ইউক্রেনে রুশ ভ্যাকুয়াম বোমা

18

পূর্বদেশ ডেস্ক

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পুতিনবাহিনী ভ্যাকুয়াম বোমা প্রয়োগ করছে বলে অভিযোগ করেছে ইউক্রেন-সহ বিশ্বের একাধিক মানবাধিকার সংগঠন। যদিও এ বিষয়ে সরকারি ভাবে মুখ খোলেনি মস্কো। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভ্যাকুয়াম বোমা প্রয়োগের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তা যুদ্ধাপরাধের সমতুল্য বলে মত মানবাধিকার সংগঠনগুলির। কারণ ১৯৪৯ সালের জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রে এই বোমার ব্যবহার নিষিদ্ধ।
ইউক্রেনের দাবি, সোমবার তাদের দেশের মাটিতে ক্লাস্টার বোমার পাশাপাশি এই নিষিদ্ধ অস্ত্র প্রয়োগ করেছে পুতিনবাহিনী। সোমবার হোয়াইট হাউসের আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে বৈঠকে পর সংবাদমাধ্যমের কাছে আমেরিকায় ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রদূত ওসামা মাকারোভার দাবি করেন, ইউক্রেনের মাটিতে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে রাশিয়া। সোমবার তারা ভ্যাকুয়াম বোমা ব্যবহার করেছে। যেটি জেনেভা সম্মেলনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। যদিও ইউক্রেনের কোন অঞ্চলে এই বোমাছোড়া হয়েছে, তা জানাননি মাকারোভা।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দাবি, ভ্যাকুয়াম বোমার পাশাপাশি ক্লাস্টার বোমার মতো নিষিদ্ধ অস্ত্রও হয়তো প্রয়োগ করেছে রাশিয়া। তারা দাবি করেন, রাশিয়ার হামলার লক্ষ্য ছিল ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ।
অ্যামনেস্টির অভিযোগ, শুক্রবার সকালে উত্তর-পূর্ব ইউক্রেনের একটি প্রি-স্কুলে ক্লাস্টার বোমা দিয়ে হামলা চালায় পুতিনবাহিনী। হামলায় ওই স্কুলে আশ্রয় নেওয়া এক শিশু-সহ অন্তত তিন জন নিহত হয়েছেন।
ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ক্লাস্টার এবং ভ্যাকুয়াম বোমার মতো নিষিদ্ধ অস্ত্র প্রয়োগের তীব্র নিন্দা করেছে অ্যামনেস্টি এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-সহ বহু মানবাধিকার সংগঠন। অ্যামনেস্টির সাধারণ সচিব অ্যাগনেস কালামার্ড বলেন, এ ধরনের হামলা যুদ্ধাপরাধের সমান।
নিষিদ্ধ অস্ত্র নিয়ে হামলার বিষয়ে সরকারি ভাবে কোনও বিবৃতি দেয়নি রাশিয়া। ইউক্রেনের মাটিতে এই বোমাছোড়া হয়েছে কি না, তা নিয়েও যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণও পাওয়া যায়নি।
তবে আমেরিকার সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর দাবি, ইউক্রেনীয় সীমান্তে ‘টিওএস-১’ এবং ‘টিওএস-১এ’-এর মতো বেশ কিছু রকেট উৎক্ষেপক দেখা গিয়েছে। এই রকেটের সাহায্যেই ভ্যাকুয়াম বোমাছোড়া হয়।
নিজেদের দেশের সংবাদমাধ্যমের এ দাবি সত্তে¡ও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভ্যাকুয়াম বোমা ব্যবহারের অভিযোগ নিয়ে মুখ খোলেনি আমেরিকা। যদিও মানবাধিকার সংগঠনগুলির সঙ্গেই একমত হয়েছে ওয়াশিংটন। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকির মতে, (ভ্যাকুয়াম বোমা ব্যবহারের) এই অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে তা যুদ্ধাপরাধ। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে অস্বীকার করেছে ওয়াশিংটনে রাশিয়ার দূতাবাস।
যুদ্ধবিশারদদের মতে, অ-পরমাণু অস্ত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী হল ভ্যাকুয়াম বোমা। আকাশ বা জলপথে এর ব্যবহার সম্ভব না হলেও স্থলযুদ্ধে তা মারণাস্ত্র। বোমার ঘায়ে একসঙ্গে অনেকের দেহ গায়েব করে দিতে সক্ষম এটি। পাশাপাশি, সাধারণ বোমার তুলনায় ভ্যাকুয়াম বোমার বিস্ফোরণ দীর্ঘ ক্ষণ ধরে স্থায়ী হয়। অনেকের কাছে এটি থার্মোবারিক অস্ত্র বা এরোসল বোমা বলেও পরিচিত।
উৎক্ষেপণকারী যন্ত্র বা রকেট লঞ্চারের সাহায্যে এই বোমাছোড়ার পর তা বাতাস থেকে অক্সিজেন শুষে নিতে শুরু করে। ফলে অন্যান্য বোমার তুলনায় বাতাসে বিস্ফোরণের বেশি ঢেউ খেলিয়ে দেয় এটি।
থার্মোবারিক অস্ত্র বা ভ্যাকুয়াম বোমার মধ্যে জ্বালানি থেকে বাতাসের সংস্পর্শে আসা বিস্ফোরক (ফুয়েল-এয়ার এক্সপ্লোসিভস বা এফএই)-ই সবচেয়ে প্রাণঘাতী। সাধারণ বিস্ফোরকে বø্যাক পাউডারের মতো জ্বালানি এবং অক্সিডাইজারের মিশ্রণে ২৫ শতাংশ জ্বালানি এবং ৭৫ শতাংশ অক্সিডাইজার থাকে। তবে থার্মোবারিক অস্ত্র বা ভ্যাকুয়াম বোমায় প্রায় ১০০ শতাংশই জ্বালানি।
ভ্যাকুয়াম বোমায় প্রায় পুরোটাই জ্বালানি নির্ভর বিস্ফোরক হওয়ায় জলের তলায় বা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অধিক উচ্চতায় অথবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় তা ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু, যুদ্ধের ময়দানে সুড়ঙ্গ কিংবা বাঙ্কারের মতো জায়গায় তা ঘাতক। কারণ বদ্ধ জায়গায় হামলার পর অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসামাত্রই তা ঢেউয়ের মতো বিস্ফোরণের তরঙ্গ শুরু করে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, ১৯৯৩ সালে আমেরিকার সেনাবাহিনী গুপ্তচর সংস্থার একটি রিপোর্টে ভ্যাকুয়াম বোমার মারণ ক্ষমতা নিয়ে উল্লেখ রয়েছে। ওই রিপোর্ট বলা হয়েছে, ভ্যাকুয়াম বোমার প্রাণঘাতী পদ্ধতি অন্যান্য বিস্ফোরকের থেকে আলাদা। বিস্ফোরণের প্রবল তরঙ্গের চাপই তা প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে। ওই চাপে ফুসফুস ফেটে যায়।
ভ্যাকুয়াম বোমাই শুধু নয়। পরমাণু শক্তির নিরিখেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘অসম’ যুদ্ধে নেমেছে ইউক্রেন। স্টকহলম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর দাবি, রাশিয়ার কাছে বিশ্বের সবচেয়ে বড়বড় পরমাণু অস্ত্রভান্ডার রয়েছে। পুতিনের ভান্ডারে ওয়ারহেডসই রয়েছে ছ’হাজার ৩৫০টি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমেরিকা (সাড়ে পাঁচ হাজার)। চিন (৩৫০) বা ফ্রান্সের (২৯০) কাছে তা থাকলেও রাশিয়া বা আমেরিকার তুলনায় নগণ্য।
এদিকে টানা ছয় দিন পার করল রাশিয়া-ইউক্রেনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এর মধ্যেই সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের একটি রিপোর্ট বলছে, ইউক্রেন এখন রাশিয়া সেনার চক্রব্যূহে বন্দি। চার দিক থেকে ইউক্রেন ঘিরে তারা ক্রমশ এগোচ্ছে আরও ভিতরে। রাজধানী কিভের সীমানা পেরুচ্ছে রুশ সেনা। অন্য দিকে ইতোমধ্যে দখল হয়ে গিয়েছে চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্র। ইউক্রেনের খেরসন দিয়েও ঢুকে পড়েছে রাশিয়ার অন্য এক সেনাদল।
জানা যাচ্ছে, রাশিয়া মোট চার দিক থেকে ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছে। একটি সেনা দলের লক্ষ্য রাজধানী কিভ। আর একটি সেনা দল এগোচ্ছে খারকিভকে কেন্দ্র করে। ইউক্রেনের সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, সোমবারই খারকিভে রুশ সেনারছোড়া বিস্ফোরকে একাধিক সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন।
পুতিনবাহিনীর অন্য একটি দল ডনবাস কেন্দ্রে হামলা চালাচ্ছে। রুশ সমর্থিত লুহনস্কের পূর্ব প্রদেশে আবার হামলা চালায় ইউক্রেন। তাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তেল কেন্দ্রে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
ইউক্রেনের কর্মকর্তারা বলেছেন পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেইনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভ এবং দক্ষিণে বন্দরনগরী মারিওপোলে দুই পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াইয়ে রাশিয়ার গোলার আঘাতে ডজনখানেকের বেশি সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে শিশুও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের স্যাটেলাইট কোম্পানি ম্যাক্সার জানিয়েছে, কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে তারা দেখতে পেয়েছেন রাজধানী কিয়েভ দখলের জন্য সাঁজোয়া যান, ট্যাংক ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামের একটি বহর পাঠিয়েছে রাশিয়া, যার দৈর্ঘ্য ৪০ মাইল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাশেলেট সোমবার বলেছেন, বৃহস্পতিবার আগ্রাসনের শুরু থেকে ইউক্রেনে এ পর্যন্ত ১০২ জন বেসামরিক মানুষের মৃত্যুর খবর তারা পেয়েছেন, আহত হয়েছেন ৩০৪ জন। তবে হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হবে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে গতকাল রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয় ইউক্রেইনের রাজধানী কিয়েভের সুনির্দিষ্ট কয়েকটি নিশানায় হামলা চালানোর হুমকি দিয়ে অধিবাসীদের সতর্ক করার পরই নগরীর কেন্দ্রস্থলে একটি টিভি টাওয়ারে রকেট হামলা চালিয়েছে রুশ বাহিনী। ইউক্রেইন সরকারের জরুরি সেবা বিভাগ টিভিতে এক বিবতিতে জানিয়েছে, হামলায় কমপক্ষে পাঁচজন নিহত হয়েছেন।
হামলার পর কিয়েভের টেলিভিশন টাওয়ারটির কাছে ঘন কালো ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। তবে টাওয়ারের ওপর কোনও গোলা পড়েছে কিনা তা এখনও পরিষ্কার জানা যায়নি। ৩৮০ মিটার লম্বা (১২৫০ ফুট) টাওয়ারটি এখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে বিবিসি।
ইউক্রেইনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলেছে, বেশ কিছু যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং কিছু সময়ের জন্য চ্যানেলগুলো বন্ধ থাকবে। সোশ্যাল মিডিয়ার ফুটেজে দেখা গেছে, টিভি টাওয়ারস্থলে বিস্ফোরণ হয়েছে। ফুটেজটি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। সূত্র : বিবিসি, রয়টার্স, আনন্দবাজার পত্রিকা।