আসুন সামাজিক মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখি

57

রঞ্জন বড়ুয়া

“মৃত্যুর পেয়েছি ভয়। মরে যাবো তোমাকেও ছেড়ে? / একাকী, সমাজহীন। মানুষের করাঘাতে আর / উঠিব না জেগে, এ কী ঘুম, অলক্ষণ, এ কী ভার / স্মৃতির, মৃত্যুর আগে, স্মৃতি কি বস্তুত যাবে ছেড়ে?”

এই মহামারীতে কখন, কবে, কোথায়, কিভাবে, কাকে বিদায় নিতে হবে কে জানে? পৃথিবীর মায়া-মমতা-ভালবাসা-সামাজিকতা-দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধ বিবেচনায় বেঁচে থেকে যে দিনগুলি অতিবাহিত হলো তার প্রতিদান কি এই? আমার শেষ যাত্রায় তোমার/তোমাদের কোনও স্পর্শ কি আমি পাবো না? মমতার বন্ধনে আবদ্ধ এই ধরণীতে ভালবাসা নামে যে শব্দটিকে বুকে আঁকড়ে ধরেছিলাম তা কি শুধু অভিনয়? এতসব প্রশ্নের উত্তর আজ আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় হারিয়ে গেল মানবিক মূল্যবোধ, কোথায় আটকে গেল দায়িত্বজ্ঞান, কেন ফুরিয়ে গেল সেই ভালবাসা। একটি মানুষ চিরতরে বিদায় নিচ্ছে অথচ তাঁর প্রতি আমাদের সবদায়িত্ব কি ফুরিয়ে গেছে? এ কোন সমাজে আমাদের বসবাস? আমরাই তো বলি মানুষ নাকি সামাজিক জীব, একসাথে আমাদের বাস, সমাজবদ্ধ থাকা আমাদের কাজ। তবে কেন এই নির্মম পরিণতি? বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে কোন কাক মারা গেলে তখন আশপাশের সমস্ত কাকগুলো জড়ো হয়ে কা কা করে সমবেদনা জানাতে থাকে, তখন আমরা বুঝতে পারি যে একটা কাক আয়ু হারিয়েছে। পক্ষান্তরে এ দুঃসময়ে যেখানে আমরা অন্যের দুঃখে এগিয়ে আসার কথা সেখানে আমরা প্রতিনিয়ত দূরে সরে যাচ্ছি। হ্যাঁ মানবিক মূল্যবোধ থেকে অনেক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে ক্ষুধা নিবারণের তাগিদে তা মানছি। কিন্তু চিরবিদায়ে কেন আমাদের মানবিক মূল্যবোধ কাজ করছে না বুঝতে পারি না। দেখা যাচ্ছে সন্তানের মৃত্যুতে বাবা-মা অসহায়, স্ত্রীর মৃত্যুতে স্বামী-সন্তান অসহায়, বাবা-মার মৃত্যুতে একইভাবে সন্তানরা অসহায় হয়ে চেয়ে থাকে। আবার অন্য দিকে বিপরীত কিছু চিত্র বিবেককে খুব নাড়া দেয় যেমন- হাসপাতালে ছেলে বাবাকে রেখে, বাবা ছেলেকে রেখে তেমন স্ত্রী তার স্বামীকে রেখে পালিয়ে যায়, কি নিদারুণ পরিতাপ। আমার মা-বাবা কিংবা স্ত্রী-পুত্রদের প্রতি কোন দায়িত্ব কি থাকবে না? করোনায় মৃত্যুর কারণে যেই গ্রামেই তার বেড়ে ওঠা, যেই গ্রামের জন্য এত কিছু করেছে, সে সেই গ্রামেই লাশ হয়ে ঢুকতে পারে না। গ্রামের লোকজন বঞ্চনা করে, দূরে ঠেলে দেয়। অথচ দেখা যাচ্ছে সেই মৃত ব্যক্তির সৎকার করছে অন্য স¤প্রদায়ের লোকজন, অন্য গ্রামের অচেনা মানুষ। তাই বলতে হচ্ছে ‘পরকে করে আপন, আপনকে করে পর’। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণা অনুযায়ী বলা যায় যে একজন মৃত ব্যক্তির শরীরে ৩ ঘণ্টার বেশি ভাইরাসটি বেঁচে থাকতে পারে না এবং মৃত ব্যক্তি ভাইরাস ছড়াতে পারে না। তা জেনেও আমরা ঐ ব্যক্তিকে শেষ শ্রদ্ধা করা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করছি। গলা টিপে ধরছি মানবিক মূল্যবোধকে। ‘ভয় নয়-সচেতনতায় জয়’ জেনেও বিবেককে এতটুকু জাগ্রত করতে পারছি না। এত কিছুর পরও বলতে পারেন আমরা কতটুকু সচেতন হতে পারছি, আমরা কি আক্রান্ত হচ্ছি না?
এরিই মধ্যে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে তা আজ কারো অজানা নয়। বাংলাদেশ তথা পুরো বিশ্বে সকল মানুষের একই আচরণ আমরা দেখতে পেয়েছি তা আর আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার অপেক্ষা রাখে না। মৃত্যু হওয়া অপরাধ নয়, তবে সংক্রমিত ব্যক্তি বা পরিবার তা গোপন করে মৃত্যু পরবর্তীতে গ্রামে নিয়ে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করতে যাওয়া এক ধরনের অপরাধ কারণ- মৃত ব্যক্তি রোগ না ছড়ালেও অজ্ঞাত থেকে ঐ পরিবারের অন্য সদস্যরা অনেকের সাথে মিশে গিয়ে রোগ ছড়াতে পারে। মৃত্যুর কারণ জ্ঞাত হলে যথাযথ প্রোট্রেকশন এবং দূরত্ব বজায় রেখে কর্ম সম্পাদন করা যায়। তাতে গ্রামবাসীকে কোন রকম ঝুঁকিতে পড়তে হয় না। সুতরাং আহŸান থাকবে গ্রাম-মহল্লা- আত্মীয় স্বজনদের জানিয়ে কাজটি করা। আজ অন্যের বেলায় যা ঘটছে আগামীকাল আমার/আপনার বেলায়ও তা ঘটতে পারে। আমরা যেহেতু একে অন্যের পরিপূরক সেহেতু আমাদেরকে সচেতন থেকেই সামাজিকতা, দায়িত্ববোধ ও মূল্যবোধকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

লেখক : সংস্কৃতিকর্মী