আসুন প্রকৃত মানবসেবায় ব্রত হই

24

আজহার মাহমুদ

মানুষ মানুষের জন্য/ জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি/ মানুষ পেতে পারে না। উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী ভূপেন হাজারিকার এই গান শুনলে হয়তো সবার মনে জেগে ওঠে মানবতা আর সহানুভূতির পরম পরশ। কিন্তু এটা ততক্ষণ জাগে যতক্ষণ গানটা কেই কানের পাশে বাজায়। বাস্তবতা বড়ই অদ্ভুত। এখানে কেউ কাউকে এক পয়সাও ছাড় দেয় না, এক ইঞ্চি জায়গা দয়া করে না। এই নশ্বর পৃথিবীতে মনুষ্যত্বহীন অমানুষের জয়জয় কার।
যাইহোক মানুষ-অমানুষের বিচার বিশ্লেষণ করার বড় বিষয় নিয়ে আমি আপাতত কিছু লিখতে চাই না। তবে মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারি। আজকাল মানবতা নামক শব্দটা খুব একটা চর্চার বিষয় না। এসমাজে মানবতা, মনুষ্যত্ব লোপ পেয়েছে বহু আগেই। এই যেমন আমি ভালো আছি, এটাই যথেষ্ট। কার কি অবস্থা সেই খবর রাখার মানসিকতা এখন কারও কাছেই নেই। নেই বলতে একদম নেই।
আরও সহজ ভাবে একটু যদি ব্যাখ্যা করা যায়। এই ধরুন আপনি এক বস্তা চাউলের মধ্যে ৫ কেজি পাথর মিশ্রিত করেছেন। কিন্তু লোকে তবুও ওটাকে চাউলের বস্তা বলবে। কারণ ওখানে ৪৫ কেজি চাউল আছে। আর চাউলের পরিমাণ বেশি হলে তো সেটা চাউলের বস্তা বলবেই। ঠিক তেমনী আপনি এক বস্তা পাথরের মধ্যে ৫ কেজি চাউল মিশ্রিত করে দেখুন। কেউ বলবে না এটা চাউলের বস্তা। সকলেই বলবে পাথরের বস্তা।
ঠিক একই রকম অবস্থা আমাদের সমাজে। অমানবিকতা, অমানুষিকতা, সহিংসতা, নোংরামী, বেহায়াপনা এসবই আমাদের চরিত্রের ভেতর জায়গা করে নিচ্ছে এখন। লোক দেখানো সামাজিকতা, মানবতা, ভালো মানসিকতা অনেকে প্রদর্শন করলেও তার সংখ্যাও এখন দিন দিন কমছে। তবে আমি আগেই চাউলের বস্তার উদাহরণ দিয়েছি। তাই ৫ কেজি ভালো মানুষ যারা আছেন তারা এটাকে ভিন্ন-চোখে দেখবেন না সেই আশা রাখছি। কারণ ভালো কাজ করার মানুষ একেবারে উধাও হয়ে গেছে এমনটা বলা মুশকিল। তবে এদের সংখ্যালঘু বলা যায়। আর পৃথিবীতে সংখ্যালঘুদের যেমন অত্যাচার অমানবিকতার নিদর্শন রয়েছে, তেমনি তাদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চিত্রও আছে। বাংলাদেশে এর চিত্র কেমন সেটা সংখ্যালঘুরাই বলতে পারবে। আগেই বলেছি সংখ্যালঘু বলতে আমি বুঝিয়েছি মানবিক কাজ করে এমন মানুষদের। বাংলাদেশে তাদের কতটা সম্মান, সহযোগীতা, সহায়তা মিলছে সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।
যাইহোক মানবতার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা অনেক সময় দেখে থাকি। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে, পুলিশ, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও এই মানবিকতার উদাহরণ দিয়েছেন বহুবার। তবে এসবকিছুই এদেশের জনসংখ্যার তুলনায় ক্ষুদ্র। সারাবছর ঘুরে ফিরে সিজেন ভিত্তিক মানুষকে সহয়তা করলেই মানবিকতার উদাহরণ হয় না। অথচ আমাদের দেশে সিজনাল এবং ভাইরাল মানবিকতা আছে কিছুটা।
আমরা আসলে মূল গোড়া থেকে কতটা মানবিক? আরও সহজ করে বলতে গেলে আমাদের জন্ম থেকে কি আমরা মানবিক হয়ে জন্মাই? জানি এইসব প্রশ্ন অবান্তর মনে হবে আপনার কাছে। কিন্তু সত্য এটাই। আমরা মানবিক হয়ে জন্মাই আর না জন্মাই, জন্ম নিয়ে আমরা সবাই অমানবিক রূপ ধারণ করি। আমাদের নিজেদের মানব শিরায় আসলে কি মানবিকতার কোনো পরশ আছে কি-না সেটাই আমার বুঝে আসে না। আমরা সবাই ক্যালকুলেটিভ। আমরা রাস্তায় পরে থাকা মানুষের কথা চিন্তা করি না, আমরা না খেয়ে থাকা মানুষের কথা ভাবি না। আমরা অন্যের কষ্টের কথা ভাবি না, অন্যের সমস্যার কথা ভাবি না। এই যেমন আপনি ধূমপান করছেন আপনার পাশে একজন সেই ধোঁয়া নিতে পারছে না। অথচ আপনি ঘাড় ত্যারামি করে সেটা করেই যাচ্ছেন। আপনি সিগারেট না খেয়ে সহনশীলতার মাধ্যমে এই জায়গায়ও মানবিকতা দেখাতে পারেন। আপনি খাচ্ছেন মাংস দিয়ে, আপনার কলিগ মাসে একদিনেও আমিষ খেতে পারে না। আপনি চাইলে ভাগাভাগি করে নিয়মিত আপনার কলিগকে খাওয়াতে পারেন। এটাও মানবিকতা।
আপনি আপনার পাশের ঘরের অবস্থা সম্পর্কে জানেন। অথচ তাদের কখনও সহযোগিতা করেন নাই। টাকা পয়সা তুলে বন্ধুরা মিলে চলে যান ঠাকুরগাঁও। সেখানে শীতবস্ত্র দেন, খাবার দেন, কাপড় দেন। এটা মানবিতা নয়। আপনি একটা পরিবারের দায়িত্ব নেন। সেটা ্আপনার এলাকার, আপনার গ্রামের আপনার শহরের হোক। আপনি একজন শিক্ষার্থীর দায়িত্ব নেন। তাকে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট পর্যন্ত সহযোগিতা করে যান। তার জীবনকে আলোকিত করে দিন। সেটাই মানবিকতা, সেটাই সফলতা।
লোক দেখানো, নিউজ করানো আর মাইকিং করে মানবিকতা দেখানোর সংগঠন এখন হাজার হাজার হয়ে পড়েছে। এখন সময় এসেছে এখান থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃত মানবসেবা করার। একটা সঠিক এবং মানবিক দেশ গঠনে প্রয়োজন পরিকল্পনা মাফিক কাজ। আসুন আমরা তেমনী একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
লেখক : প্রাবন্ধিক এবং কলাম লেখক