আল্লামা শফীপন্থিদের অভিযোগ হেফাজতকে ‘ভুলপথে ঠেলছেন’ বাবুনগরী

6

আলেমদের ‘সরলতার সুযোগে’ একটি মহল তাদের ‘ভুলপথে ঠেলে দেওয়ার পাঁয়তারা’ করছে বলে অভিযোগ করেছেন ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজত ইসলামের আহমেদ শফীপন্থি নেতারা। হেফাজতের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরী ‘নিয়ম বহির্ভূতভাবে’ আহŸায়ক কমিটি করে আলেম-উলামাদের ‘নতুন করে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে’ ফেলতে চাইছেন বলেও গতকাল বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে তারা অভিযোগ করেন। ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলনে হেফাজত ইসলামের সাবেক আমির আহমেদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীও উপস্থিত ছিলেন। ‘শাইখুল ইসলাম শহীদ আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ভক্তবৃন্দ’ ব্যানারে এই সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান শফির কমিটির নেতা নুরুল ইসলাম জাদিদ।
মধুপুরের পীর আব্দুল হামিদ, আবুল কাসেম, আব্দুর রশিদ মজুমদার, খোরশেদ, জাকরুল্লাহ খান, শরীফ বিন আব্দুল কুদ্দুস, ফয়েজ উল্লাহ, আবুল হাসানাত আমিনী, মাঈনুদ্দিন রুহী ও আলতাফ হোসেন ছাড়াও আহমদ শফির শ্যালক মো. মহিউদ্দিন উপস্থিত ছিলেন সংবাদ সম্মেলনে। খবর বিডিনিউজের।
নুরুল ইসলাম জাদিদ বলেন, একটি মহল ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশের আলেম সমাজকে ভুলপথে ঠেলে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। ওলামায়ে কেরামের সরলতার সুযাগে তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার অপচেষ্টায় লিপ্ত।
শফির মৃত্যু নিয়ে হেফাজতের এ অংশের প্রশ্নের বিষয়টি আবারও সামনে এনে তিনি বলেন, একশর বেশি বয়সী শাইখুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ইন্তেকাল স্বাভাবিক হবে এটাই ছিল সবার প্রত্যাশা। কিন্তু আসলেই কি তাই হয়েছিল?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে চিত্র দুনিয়াবাসীর সামনে এসেছে, তাতে কি বলা যায় তার স্বাভাবিকমৃত্যু হয়েছে? আমরা মনে করি, শাইখুল ইসলামের শাহাদাতের বিষয়ে প্রকৃত অবস্থা উদঘাটনে ওলামায়ে কেরামের এগিয়ে আসা দরকার। তা না হলে বাংলাদেশে ইসলামের ভবিষ্যত অন্ধকার।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হাটহাজারীর বড় মাদ্রাসার দীর্ঘদিনের মহাপরিচালক আহমদ শফী, যার নেতৃত্বে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল।
মৃত্যুর আগের দিন মাদ্রাসায় তুমুল হট্টগোলের মধ্যে শফী মহাপরিচালকের পদ ছাড়তে বাধ্য হন। তার ছেলে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক আনাস মাদানিকেও বহিষ্কার করা হয়।
পরে ১৫ নভেম্বর শফীর অনুসারীদের বিরোধিতার মধ্যেই হেফাজতে ইসলামের সম্মেলন হয়, তাতে সাবেক মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমির করে হেফাজতের ১৫১ সদস্যের নতুন কমিটি গঠিত হয়।
নতুন ওই কমিটি গঠনের ছয় মাস না যেতেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকেন্দ্রিক বিক্ষোভ থেকে হেফাজতের নেতাকর্মীরা সারা দেশে তাÐব চালায়। বিক্ষোভ ও হরতালে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রামে সহিংসতায় বেশ কয়েকজন নিহত হয়।
এসব ঘটনায় অর্ধশত মামলার পর হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হকসহ ডজনখানেক নেতাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হচ্ছে।
পুলিশের দাবি, হেফাজত নেতারা নাশকতার বড় ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছিলেন, যার চ‚ড়ান্ত লক্ষ্য ছিল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল।
এ পরিস্থিতির মধ্যে এপ্রিলের শেষ দিকে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেন সংগঠনের আমির জুনাইদ বাবুনগরী। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তার মামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর নেতৃত্বে হেফাজতের ৫ সদস্যের আহŸায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়, যেখানে জুনাইদ বাবুনগরীও সদস্য হিসেবে আছেন।
শফীর মৃতুর ঘটনায় তার শ্যালকের করা মামলায় পিবিআই গত ১২ এপ্রিল যে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে, সেখানে বাবুনগরীসহ ৪৩ জনের ‘দায়’ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে।
পিবিআই এর ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেছেন, আসামিরা ‘বেপরোয়া আচরণের মাধ্যমে’ আহমদ শফীর মৃত্যু ত্বরান্বিত করেছেন।
সেই প্রসঙ্গ টেনে নুরুল ইসলাম জাদিদ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জীবনের শেষ মুহূর্তে মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে (শফী) অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি, রুমের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল, এসি-ফ্যানসহ আসবাবপত্র ভাঙচুর করা হয়েছিল।
আহমদ শফীকে পদত্যাগে ‘বাধ্য করা হয়েছিল’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, চাপাতি, রামদা, লাঠি, দেশীয় অস্ত্রে সজ্জিত চরম ও উগ্রপন্থীদের দিয়ে তাÐব চালানো হয়েছিল। হাটহাজারি মাদ্রাসায় একটি চরমপন্থি উগ্রগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সহজ-সরল ছাত্রদের উসকানি দেওয়া হয়েছিল।
জুনাইদ বাবুনগরী গতবছর ২৩ ডিসেম্বর হাটহাজারি মাদ্রাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, শফীর ‘স্বাভাবিক’ মৃত্যু হয়েছে। তার সেই দাবিকে ‘মিথ্যাচার’ আখ্যায়িত করেন নুরুল ইসলাম জাদিদ।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, আহমদ শফীর চরম বিরোধী ও বিদ্বেষীদের দ্বারা যিনি হেফাজতের কথিত আমির হয়েছিলেন, তাকে এদেশের ধর্মপ্রাণ জনগণ মেনে নিতে পারেনি। যে কারণে তিনি জনরোষ থেকে বাঁচার জন্য তথাকথিত ওই অবৈধ কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন।
আমরা মনে করি, কথিত হেফাজত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একটি পকেট কমিটি গঠিত হয়েছিল। যেখানে আহমদ শফির মূল অনুসারী হেফাজতের প্রতিষ্ঠাতা নেতৃবৃন্দকে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
নুরুল ইসলাম জাদিদ বলেন, গঠনতন্ত্রে না থাকলেও এককভাবে তিনি (বাবুনগরী) নিয়ম বহির্ভূত পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি আহŸায়ক কমিটি গঠন করে নতুনভাবে আলেম-উলামা ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ষড়যন্ত্রের ফাঁদে নিপতিত করার পাঁয়তারা করছেন। এটি হেফাজতের কোনো আহŸায়ক কমিটি নয় বরং মামা-ভাগ্নের ফটিকছড়ি পকেট কমিটি।
অচিরেই ‘নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে’ হেফাজতে ইসলামের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সব জেলা, থানা, শহর ও নগর কমিটিগুলো নবায়ন করে কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি ঘোষণা করার কথা বলা হয় শফীপন্থিদের এ সংবাদ সম্মেলনে।
নুরুল ইসলাম জাদিদ বলেন, আজ মাহফিল বন্ধ, মাদ্রাসাগুলো বন্ধ ও সরকারি নজরদারির আওতায়, আন্দোলনের নামে নিজেদের নেতা হওয়ার খায়েশে ইসলামকে আজ বিপদের মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে।
অথচ আহমদ শফীও আন্দোলন করেছেন। আবার তিনি স্বকীয়তা বজায় রেখে সরকারের কাছ থেকে ইসলামের অনেক দাবি-দাওয়া আদায় করে দেশের মুসলমানদের মাথা উঁচু করেছেন। তিনি কারো কাছে মুচলেকা দিয়ে আন্দোলনের ভূমিকাকে কোনোকালেই খাটো করেননি।
আহমদ শফীর মৃতুর ঘটনায় করা মামলায় পিবিআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে, অবিলম্বে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।