ইউরোপজুড়ে ওমিক্রন

24

পূর্বদেশ ডেস্ক

শুরু হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। এখন ইউরোপজুড়ে মানুষ করোনার ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছেন। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, ইটালি, চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়ছে ওমিক্রন। বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা মানুষরা এই ভাইরাস বহন করে নিয়ে আসছেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
রোববার নেদারল্যান্ডসে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা ১৩ জনের শরীরে ওমিক্রন ভাইরাস পাওয়া গেছে। জার্মানিতে মোট তিনজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত। সকলেই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছেন। শনিবার একজন ওমিক্রন-আক্রান্তের খোঁজ মিলেছে। তিনিও দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছেন। এছাড়া বাভারিয়াতে দুইজন ওমিক্রন আক্রান্তের খোঁজ পাওয়া গেছে।
যুক্তরাজ্য আগেই জানিয়েছিল, দেশটিতে কয়েকজনের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এবার চেক প্রজাতন্ত্র, ডেনমার্ক, ইতালি ও ফ্রান্স জানিয়েছে, তাদের দেশেও এই স্ট্রেইন পাওয়া গেছে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা আটজন ওমিক্রন ভাইরাসে আক্রান্ত।
যুক্তরাজ্যে এখন দোকানে যেতে, যানবাহনে যাতায়াত করতে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তাছাড়া আজ থেকে যারা যুক্তরাজ্যে যাবেন, তাদের করোনা পরীক্ষা করা হবে। সেই রিপোর্ট যতদিন না আসছে, ততদিন তাদের বাধ্যতামূলক আইসোলেশনে থাকতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইতোমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকায় ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, এই নিষেধাজ্ঞা অন্যায্য। এটি একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। তিনি এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহব্বান জানিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলেছে, এই ভাইরাস এখন অনেক দেশেই পাওয়া যাচ্ছে। তাই শুধু দক্ষিণ আফ্রিকায় যাতায়াতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা ঠিক নয়।
সুইজারল্যান্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যুক্তরাজ্য, ইতালি, চেক প্রজাতন্ত্র, নেদারল্যান্ডস, মিসরের মতো দেশগুলো থেকে কেউ সেখানে গেলে বাধ্যতামূলক আইসোলেশনে থাকতে হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা মেডিক্যাল অ্যাসেসিয়েশন দাবি করেছে, যারা ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের শরীরে ব্যথা থাকছে। রোগীরা অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন না। তাদের দাবি, এখন সবে মানুষ এই ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছে। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত কম বয়সীরা আক্রান্ত হচ্ছে। আরও পরীক্ষার পর গবেষকরা এই বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে পারবেন।

ওমিক্রন কতটা উদ্বেগের : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডবিøউএইচও) ওমিক্রনকে করোনার ‘উদ্বেগজনক ধরন’ বলে আখ্যায়িত করেছে। তবে সংস্থাটি বলেছে, করোনার নতুন এ ধরন অন্যান্য ধরনের তুলনায় বেশি সংক্রামক বা এ ধরনের সংক্রমণে রোগীর অবস্থা আরও বেশি গুরুতর হয় কি না, সেটা এখনো জানা যায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ অ্যান্টনি ফাউসি গত রোববার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বলেন, ওমিক্রনের সংক্রমণ ক্ষমতা ও অন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে স্পষ্ট হতে এবং বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়ার জন্য আরও আনুমানিক দুই সপ্তাহ সময় লাগবে।
ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত অনুসারে, দক্ষিণ আফ্রিকায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার বাড়ছে। ধারণা করা হচ্ছে, সার্বিক সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় হাসপাতালে ভর্তির হার বাড়ছে। ওমিক্রনের ভয়াবহতা বোঝার জন্য কয়েক দিন থেকে কয়েক সপ্তাহ সময় লেগে যেতে পারে।

টিকায় থামবে ওমিক্রন? : বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক জাগানো করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ এর বিরুদ্ধে বিদ্যমান কোভিড টিকা কতটা কার্যকর তা জানার জন্য মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বিশেষজ্ঞরা এটুকু ধারণা করতে পারছেন যে এ ধরনটি আরও বেশি সংক্রামক এবং শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অ্যান্টিবডিকে ফাঁকি দিতে সক্ষম।
ওমিক্রনের সামনে টিকার প্রতিরোধ কতটা টিকবে, সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। ফাইজার ও মডার্নাও বলেছে, প্রয়োজনে টিকার প্রক্রিয়াগত দিকটি নতুন করে সাজানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। জনসন অ্যান্ড জনসন ইতোমধ্যে ওমিক্রনের কৃত্রিম একটি সংস্করণের বিরুদ্ধে তাদের টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষার পরিকল্পনা করেছে।
ফাইজারের মুখপাত্র জেরিকা পিটস বলেন, ফাইজারের বিজ্ঞানীরা ছয় সপ্তাহের মধ্যে বিদ্যমান টিকার পরিবর্তন করতে পারবে এবং নতুন ভ্যরিয়্যান্টের জন্য ১০০ দিনের মধ্যে টিকা সরবরাহ করতে পারবে।
মডার্না বলছে, নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পরপরই গত মঙ্গলবার তাদের কাজ শুরু হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট ড. স্টিফেন হোগে বলেন, যদি প্রয়োজন হয়, তবে দুই মাসের মধ্যে মডার্না তার টিকার নতুন সংস্করণ আনতে পারবে এবং কার্যকারিতা পরীক্ষার ফল জানাতে পারবে তিন মাসের মধ্যে।
টিকার তৃতীয় ডোজ বা ‘বুস্টার ডোজ’ নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম কি না কোম্পানি দুটি সেটাও পরীক্ষা করার পরিকল্পানা করেছে।
নিউ ইয়র্কের রকফেলার ইউনিভার্সিটির রোগতত্ত¡বিদ মাইকেল নুসেঞ্জভিগ জানান, তিনি এবং তার সহকর্মীরা ‘ওমিক্রন’ এর বিরুদ্ধে এমআরএনএ টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ‘ওমিক্রন’ এর জন্য টিকা তৈরি করা গেলে, সেটা ‘অলৌকিক’ ব্যাপার হবে বলেও তার ভাষ্য।

সতর্ক করে ডব্লিউএইচও’র ৫ তথ্য : ১. বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আগে যারা কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন, এ রকম ব্যক্তিরা ফের খুব সহজেই আক্রান্ত হতে পারে ওমিক্রনে। ২. এক ব্যক্তির দেহ থেকে অন্যের দেহে কোনও ভাইরাস যত সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে, সেই ভাইরাস তত বেশি সংক্রামক। করোনা ভাইরাসের ডেল্টা এবং অন্য রূপের তুলনায় ওমিক্রন বেশি সংক্রামক কি না, তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে আরটি-পিসিআর পরীক্ষা এই রূপকে ধরতে সক্ষম বলে জানিয়েছে হু। ৩. কোভিডের বিভিন্ন টিকার উপর এই ভাইরাসের প্রভাব কতটা, তা জানার জন্য কাজ চলছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ৪. করোনার নতুন রূপ ওমিক্রন আরও জটিল রোগ ঘটাবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। করোনার অন্য রূপে আক্রান্ত হলে যে সব উপসর্গ দেখা যায়, তার থেকে আলাদা কোনও উপসর্গ ওমিক্রন ডেকে আনছে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। ৫. প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত তথ্য জানাচ্ছে, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া বেড়েছে। কিন্তু সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তেই রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেবলমাত্র ওমিক্রনের জন্য এই বৃদ্ধি কি না, তা বলার পর্যাপ্ত তথ্য এখনও নেই বলে মত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার।

বিশ্বব্যাপী ফ্লাইট বন্ধের পরিকল্পনা : বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তে দ্রæতই ছড়িয়ে পড়ছে করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন। পশ্চিমে কানাডা থেকে পূর্বে অস্ট্রেলিয়ায় শনাক্ত হয়েছে ওমিক্রন। তাই, বিশ্বব্যাপী ফ্লাইট বন্ধের পরিকল্পনা আবারও আলোচনায় এসেছে। গতকাল সোমবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ আফ্রিকায় নতুন ভ্যারিয়েন্ট শনাক্তের সংবাদে বিশ্বব্যাপী সৃষ্টি হয়েছে নতুন শঙ্কা। আন্তর্জাতিক বাজারেও এর প্রভাব পড়ে।
করোনা মহামারির কারণে প্রায় ২ বছর ধরে বিশ্ব-বাণিজ্যে স্থবিরভাব বিরাজ করছে। এটি কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় যখন দেশগুলো ধীরে ধীরে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা তুলে নিচ্ছে, ঠিক তখনই করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিস্তারে বিশ্বব্যাপী দেখা দিয়েছে নতুন সংকট।