আশা ও আশংকা

14

 

একসপ্তাহ দুই সপ্তাহ নিজেকে সংযত রাখি। অযথা দোকান বাজার উৎসব অনুষ্ঠানাদিতে ছোটাছুটি না করে নিজের বিপদ এবং পরিবারের বিপদ ডেকে আনা থেকে বিরত থাকি। এই এক দু’সপ্তাহ খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুসপ্তাহ পর হয়ত সেলফ কোয়ারেন্টাইনের আর কোনো প্রয়োজনীয়তাই থাকবে না। প্রকোপ একেবারে কমে যেতে পারে, নইলে হয়ত ঘরে বসেও আক্রান্ত হতে পারেন।বাইরে বেরোনো নিয়ন্ত্রণ করি। করে দিই। যেখানে ভিড় বেশি, কুড়ি জনের বেশি লোক জমায়েত হয়েছে সে জায়গা এড়িয়ে চলি।সাধারণ হাইজিন মেনে চলি। খাবার আগে বা পরে এবং ঘন্টায় অন্তত একবার করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলি। নাকে-মুখে হাত যথাসম্ভব কম দিই। আমি একা কি করব? সবাই তো মানছে না- এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসি। আপনার মাধ্যমে যদি একজনও ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে হল আপনার প্রিয়জন। বাবা-মা-স্বামী-স্ত্রী-সন্তান। যার সঙ্গে আপনি দিনের বেশিরভাগ সময় কাটাচ্ছেন তাকে আপনিই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছেন না তো? বয়স্ক মানুষ ছাড়াও যাদের হাইপ্রেসার, সুগার, হার্টের অসুখ, কিডনি, ক্যান্সার বা অন্য কোনো সাধারণ ক্রনিক রোগ আছে, করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে এলে তাঁদেরও মৃত্যুর হার কয়েকগুণ বেড়ে যায়। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বাইরে না বেরোনো। কতদিন না বেরিয়ে সম্ভব? ঠিক দু-সপ্তাহ। আপনি হয়ত স্ট্রং, সাধারণ ফ্লুয়ের উপসর্গও নেই। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও আপনি ঠিক সুস্থ হয়ে যাবেন। কিন্তু চৌদ্দ দিনের মধ্যে আপনি যদি কোন অন্য মানুষের সংস্পর্শে আসেন তাহলে তাঁর জীবন বিপন্ন হতে পারে। এটা ভেবে শিক্ষিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যদি এটুকু মেনে চলে তাহলেই আমরা নিরাপদ থাকব।
কোভিড-১৯ ভাইরাসের নতুন রূপ ওমিক্রনের সংক্রমণে অর্থাৎ তৃতীয় ঢেউয়ে ২০২২ এর পথচলা শুরু হলো। ক্রমাগত বিস্তৃতির দিকে এগুচ্ছে এ ধরণ। সংক্রমণে হয়ত বিপর্যয়ের দিকেই ধাবিত হচ্ছে জনজীবন।সংক্রমণের বিস্তার রোধে সরকার ইতোমধ্যে বিধিনিষেধ জারি করেছেন। চলছে বিধিবিধান মেনে চলার প্রচার প্রচারণা। কিন্তু প্রশ্ন হলো দুটো বছর করোনার সংগে ঘর করেও আমরা কতোটা সচেতন?করোনা বিধি মানার ব্যাপারে কতটাইবা তৎপর আমরা। এই ছোট্ট ভূখÐে প্রায় ১৮ কোটির মতো মানুষের বাস।জনবহুল এই ভূখÐে দূরত্ববিধি বজায় রাখতে বলা সোনার পাথরবাটির মতোই।সেটা বাদ দিলেও বাকি যা যা থাকে তা নিয়ে চলছে চোর পুলিশ খেলা।
ওমিক্রনকে এখনো পুরোটা বুঝে ওঠা যায়নি। এখনও তা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, প্রতিদিন বিভিন্ন মতামত প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। ইসরায়েলের এক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ভাষ্যমতে ওমিক্রন এক প্রাকৃতিক ভ্যাক্সিন। ওমিক্রনেই করোনামুক্ত হবে পৃথিবী। লন্ডনে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে ওমিক্রন কোভিড-১৯ এর নতুন কোনো প্রজাতি নয় বরং এন্টিজেনিক সিফটের মাধ্যমে তৈরি হওয়া নতুন এক ভাইরাস। যাকে সার্স কোভিড-২ এর বদলে সার্স কোভিড-৩ বলা যায়। করোনা ভাইরাস বহু যুগ ধরেই বন্য প্রকৃতিতে ছিল।বন্য জীবনে সীমাবদ্ধ থাকা এই ভাইরাস পরবর্তীতে বিবর্তনের ফলে বন্য জীবন থেকে মানুষের জীবনের অভিযোজিত হয়েছে। সার্স, মার্স, কোভিড-১৯ এ সবই সেই করোনা ভাইরাসের বিভিন্ন অভিযোজিত রূপ। যে ভাইরাস যতবেশি সংক্রমক হয় সাধারণত সেই ভাইরাসের দ্বারা সৃষ্ট রোগের তীব্রতা ও তার দ্বারা পোষক দেহকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পরিমাণ কিন্তু তুলনামূলকভাবে কম হয়। ভাইরাস এটাই চায় অনেক অনেক পোষকের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়ে নিজে বেঁচে থাকতে আর পোষককেও বাঁচিয়ে রাখতে। ওমিক্রনের ক্ষেত্রে সেটাই দেখা যাচ্ছে। এর সংক্রমণ ক্ষমতা প্রবল হলেও এখনও পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে এটি আপার রেসপিরেটরি ট্র্যাকের মধ্যেই অবস্থান করে সেখানে রোগ সৃষ্টি করছে। করোনা বা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট যেখানে ওমিক্রনের চেয়ে কম সংক্রামক ছিল সেটি কিন্তু ফুসফুসসহ অন্যান্য বিভিন্ন অঙ্গে অবস্থান করে সেই সব স্থানে রোগ সৃষ্টি করেছিল। করোনা ভাইরাস তীব্র অভিযোজন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি আরএনএ ভাইরাস। আর এন এ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমণ যত দ্রুত ছড়ায় অভিযোজনও ততবেশী হবার একটা সম্ভাবনা থাকে। তৃতীয় ঢেউয়ে সবেমাত্র আমরা পা দিয়েছি। পোস্ট কোভিড বা লং কোভিডের কী ফলাফল তা এখনও জানা নেই কারো,তাই কখনোই একে সহজভাবে নেওয়া যাবে না বা ঠিক হবে না। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। রোগকে পর্য্যবেক্ষণে রাখতে হবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। তৃতীয় ঢেউয়ে রোগ ল²ণ প্রকট ও প্রাণঘাতী না হলেও একইসময় বহু সংখ্যক মানুষ চিকিৎসা কর্মী বা জরুরি সেবাদাতারা আক্রান্ত হলে সাময়িকভাবে একটা বিপর্যয়ের আশংকা থেকেই যায়। তাই ওমিক্রনকে কোনোভাবে হালকা ভাবে নেওয়া যাবে না। ওমিক্রন আক্রান্ত ব্যক্তিরা তেমন কোনও বড় সমস্যায় ভুগছেন না।পর্য্যবেক্ষণ বলছে তৃতীয় ঢেউয়ে দিন দুই তিনেকের মধ্যে হালকা জ্বর,গায়ে ব্যথা, মাথা যন্ত্রণা, সর্দি কাশি এমন উপসর্গ নিয়ে মাত্র কয়েকদিনে সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন বেশীরভাগ আক্রান্ত। আর এই হালকা উপসর্গ দেখেই অনেক মানুষ আরও বেশি বেপরোয়া।
করোনাকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের আরও কতটা পথ হাঁটতে হবে সেকথা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না।এবং যা নিয়ত ভাবিয়ে তুলছে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের তাই চিকিৎসাবিজ্ঞানী থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞ সকলেই একটা কথাই বলছেন কোনোভাবে রোগকে হালকাভাবে নিয়ে বেপরোয়া হয়ে চলাফেরা করা যাবে না। লড়াই করে আমাদের টিকিয়ে থাকতে হবে। আর লড়াই করার প্রধান অস্ত্র হলো সরকার এবং বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ঘোষিত স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিধিনিষেধ মেনে চলা। যেমন সময়মতো টিকা নেওয়া, যথাসম্ভব ভিড় এড়িয়ে চলা, মাস্ক পরা, স্যানিটাইজার ব্যবহার করা। নিজের, পরিবারের, সমাজের দেশের সুরক্ষায় সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টায় প্রবিষ্ট হই। আশা যেন আশংকায় পর্যবসিত না হয়, বরঞ্চ সতর্ক চলনায় নিবিষ্ট থেকে আশংকাকে আশায় রূপান্তর করি।
লেখক: প্রাবন্ধিক