়েছিল তার সময়ে, ঢাকাকে রক্ষায় রিং রোড, যাতায়াত সহজ করতে নগরীতে নানান লিংক রোড তার সময়ে তৈরি। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম সেক্টর আজ পোশাক শিল্প। এরশাদের উৎসাহে এই শিল্পের প্রসার ঘটেছে। জাতি গঠনে প্রত্যেক সরকারের কিছু না কিছু অবদান থাকে। এরশাদ সেক্ষেত্রে অনেক মৌলিক আদেশ করে গিয়েছেন। তবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার মতো বিতর্কিত, অহেতুক এবং অকার্যকর একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি সমালোচিত হয়েছেন। সংখ্যালঘুদের অসম্মান করেছেন। আর তার করা রাষ্ট্রধর্ম পরবর্তী সরকারগুলো পরিবর্তনের কোনও উদ্যোগই নেয়নি সাহস করে।
এরশাদের সময় দুর্নীতির কথা প্রচার হতো হাজার মুখে। এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন আজ প্রায় তিন দশক। এই তিন দশকে রাষ্ট্রক্ষমতা খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার কাছে পালাক্রমে হাতবদল হয়েছে। তাদের সময়ে কি দুর্নীতি হয়নি, হচ্ছে না? দুর্নীতির মাত্রা কমেছে, সেটা কি কেউ গ্যারন্টি দিয়ে আমরা বলতে পারছি?
এরশাদের সময় নির্বাচন বন্ধ ছিল না। সব ধরনের নির্বাচন হয়েছে। তবে তার সময় এই নির্বাচনে কারচুপির কথাটিও জোরালোভাবে প্রচারিত হয়েছে। দেশের সবকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তার আমলে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু কারচুপির অভিযোগ হয়নি। এতো বছর পর একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন হলেও, সেটিও বিতর্কমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি। আমরা এখনও কি দেশে কারচুপিমুক্ত নির্বাচন হচ্ছে, এই কথা জোর দিয়ে বলতে পারছি? এই তিন দশকে এরশাদ আমলের চেয়ে উত্তম কোনও রীতিনীতি আমরা প্রতিষ্ঠিত করেছি?
এরশাদ আমলে সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করা হয়েছে কালাকানুনের মাধ্যমে। কিন্তু তারপরও তার সময়ে বাক স্বাধীনতা রহিত করা হয়েছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কিছুই ছিল না বলা যাবে না। সংবাদপত্রে ওই খবর যাবে না, সেই খবর যাবে না বলে ফরমান আসতো। এখন হয়তো ফরমানের পদ্ধতি বদল হয়েছে, কিন্তু ফরমান আসে না এমন কথা বুকে হাত দিয়ে কেউ বলতে পারবে না। আর সেরকম ফরমান এখন লাগছেও না। সরকারকে দোষ দেওয়াও যাবে না একতরফা। সেল্ফ সেন্সরশিপ চলছে ফরমান থেকে বহুগুণে বেশি। মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং মিডিয়া বেড়েছে দাবি করা যায়, কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া আর অনলাইন এসে কোনটা খবর আর কোনটা বেখবর পাঁচবার ভাবতে হয় তথ্য গ্রহীতাদের।
নির্মোহ বিচারে রাষ্ট্র পরিচালনায় গত চার দশকের শাসকদের সবকিছুই তো অভিন্ন। সুতরাং আমরা যেহেতু কাউকে নির্মল চরিত্রের পেলাম না, শুধু শুধু এরশাদকে এককভাবে অভিযুক্ত করে লাভ কী! এসব অভিযোগ থেকে তাকেও শেষ যাত্রায় জাতির অব্যাহতি দেওয়া উচিত।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট