ইচ্ছা থাকলে স্বপ্নও সত্য হয়

29

আবদুল মান্নান

যে মানুষ জনগণের জন্য রাজনীতি করেন তিনি শুধু মানুষকে স্বপ্ন দেখান না প্রথম সুযোগেই সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন এবং লক্ষ্য সঠিক থাকলে সেই স্বপ্ন এক সময় বাস্তবায়িত হয়। বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসে রাজনীতিবিদ বা রাজনৈতিক নেতার অভাব ছিল না, এখনো নেই । তারাও মানুষকে বিভিন্ন সময় স্বপ্ন দেখিয়েছেন বা দেখান কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি বা হয়না নানা কারণে। কখনো সুযোগ পেয়েও সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হয়নি অথবা কোন কোন ক্ষেত্রে এমন সব কারণ সামনে উপস্থিত হয়েছে যা মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না, স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেছে। ২৩ জানুয়ারি বাঙালির ইতিহাসের একজন প্রবাদ প্রতিম মানুষ নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্ম জয়ন্তি গেল। এই একজন অমিত তেজ বাঙালি এই উপমহাদেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছিলেন কিন্তু তা তিনি পারেননি। হয়তো বা তাঁর পথ সঠিক ছিল না বা পরিস্থিতি তার পথে বাধা সৃষ্টি করেছিল। সেই বিচার অবশ্য ইতিহাস করবে। বলা যেতে পারে তাঁর শিষ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালিকে একটি স্বাধীন আবাসভ‚মির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তা অর্জনের জন্য তিনি আজীবন পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছেন, তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল দেশ স্বাধীন করতে; শেষতক সেই স্বপ্নদ্রষ্টার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছিল। বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশ, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। নেতা হতে গেলে ভিশন বা দূরদৃষ্টি থাকতে হয় যা আজকের বিশ্বে নেতাদের বড়ই অভাব। যারা একজন ব্যক্তিকে নেতা মানেন তাঁর স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হয় তিনি তাঁর অনুসারীদের আগামী দিনে কোথায় নিয়ে যেতে চান। বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট হত্যা করার পর বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই নেতৃত্ব শূন্য হয়ে পরেছিল। অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়ে তাঁর কন্যা, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সেই শূন্য স্থান অনেকটা পূরণ করেছেন, তাঁর অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছেন ।
আজকের প্রজন্মকে বুঝানো যাবেনা কেমন ছিল স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ। রিলিফের চাল বা গম না আসলে বেশির ভাগ বাড়িতে চুলায় হাঁড়ি চড়তো না। পাকিস্তানি সেনা বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে এই দেশের এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। দেশের ভিতর প্রায় সমান সংখ্যক মানুষ ঘর ছাড়া। পাকিস্তানি সেনা বাহিনী গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। যারা নিজ ভিটে মাটিতে ফিরছে তারা দেখেন ভিটে আর মাটিটা আছে কিন্তু তাদের আশ্রয়টা নেই, তা আগুনে পুড়ে মাটির সাথে মিছে গেছে। কোথাও যে তারা মাথা গুজবেন তারও কোন উপায় নেই। এই সময় বঙ্গবন্ধুর নূতন সরকার এগিয়ে এলেন। বিদেশ হতে তাঁর অনুরোধে বন্ধু রাষ্ট্রগুলো হতে আসলো রিলিফের ঢেউটিন। সাহায্য হিসেবে আসা সেই ঢেউ টিন দেশের বিভিন্ন এলাকায় তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিনা মূল্যে বিতরণ করার ব্যবস্থা করলেন ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এই দপ্তরের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন চার জাতীয় নেতার অন্যতম রাজশাহীর এ এইচ এম কামরুজ্জামান। সেই টিন দিয়ে ছিন্নমূল মানুষ সাময়িক ভাবে তাদের মাথা গোঁজার একটা ব্যবস্থা করলো। বঙ্গবন্ধু আজীবন সাধারণ মানুষের জন্য সংগ্রাম করে গিয়েছেন, পাকিস্তানের শাসনকালে তিনি বিভিন্ন সময় বক্তৃতা বিবৃতিতে বলে গিয়েছেন কিভাবে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বাঙালিকে তাদের ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করেছে। দেশ স্বাধীন হলে তিনি প্রায় বলতেন দেশের মানুষের ন্যূনতম চাহিদা পূরণ করতে না পারলে দেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে পরবে। বলতেন একটি স্বাধীন দেশের সরকারের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে দেশের মানুষের জন্য তাদের মৌলিক চাহিদা অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। বলতেন স্বাধীন দেশের মানুষ বিদেশি সাহায্য নির্ভর থাকতে পারে না। তিনি তাঁর সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে তাঁর এই সব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছেন। যে সব দেশ বাংলাদেশ স্বাধীন হোক চায়নি তারা নিত্য ষড়যন্ত্র করেছে দেশটিকে ব্যর্থ করে দিতে। সেই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে সৃষ্ট হয় ১৯৭৪ সালের খাদ্যাভাব। এই সংকট আরো বেশি প্রকট হয় দেশে পর পর কয়েকটি বন্যা আর খরার কারণে। তা মোকাবেলা করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে খোলা হয় লঙ্গরখানা। পঁচাত্তর সালের শুরু হতে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হতে শুরু হয়। বাংলাদেশ যখন সকল বিপর্যয় মোকাবেলা করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শিখেছে ঠিক তখনই তাঁকে হত্য করা হয়। তারপর দীর্ঘ একুশ বছর হারিয়ে গিয়েছিল ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশকে আবার তার কক্ষপথে নিয়ে আসার ব্রত নিয়ে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেছিলেন। বাংলাদেশের গতি প্রকৃতি যারা গত পঞ্চাশ বছর ধরে অনুসরণ করেছে তারা বুঝতে পারবেন কোথায় ছিল বাংলাদেশ আর সেই হারিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ এখন কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।
আজ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ তার একটা বড় নমুনা পাওয়া গেল গত শনিবার যখন দেশের প্রায় সত্তর হাজার গৃহহীন পরিবারকে বিনা মূল্যে জমি ও পাকা বাড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা, দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বে এক অনন্য নজির স্থাপন করলেন। এটি ছিল বঙ্গবন্ধু কন্যার মুজিব বর্ষের একটি অঙ্গীকারের অংশ। তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষে বাংলাদেশের কোন মানুষ যেন গৃহহীন না থাকে তার চেষ্টা তিনি করবেন যেমনটি পিতা করেছিলেন পঞ্চাশ বছর আগে। ইতোপূর্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি আশ্রয়ণ প্রকল্প নেয়া হয়েছিল যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল গৃহহীনদের গৃহ দেয়া। এই প্রকল্পের অধীনে প্রথম পর্যায়ে সত্তর হাজার বাড়ি গৃহহীনদের মাঝে গণভবন হতে ভার্চুয়াল পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি হস্তান্তর করেছেন। বাংলাদেশ সহ যখন সারা বিশ্ব করোনা মহামারীর কারণে বিপর্যস্থ এমন একটি নজিরবিহীন কর্মযজ্ঞ অনেকের কাছে অভাবনিয় মনে হতে পারে। এমনটি অতীতে ঘটতে হয়তো দেখা গেছে কোন কোন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, তাও সীমিত আকারে। আর নানা প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশে তো নিয়মিত মানুষ গৃহহীন হচ্ছে। এইসব কারণের মধ্যে নদী ভাঙ্গন অন্যতম।
আশ্রয়ণ প্রকল্পটি প্রথম গ্রহণ করা হয় সরকার প্রধান হিসেবে শেখ হাসিনার প্রথম মেয়াদ কালে ১৯৯৭ সালে যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ভ‚মিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল অসহায় জনগোষ্ঠির পুনর্বাসন, ঋণপ্রদান ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মপযোগী করে তোলা। তাঁর সেই মেয়াদে প্রায় তিন লাখ কুড়ি হাজার বায়ান্নটি ভ‚মিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। এরপর সরকার পরিবর্তন হলে এই কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মাস দুই এক আগে বঙ্গবন্ধু কন্যা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ছিন্নমূল হওয়া পরিবারগুলোর জন্য কক্সবাজারের খুরুশকুলে বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে কুড়িটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেন যা ছয়শত উদ্বাস্তু পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাংলাদেশে মিয়ানমার হতে উচ্ছেদ হওয়া প্রায় দশ লক্ষ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার ও টেকনাফে আশ্রয় দিয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন যদিও সেই আশ্রয়স্থল কালক্রমে হয়ে উঠেছে বসবাসের অনুপোযোগী এক বিশালাকার বস্তি। সেখান হতে প্রায় এক লক্ষ উদ্বাস্তুকে নোয়াখালির ভাসানচরে সরকারি খরচে নির্মিত দৃষ্টি নন্দন আবাসস্থলে স্থানান্তর করে বাংলাদেশ সরকার আর একটি নজির স্থাপন করা শুরু করেছে। তবে দূর্ভাগ্য হচ্ছে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানন্তর বিষয়ে পাশ্চত্যের মিডিয়া বা কোন এনজিওর সমর্থন পাওয়া যায়নি। আল জাজিরার মতো পশ্চিমা দুনিয়ার বশংবত টিভি পর্যন্ত কোন বাছ-বিচার না করে প্রচার করেছে বাংলাদেশ সরকার কোন রকমের বাছ-বিচার না করে এই রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে জোরপূর্বক স্থানান্তর করেছে যা মোটেও সত্য নয়। সেখানকার সার্বিক সুবিধা সম্পর্কে জানতে পেরে বর্তমানে আরো কয়েক হাজার রোহিঙ্গা ভাসানচরে যেতে প্রস্তুতি নিয়েছে।
পশ্চিমা দুনিয়ার মিডিয়া বাংলাদেশে ভাল কিছু হলে তা সংবাদ করার প্রয়োজনিয়তাবোধ করে না। কিন্তু দেশে কোন নেতিবাচক সংবাদ না থাকলেও প্রয়োজনে একটি উদ্ভাবন বা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে। করোনার কারণে বিশ্বে এই মুহূর্তে ভাল সংবাদের আকাল। এরই মধ্যে শনিবারের গৃহহীনদের মাঝে এই সত্তর হাজার জমিসহ পাকা বাড়ি হতে পারতো একটি বড় খবর, কিন্তু তা হয়নি। তাই বলে সরকার তো আর বসে থাকতে পারে না। এই প্রকল্পের অধীনে মুজিব বর্ষে মোট নয় লাখ গৃহহীনকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া চলছে। সামনের মাসে আরো এক লাখ পরিবার বাড়ি পাবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এই করোনা কালে শেখ হাসিনা করোনা নিয়ন্ত্রণে যে ব্যবস্থা নিয়েছেন তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রশংসা করেছে।
বিশ্বের যে বাইশটি দেশ এই সময় দেশের গড় প্রবৃদ্ধির হার ইতিবাচক রাখতে পেরেছে বাংলাদেশ তার অন্যতম। এই সময় দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নিত হয়ে নূতন নজির সৃষ্টি করেছে। কোন মানুষকে সরকার না খেয়ে মরতে দেয়নি। তারপরও দেশের একটি মহল মনে করে শেখ হাসিনার আমলে দেশ শেষ হয়ে গেল। ষড়যন্ত্র করে তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার উৎখাতের। না পেরে ইদানিং শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য চীনা রেস্তোরায় খেয়ে দোয়া মাহফিলের ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। যে কোন সরকারের ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে তবে তাদের ভাল কাজের প্রশংসা না করা হীনম্মন্যতা ছাড়া আর কিছু নয়। একটি স্বাধীন দেশ সৃষ্টি করার জন্য যেভাবে ইতিহাস বঙ্গবন্ধুকে মনে রেখেছে তাঁর কন্যাকে মনে রাখবে একজন জনবান্ধব প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে। গৃহহীনদের গৃহ দেয়ার চেয়ে মুজিব বর্ষের আর ভাল কোন কাজ হতে পারে বলে মনে হয়না। এই বিশাল কর্মযজ্ঞের সাথে যারাই জড়িত ছিলেন তাদের সকলকে অভিনন্দন।
লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক