টক-শো এবং ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর

222

মাঝে মাঝে টক-শো দেখার সুযোগ হয়। তবে বেশীর ভাগ টক-শো মধ্যরাতে হয় বিধায় অনেক সময় দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি। মিডিয়াতে টক-শো আয়োজন অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এক্ষেত্রে বিজ্ঞ ও গুণী ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি এবং সাবলীল মতামত আমাদের শিক্ষার দ্বার প্রসারিত করে নিঃসন্দেহে। সরকার টক-শোর সার-সংক্ষেপকে কাজে লাগিয়ে জনগণের কল্যাণে ব্রতী হয়। বিশেষ করে ঘুষ-দুর্নীতি, দখলদার, চাঁদাবাজ, মানব পাচারকারী এবং ধর্ষকদের ব্যাপারে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জাগ্রত হয়। ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার পর থেকে টক-শোর আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ্যনীয়। সৎ পরামর্শ ও মতামত না দিয়ে লাগামহীন কথার এক পর্যায়ে এই সুযোগ হাত ছাড়া করা যাবে না, ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটা বিহিত করতেই হবে। অতঃপর তাঁদের মধ্যে ভাবান্তর এই, ইচ্ছা থাকলেও সব কথা বলা যাচ্ছে না। এই ধরনের বক্তব্য দিয়ে টক-শোর সময় পার করা যায়, ফলাফল শূন্যের কোটায় থাকে। আমাদের এই স্বাধীন দেশে অনেককে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতে দেখেছি, হাজারো সাংবাদিক সম্মেলন করতে দেখেছি। তাঁরা নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, জনগণের ভোট লাভে অসমর্থ হন। অনেকে রাজনীতির নামে টক-শোতে অংশগ্রহণ করে নিেেজকে সজ্জন দাবী করেন। গণতান্ত্রিক এই দেশে টক-শোতে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য সরকার বাহাদুরকে সাধুবাদ জানানো আমাদের দায়িত্বে বর্তায়।
ডাকসু সহ-সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলা ন্যাক্কারজনক, অমানবিক এবং নিন্দনীয়। এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এবং বাইরে ভিপি নুর পাঁচ-ছয় বার হামলার শিকার হয়েছে, যা অপ্রত্যাশিত। প্রতিবারই শারীরিকভাবে নির্যাতিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্লিপ্ততা এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় বহন করে। ভবিষ্যত দিনগুলোতে প্রশাসন উক্ত বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন, তা আমরা প্রত্যাশা করি। জনগণ মনে করে ব্যক্তি নুরের ওপর হামলা, ডাকসু পরিবারের ওপর চপেটাঘাত। পক্ষান্তরে ছাত্র সমাজের জন্য কলঙ্ক। ব্যক্তি নুরের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় আছে, তা অতি গৌরবের। ডাকসু শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নয়, দেশের ছাত্র সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে। শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত ডাকসু সদস্যরা একাত্ম হয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণে কাজ করবে, শিক্ষার্থীরা তাই প্রত্যাশা করে। ইতোমধ্যে ভিপি নুরের পক্ষ থেকে ডাকসুর সমাজ সেবা সম্পাদক আখতার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস এবং সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসাইনসহ ৩৭ জনকে দায়ী করে মামলা করেছে। প্রক্টর অধ্যাপক এ.কে.এম. গোলাম রাব্বানীর অপসারণ চাওয়া হয়েছে, দোষী ছাত্রদের বহিস্কার এবং সিসি ফুটেজ উদ্ধারের দাবী করা হয়েছে। দাবীগুলো যুক্তিসংগত, প্রশাসনকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। আমরা আশা করি, সুষ্ঠ তদন্তের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। সম্প্রতি ডাকসু সমাজ সেবা সম্পাদক আখতার হোসেন মিডিয়াতে প্রক্টর এ.কে.এম. গোলাম রাব্বানীকে নির্লজ্জ হিসেবে সম্ভোধন করেছে, যা নিতান্তই দুঃখজনক এবং শালীনতা বর্জিত। ভিপি নুরের ওপর আক্রমণের হেতু কি? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। যদি বলা হয়, ভিপি হিসেবে ডাকসুর একচ্ছত্র কাজ নুর নিজ দায়িত্বে করতে চায়, ডাকসু নিয়ে নুরের একান্ত ভাবনা, সমাজ সেবা সম্পাদক আখতার হোসেন ছাড়া অন্যদের সাথে আলাপের প্রয়োজন মনে করেনা, ডাকসুর সাংগঠনিক আলাপ-আলোচনা শুধুমাত্র ছাত্র-ছাত্রী অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সাথে করতে আগ্রহী, অন্যরাও শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষভোটে নির্বাচিত, তা নুর মনে করে না। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সুবাদে নুরুল হক নুরের ডাকসু নেতৃত্বে আসা, ডাকসুতে বহিরাগতদের উপস্থিতির ব্যাপারে ভিপি নুরের প্রত্যক্ষ মদদ, আদর্শগত দ্বন্ধ বা দলীয় কোন্দল ইত্যাদি ডাকসুর অন্য সদস্যদের ক্ষোভের কারণ হতে পারে।
অতি সম্প্রতি ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুরের বক্তব্য মতে “দেশে দুঃশাসন চলছে, নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র চলছে, দেশকে ধ্বংস করা হচ্ছে, যদি বেঁচে থাকি রাজপথের লড়াইয়ে আবার সামিল হবো”। নুরের এই বক্তব্য জাতীয় নেতার বক্তব্যের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে ডাকসু দেশে ছায়া সরকার হিসেবে কাজ করতো। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং আন্দোলনকে সাড়া দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বে ডাকসুর ভূমিকা ছিল অনন্য। পিছনে ফিরে তাকালেই দেখি, স্বাধিকার অন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তথা ছাত্রসমাজ। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ৬৯ গণঅভ্যুত্থানের ডাক দিয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবন থেকে। জনাব তোফায়েল আহমদ ছিলেন সেই অভ্যূত্থানের নায়ক। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানার মধুনাঘাটে অর্ধ-লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন, গণঅভ্যূত্থানের পক্ষে। সেই জনসভায় উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। ডাকসু সহ-সভাপতি জনাব আ.স.ম আব্দুর রব হাজার হাজার মানুষের সামনে বাংলাদেশের পতাকা বীরত্বের সাথে উত্তোলন করেছিলেন। যুদ্ধকালীন সময়ে বেশীর ভাগ ছাত্র নেতারাই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আন্দোলনের সুতিকাগার এবং ডাকসু ছিল তারই হৃৎপিÐ। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ডাকসুর নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছেন ছাত্রসমাজ। গণতন্ত্র উদ্ধারে তাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমান প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। স্বাধীন সার্বভৌম দেশে সাংবিধানিক এবং গণতান্ত্রিক সরকার বর্তমান । কেউ হুইসেল বাজালেই পংঙপালের মত সবাই যুদ্ধের ময়দানে ঝাপিয়ে পড়বে, সে আশায় গুড়েবালি। স্বপ্ন দেখা ভাল, আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন দেখা বেমানান। বর্তমান ডাকসু বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের কল্যাণে কাজ করবে, জনগণ তাই শুধু প্রত্যাশা করে।
আমাদের এই দেশে ছোট-বড় অনেক নেতা টেন্ডারবাজিতে সহজেই জড়িয়ে পড়ে। সে কারণে অনেকেই জেলখানার চার দেয়ালের ভিতরে দিন কাটাচ্ছে। চাঁদাবাজি এবং দূর্নীতির কারণে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বর্তমান ভিপি নুরুল হক নুরের টেন্ডারবাজির বিষয়ে তদন্ত চলছে। ভিপি হিসেবে নিকট ভবিষ্যতে আরো কৌশলী হওয়া নুরের জন্য উত্তম। ডাকসুর অভ্যন্তরে আদর্শগত দ্বন্ধ প্রকাশ্যে রূপ নেওয়া সমীচিন নয়। ছাত্রলীগ এবং মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চকে থামানো জরুরী। ছাত্রলীগের ব্যানারে বারবার অশান্ত হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর। সরকারের অর্জনসমূহ কতিপয় ছাত্রদের কর্মকাণ্ডে ম্লান হতে চলেছে। উন্নয়ণের ধারাবাহিকতা নষ্ট হতে দেওয়া যায় না। ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা উম্মূক্ত রাখাতে হবে। উন্নয়নশীল দেশের স্বার্থে স্বাধীনতা বিরোধীদের রুখতে হবে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠ পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে উদার দৃষ্টিভঙ্গি হবে প্রশাসনের মুল পরিচায়ক। অন্যায়কে না এবং ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
লেখক : কলামিস্ট আ.জ.ম. সামশুল হক