আহমদ শরীফ

14

আহমদ শরীফ, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, লেখক এবং মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম গবেষক। ১৯২১ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারি চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার সুচক্রদন্ডী গ্রামে তাঁর জন্ম। পিতা আবদুল আজিজ ছিলেন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজিয়েট স্কুলের করণিক। খ্যাতনামা পুথি সংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ছিলেন তাঁর চাচা এবং এ করিম দম্পতির স্নেহ-আদরেই গড়ে ওঠে আহমদ শরীফের ভবিষ্যৎ জীবন।
আহমদ শরীফের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ হয় পটিয়া হাই স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৪৪ সালে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। লাকসাম পশ্চিমগাঁও নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজে বাংলার অধ্যাপকরূপে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। কিছুদিন তিনি রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের কর্মসূচি নিয়ামক ছিলেন। ১৯৫০ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগদান করেন এবং পরে এ বিভাগের শিক্ষক হন। মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতানের ওপর গবেষণা করে তিনি ১৯৬৭ সালে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৭২ সালে প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকালের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান, কলা অনুষদের ডীন, সিন্ডিকেট সদস্য এবং শিক্ষক সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন। সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছর অধ্যাপনা শেষে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮৩ সালের ৩০ জুন অবসর গ্রহণ করেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দুবছরের (১৯৮৪-৮৬) জন্য নজরুল অধ্যাপক পদে সমাসীন ছিলেন।
অধ্যাপক শরীফের চাচা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ছয়শ পুথি দান করেন। সেগুলি অবলম্বন করেই আহমদ শরীফের গবেষণা-জীবনের সূচনা হয় এবং অচিরেই তিনি পুথিপাঠে পারদর্শিতা অর্জন করেন। সে থেকে আজীবন তিনি পুথি নিয়ে ভেবেছেন এবং বহু উল্লেখযোগ্য পুথি সম্পাদনাও করেছেন। বাংলা একাডেমীর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ তাঁরই সম্পাদিত ষোল শতকের কবি দৌলত উজির বাহরাম খাঁর লায়লী-মজনু (১৯৫৭)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেরও প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ তাঁর সম্পাদিত পুথি পরিচিতি (১৯৫৮)। এতে সাহিত্যবিশারদ প্রদত্ত ছয়শ পুথির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি আছে। অধ্যাপক শরীফ মধ্যযুগের চল্লিশোর্ধ্ব কাব্যের পুথি সম্পাদনা করেছেন। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো: আলাওলের তোহফা (১৯৫৮) ও সিকান্দরনামা (১৯৭৭), মুহম্মদ খানের সত্য-কলি-বিবাদ-সংবাদ (১৯৫৯), মুসলিম কবির পদসাহিত্য (১৯৬১), জয়েনউদ্দীনের রসুলবিজয় (১৯৬৪), মুজাম্মিলের নীতিশাস্ত্রবার্তা (১৯৬৫), মধ্যযুগের রাগতালনামা (১৯৬৭), বাঙলার সূফীসাহিত্য (১৯৬৯), আফজল আলীর নসিহতনামা (১৯৬৯), বাউলতত্ত¡ (১৯৭৩), সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ, রসুলচরিত (১৯৭৮) ইত্যাদি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও পুথি গবেষণাসূত্রে অধ্যাপক শরীফ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশিষ্টতা অর্জন করেন এবং এ ক্ষেত্রে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী হন। তিনি তাঁর গবেষণা ও ইতিহাস পর্যালোচনার মাধ্যমে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানদের অবদানের যথার্থ পরিচয় তুলে ধরেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস প্রণয়নে অধ্যাপক শরীফের অনন্যতা এখানে যে, তিনি হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকল বাঙালির সাধনাকেই অসা¤প্রদায়িক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করেছেন। ফলে তাঁর বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য (দুখন্ড ১৯৭৮, ১৯৮৩) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস গ্রন্থের মর্যাদা লাভ করেছে। এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কয়েকটি ক্ষেত্রে যেমন, প্রাচীন বাংলার সমাজ সংস্কৃতি ও ধর্ম, বাংলা সাহিত্যের অন্ধকার যুগতত্ত¡, প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সাহিত্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, বাউল সাহিত্য, মুসলমান রচিত প্রণয়োপাখ্যান ও শাস্ত্রগ্রন্থ, সুফিসাহিত্য, ধর্ম সমন্বয়ের সাহিত্য, দোভাষী পুথি ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যাপক শরীফ মৌলিক মতামত ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিয়েছেন। মধ্যযুগের সাহিত্য বিষয়ে তাঁর আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে সৈয়দ সুলতান: তাঁর গ্রন্থাবলী ও তাঁর যুগ (১৯৭২), মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ (১৯৭৭) ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য (১৯৮৫)।
একজন নিঃস্বার্থ ও নির্ভীক বুদ্ধিজীবী হিসেবে তিনি সমাজের অনেক গুরুদায়িত্ব পালন করেন। অন্যায় ও গণবিরোধী কাজের জন্য তিনি যে-কোনো সরকারেরই তীব্র সমালোচনা করতেন। দেশী-বিদেশী নানা ষড়যন্ত্র ও সা¤্রাজ্যবাদী অপকর্মের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, সেনাশাসন, স্বৈরাচার এবং স্বাধীনতার শত্রæদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে তিনি সবসময় কঠোর ভাষায় কলম চালিয়েছেন এবং বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন। এজন্য তিনি সরকার ও ধর্মান্ধদের রোষানলে পড়েন। তাঁর লিখনে ও ভাষণে প্রতিক্রিয়াশীলরা ক্ষুব্ধ হতেন, কিন্তু প্রগতিশীল ও সমাজতন্ত্রীরা অনুপ্রাণিত হতেন। চিন্তা-চেতনায় অধ্যাপক শরীফ ছিলেন শ্রেয়োবাদী ও বামঘেঁষা। তিনি ছিলেন সামাজিক উপযোগিতাবাদী লেখক। আজীবন তিনি মানবতাবাদী, দেশহিতৈষী ও প্রগতিপন্থি বিভিন্ন সংঘ, সমিতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১-এর মার্চে পাকিস্তানি অপশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উজ্জীবিত হওয়ার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পূর্ব বাংলার লেখকদের শপথ বাক্য পাঠ করান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তীকালে তিনি যেসব সভা-সমিতির কেন্দ্রীয় ব্যক্তি ছিলেন সেগুলির মধ্যে কয়েকটি হলো: মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ ও আইন সাহায্য কমিটি, বাংলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ ভাষা সমিতি, কর্নেল তাহের সংসদ, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ফ্রন্ট, স্বদেশ চিন্তা সংঘ ইত্যাদি।
আহমদ শরীফ ছিলেন একটি সফল কর্মময় জীবনের অধিকারী। তাঁর গবেষণাব্রত, লেখার জ্ঞানগত ও সামাজিক দায়বদ্ধতা এবং তাঁর দেশহিতৈষিণী চিন্তা তাঁকে আমৃত্যু সক্রিয় রেখেছিল। ১৯৯৯ সালের ২৪ ফেব্রæয়ারি তাঁর জীবনাবসান ঘটে, কিন্তু তার আগেই তিনি তাঁর মরদেহ উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্য। সূত্র : বাংলাপিডিয়া