আল-হাছানী আল মাইজভান্ডারী অধ্যাপক কাজী ফরিদ উদ্দিন আখতার

281

ত্বরীকা-এ-মাইজভান্ডারীর প্রতিষ্ঠাতা গাউছুল আজম শাহছুফী সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভান্ডারীর প্রিয় নাতনী সৈয়দা সুলতানা বেগমের পবিত্র শশম মোবারক থেকে শাহজাদা এ গাউছুল আযম বাবা ভান্ডারী, সৈয়দ খায়রুল বশর কেবলা-এ-আলমের পবিত্র ঔরশে এই সাধক পুরুষের জন্ম হয়। দুই মহান অলিকুল শিরোমনীর রক্তগত ও আধ্যাত্মিক মহামিলনের মোহনাস্বরূপ আল্লাহর নেয়ামত বিতরণ ও বিকিরণের এক অসাধারণ ঐশী ফোয়ারা হিসাবে নেয়ামত-সন্ধানী মানুষ যখনই হযরত সৈয়দ সামশুল হুদা (ক.) এর সান্নিধ্যে আসতো সাথে সাথে তাঁর কৃপা বা দয়া লাভ করতো। সৈয়দ সামশুল হুদা (ক.) মাইজভান্ডারী প্রায় ৩০ বছরাধিক নির্বাক জীবন যাপন করেন। তাঁর এই নীরবতা সম্পর্কে লেখকের মনে প্রশ্ন ছিল তিনি কি কোন অসুস্থতাজনিত কারনে নির্বাক? নাকি স্বেচ্ছায় বাকসংযম করছেন? এই কৌতুহল নিবারনের জন্য একদিন সম্ভবত ১৯৭২ সনের ৫ এপ্রিল বাবা ভান্ডারীর ওরশ শরীফে তাঁর সম্মুখে উপস্থিত হতেই তিনি হঠাৎ আমাকে বলে উঠলেন এক পেকেট সিগারেট এনে দাও লিখতে পারবে। আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম তিনি মূলতঃ বাকসংযম করছেন। তিনি বোবা নন, যুগ যুগ পেরিয়ে আমি সত্যিই লিখতে পারছি। সৈয়দ সামশুল হুদা (ক.) মাইজভান্ডারী এক নীরব বাকসংযমী উচ্চ পর্যায়ের অর্থাৎ আরেফগণের কাফেলায় এক ‘সর্দারে অলী’ ছিলেন। তাঁর অসংখ্য কারামত রয়েছে। ইতিমধ্যে তাঁর একটি জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। মাইজভান্ডার দরবার শরীফসহ বিভিন্ন লাইব্রেরিতে সেই জীবনী গ্রন্থে অনেক ঘটনা বহুল তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের বর্ণনা রয়েছে। পত্রিকার কলেবর বৃদ্ধি না করার জন্য তাই কারামতের বিস্তারিত বর্ণনা না করে তাঁর জীবনাদর্শনের প্রতি পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষন করছি। তিনি ছিলেন দুর্লভ ও অসাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী একজন মহান অলি-কামেল। মানুষকে অন্তর দিয়ে অর্থাৎ রূহানী শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রন করার যে অতুলনীয় শক্তি তিনি দীর্ঘ সাধনার মাধ্যমে অর্জন করেছিলেন তা যাঁরা নিজেদেরকে তাঁর কদমে সমর্পন করেছিলেন তাঁরাই একমাত্র উপলদ্ধি করেছেন। সরাসরি মুখে কোন নির্দেশনা না দিয়ে জগতের নানা জটিলতা থেকে মুক্ত করে মানুষকে আল্লাহ ও রাসুলের দেখানো পথে গতিশীল রাখা কতো দুরূহ তা বর্ণনার অপেক্ষা রাখেনা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘অমন করে বাইরে থেকে ডাকবো না আর ডাকবো না, পারি যদি অন্তরে তার ডাক পাঠাবো…’। এতে বুঝা যায় উন্নত আত্মা বা উন্নত অন্তর দিয়ে অন্তরকে ডাকা যায়, অর্থাৎ অন্তরকে আরেকটি উন্নত অন্তর শাসন বা নিয়ন্ত্রনও করতে পারে। বাবাজান সৈয়দ সামশুল হুদা (ক.) দীর্ঘ সময় কথা না বলে অন্তর দিয়ে তাঁর ভক্তকুলকে সুশাসন দ্বারা ইহদিনাছ সিরাতুল মুস্তাকীমের পথে গতিশীল রাখতে পেরেছিলেন বলেই তিনি ‘সুলতানুল আরেফীন’। আরেফগণের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ‘তাকওয়া’ অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পন। এ প্রসঙ্গে সুলতানুল আরেফীন হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (র.) এর একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো- ‘একদিন হযরত বায়েজিদ (র.) কোন এক শহরে সফরে ছিলেন। মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করে আস্তানায় ফিরে আসলে উক্ত মসজিদের ইমাম সাহেব তাঁর সাক্ষাতে আসেন, ইমাম সাহেব হযরতকে প্রশ্ন করলেন- আপনি চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য কিছুই করেন না, কেউ হাদিয়া নজর দিলেও তেমনটা নেননা, আপনার সংসার কিভাবে চলে? তখন হযরত বায়েজিদ (র.) বলেন আপনি বসুন, আমি ওয়াক্তের ফরজ নামাজ আদায় করে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেব। ইমাম সাহেব বললেন হুজুর এখনি না আপনি জামাতে নামাজ পড়লেন? হযরত বললেন এই মুহ‚র্তে আপনি যে প্রশ্নটি করেছেন তাতে আমি নিশ্চিত হয়েছি আপনার পেছনে আমার নামাজটি আল্লাহর দরবারে কবুল হয়নি। কারণ যে মোমেন মুসলমান আল্লাহর উপর নির্ভর না করে আগামী দিনের রুটি রুজি নিয়ে চিন্তা করে তার তাকওয়া বা আল্লাহর উপর নির্ভরতা দুর্বল হয়ে যায়। তার পেছনে নামাজ আল্লাহ কবুল করবেন না। তাই আমার উপর আবার ওয়াক্তের নামাজ ফরজ হয়ে গেছে’। এই ঘটনা প্রমাণ করে তাকওয়ার পরিপূর্ণতা যার আছে তিনিই আরেফ। হযরত সৈয়দ সামশুল হুদা (ক.) জীবনে কোন দিন জীবিকার জন্য সংসারের জালে আবদ্ধ হননি। নবীর সুন্নাত হিসেবে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলেও জগতের কোন কালিমা তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর সিলসিলা ছিল মগ্ন চৈতন্যের অন্যতম প্রধান মাইজভান্ডারী সাধক-সম্রাট গাউছুল আজম শাহছুফী সৈয়দ গোলামুর রহমান বাবা ভান্ডারী (ক.) এর সিলসিলা। মাইজভান্ডারী পরিবারের রক্ত ও আদর্শের যোগ্য উত্তরসুরী, নির্বাক এক মহান অলিয়ে কামেল। তাঁর সন্তানগণ প্রত্যেকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। সৈয়দ সামশুল হুদা (ক.) মাইজভান্ডারীর পবিত্র ওরশ শরীফ প্রতি বছর ১লা মাঘ মহা-সমারোহে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভান্ডার শরীফে অনুষ্ঠিত হয়।
১০ই মাঘ মাইজভান্ডারী তরিকার প্রধান প্রাণ পুরুষ হযরত গাউছুল আজম শাহ আহমদুল্লাহ (ক.) এর বার্ষিক ওরশ শরীফের প্রধান দিবসকে কেন্দ্র করে মূলতঃ ১ মাঘ থেকে লক্ষ লক্ষ মুক্তি পাগল মানুষের ঢল নেমেছে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ অভিমুখে। লাখো মানুষের এই তীর্থ সম্মেলনে পুরো চট্টগ্রামে এক অনন্য ধর্মীয় আবহের সৃষ্টি হয়েছে। ভোগবাদী বিশ্বের দুনিয়াবী নানা জটিলতা ভেদ করে আল্লাহ তথা প্রভুর দরবারে কবির ভাষায় বলতে হয়- ‘প্রভু তব দয়া দিয়ে হবে আমার জীবন ধুতে, নইলে কীগো পারব তব চরণ ছুঁতে’ এই আকুতি নিয়ে মাইজভান্ডারী ভক্তরা দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে চলেছেন মাইজভান্ডার অভিমুখে।