আল্লামা ফারুকী হত্যাকান্ডের বিচার প্রয়োজন সরকারের আন্তরিকতা

303

জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের তিনদশক পূূর্তি উপলক্ষে গেল বছরে এপ্রিলে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, ‘মানবাধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি গোলযোগপূূর্ণ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সেনাদের ভূমিকা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি কোনো মিশনে গেলেই উদাহরণ সরূপ বাংলাদেশের সেনাদের কথা বলি।’ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের প্রশংসা অর্জন আমাদের জন্য সত্যিকার অর্থেই গৌরবের। গত বছরের ফেব্রæয়ারির শুরুতে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশ এখন জাতিসংঘে শান্তিরক্ষী জোগানে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক এলাকায় শান্তি রক্ষার কাজে নিয়োজিত থেকেছেন। সেন্ট্রাল আফ্রিকার দেশগুলো, কঙ্গো, সুদানের দারফুরসহ কঙ্গোর বুনিয়া, ইটুরি প্রদেশে কাজ করেছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। যথার্থ কারণেই শান্তি রক্ষায় জাতিসংঘে বাংলাদেশকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে সন্মানের চোখে দেখা হয়। এ তো গেলো বিশ্ব পরিমন্ডলে বাংলাদেশের সেনাদের সাফল্যগাঁথা। এবার আসা যাক জাতীয় পর্যায়ে। আলোকিত সমাজ গড়ার প্রথম অন্তরায় মাদকাসক্তি। এ অভিশাপ থেকে প্রজন্মকে মুক্ত করতে চলমান রয়েছে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান। এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীরা যত প্রভাবশালীই হোক, কাউকে ছাড় দেয়া হবেনা।

মাদকবিরোধী লড়াইয়ে ইতোমধ্যে দেড় শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার লোককে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের মতো মাদক নির্মূল কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নকে সরকার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে’। এদিকে ২০১৬ সালের ১ জুলাই বাংলাদেশে ঘটে গেল সর্বকালের ভয়াবহ জঙ্গি হামলা। গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা পরবর্তী সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্রমাগত অভিযানে জঙ্গি নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে পড়েছে বলে মতব্যক্ত করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। মন্ত্রী বলেন, ‘হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলা বাংলাদেশের জন্য একটি টার্নিং পয়েন্ট ছিল। ওই ঘটনার পর আমরা অনেকটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তবে আমরা দ্রæতই পরিস্থিতি রিকভার করেছি। পরবর্তী সময়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে একের পর এক জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে। এসব অভিযানে সব জঙ্গি নেটওয়ার্ক ভেঙ্গে গেছে। এখন জঙ্গিরা কার্যত পঙ্গু হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী জিরো টলারেন্স নীতিতে সন্ত্রাসীদের নির্মূল করা গেছে।’ প্রিয় পাঠকমহল এতটুকুতে হয়তো আপনারা স¤প্রতি বাংলাদেশের প্রশাসনের শক্তিমত্তা সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা পেয়েছেন। এতে যদি বুঝতে কষ্ট হয়, একটু পেছনে চলুন। গত ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর দৈনিক জনকন্ঠ প্রধানমন্ত্রীর আইটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস প্রকাশ করে। ঐ পোস্টে তিনি দাবি করেন, স¤প্রতি সংঘটিত হত্যাকাÐ ছাড়া আলোচিত সব হত্যা মামলায় অপরাধীরা গ্রেপ্তার হয়েছে। নিজের দাবির পক্ষে আলোচিত কয়েকটি মামলার সর্বশেষ অবস্থা তালিকা আকারে প্রকাশ করেছেন তিনি। ফেইসবুকে এক পোস্টে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয় লেখেন, ‘আমাদের আওয়ামী লীগ সরকার শুধু স¤প্রতি কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া হত্যাকাÐ ছাড়া বøগার, শিশু ও বিদেশিসহ প্রতিটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডের ঘটনায় অপরাধীদের গ্রেপ্তার করেছে। যারা বলছিলো সরকার অপরাধীদের ধরছে না এবং কিছুই করছে না তারা সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে এসেছেন।’ জয় বলেছেন, ‘বøগার রাজীব হায়দার হত্যায় ছয়জন, অভিজিৎ রায় হত্যায় সাতজন, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ওয়াশিকুর রহমান বাবু হত্যায় তিনজন, বøগার অনন্ত বিজয় দাশ হত্যায় চারজন, নীলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় নীলয় হত্যায় চারজন, চেজারে তাভেল্লা হত্যায় পাঁচজন, কুনিও হোসি হত্যাকাÐে দুইজনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া সিলেটে শিশু রাজন হত্যায় ১১ জন, খুলনায় শিশু রাকিব হত্যায় তিনজন, পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খিজির খান হত্যায় দুজন এবং ঈশ্বরদীতে ফাদার লুক সরকারকে হত্যাচেষ্টায় ছয়জনকে আটক করা হয়েছে।’ এমন সব তথ্য যখন আমাদের সামনে আসে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস পাই। যে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করতে প্রশাসনের একটুও বেগ পেতে হয়নি সে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে! (সরকারের ভাষ্যমতে)। এ কথা বুঝতে আর বাকি নাই যে প্রশাসন জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন, মাদকবিরোধী অভিযান, দুর্নীতি দমনের মত কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সফল হয়েছে সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা ছিল বলে। জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ যখন বিশ্ব সভায় সংবর্ধিত হচ্ছে, ঠিক সে মুহূর্তে ২০১৪ সালের ২৭ আগস্ট নির্মমভাবে শহীদ হওয়া জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আল্লামা শায়েখ নুরুল ইসলাম ফারুকী হয়তো পরপারে মুচকি হাসছেন! তিনি হয়তো বলছেন, ‘দেশে জঙ্গিদের মদদদাতা কারা তা তো আমার হত্যাকাÐ দিবালোকের মত পরিষ্কার করে দিয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার না করে দেশে দেশে জঙ্গি খুঁজলে পাওয়া যাবে ?’ উনার লক্ষ লক্ষ ভক্ত, অনুরক্ত এবং মিডিয়ায় উনার দর্শকদের বক্তব্য হচ্ছে, ইসলামের অবিকৃত দর্শন আহলে সুন্নাত ও সুফিবাদের প্রচারক ছিলেন আল্লামা নুরুল ইসলাম ফারুকী। মানবতার ধর্ম ইসলাম, সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি ও সহাবস্থানে বিশ্বাসী ইসলামের সফল গবেষক ও আলোচক ছিলেন হাইকোর্ট মসজিদের খতিব শহীদ আল্লামা ফারুকী। তিনি মিডিয়া ও মঞ্চ প্রোগ্রামে মদিনার সনদের ভিত্তিতে সংখ্যালঘুদের অধিকারসহ সকল সম্প্রদায় ও বর্ণের মানুষের সমতা ভিত্তিক অধিকার বর্ণনা ছিল তার আলোচনার অন্যতম বিষয়বস্তু। তাঁর বক্তব্য ও লিখুনিতে সমাজে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, হানাহানি সৃষ্টিকর কোন বার্তা পাওয়া যায়না। তিনি দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে প্রাণের ভয় না করে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর গবেষণালব্ধ কর্মকাÐ তাঁকে দেশের গÐি পেরিয়ে পৌঁছে দিয়েছে আন্তর্জাতিক পরিমÐলে। জেদ্দা বিমানবন্দর মসজিদের ইমামতিসহ বিশ্বের প্রায় মুসলিম দেশে সফর করে তিনি শুধু মাজহাব মিল্লাত প্রচার করেননি, বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল করেছেন। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন ও কর্ম বিশ্লেষণ করলে তাঁকে একজন অকৃত্রিম দেশপ্রেমিক হিসেবে পাওয়া যাবে। ফারুকী একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তাঁর সম্পূর্ণ জীবন ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের পক্ষে। যারা দেশ জাতি ও মানবতার শত্রæ, আল্লামা নুরুল ইসলাম ফারুকী ছিলেন তাদের জন্য শানিত তলোয়ার। তাহলে এ কথা দিনের আলোর মত স্পষ্ট যে আল্লামা ফারুকীর হত্যাকারীরা শুধু ফারুকীর শত্রæ নয়, তারা দেশ, জাতি ও মানবতার চরম শত্রু। তা সত্তে¡ও কোন অজ্ঞাত কারণে দেশের এ সূর্য সন্তানের হত্যাকারীরা হত্যাকাÐের পাঁচ বছর পরেও অধরাই। ১৪ সালের ২৭ আগস্টের বেদনাবিধুর সেই রাতে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ২৪ ঘন্টার মধ্যে হত্যাকাÐে জড়িতদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলেও পাঁচবছরেও ফারুকী হত্যা মামলার কার্যত কোন অগ্রগতি হয়নি। ঢাকা মহানগর ছাত্রসেনার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক (বর্তমান কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক) ইমরান হুসাইন তুষার বাদী হয়ে হত্যাকাÐে জড়িত সন্দেহভাজন কয়েকজন মিডিয়া উপস্থাপকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু প্রশাসন একজনকেও গ্রেপ্তার তো করেইনি কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যও ডেকে পাঠাননি। পক্ষান্তরে আল্লামা ফারুকী হত্যাকাÐের পর সরকারের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিচক্ষণতায় দেশে বড় বড় অপারেশনে সফল হয়েছে প্রশাসন। যা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যদি জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনের মত কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারে। দেশের সাবেক ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করতে পারে, প্রধানমন্ত্রীর কটূক্তিকারীকে মুহূর্তের মধ্যে ধরতে সক্ষম হয়, তাহলে আল্লামা ফারুকী হত্যাকারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে কেন ? ফারুকী হত্যাকারীরা কী সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতাধর, হত্যাকারীদের ধরতে প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাব, নাকি মুখে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বলে গোপনে জঙ্গিদের সাথে প্রশাসনের আতাত রয়েছে ? তা স্পষ্ট করা সময়ের দাবি। শিশু রাজন হত্যার বিচার যদি বছরান্তে তার পরিবার পেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী পুত্রের দাবি অনুযায়ী বøগারদের হত্যাকারী, বিদেশীদের হত্যাকারী, শিশু হত্যাকারীদের প্রশাসন গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হলে। যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী, দেশের সম্পদ আল্লামা ফারুকীর হত্যাকারীদের ধরতে অক্ষমতা কোথায় ? প্রশ্ন প্রশাসনের কাছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জানেন স্বজন হারানোর ব্যাথা কত তীব্র। আপনি দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে এ যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। আপনার পিতা হত্যার বিচার করে আপনি যোগ্য সন্তানের দৃষ্টান্ত রেখেছেন। ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের আলোচনায় আপনার কান্না আমাদের নতুন করে আশা জাগাচ্ছে। আপনার যেমন বঙ্গবন্ধুর কথা মুখে আনতেই চোখ ভিজে যায়। শহীদে মিল্লাতকে নিয়ে এ প্রবন্ধ যখন লিখছি আমারও তেমন অশ্রæধারা বইছে। না শুধু আমার নয়, সুফিবাদে বিশ্বাসী মানবতাবাদী কোটি ফারুকী প্রেমিকের আর্তনাদ। সরকার আন্তরিক হয়ে অসাধ্য সাধন করছে। ফারুকী হত্যার বিচারেও আন্তরিকতা চাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোটি ফারুকী ভক্তের স্বজনহারা আহাজারি আপনি একটু মমতার কানে শুনবেন কী ? আপনি একজন মজলুম, শত নির্যাতনের শিকারে জর্জরিত। আল্লামা ফারুকীও মজলুম। আমরা জানি, আপনি মানবতার ধর্ম ইসলামের অনুসারী, সুফিবাদে বিশ্বাসী। আপনি আল্লামা ফারুকী হত্যার বিচারে আন্তরিক হলে কোন অপশক্তি তা ব্যাহত করতে পারবে না। বরাবরের মতো আবার আপনার প্রতি শোকাহত হৃদয়ের বিনীত অনুরোধ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনি জঙ্গি ও সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গড়তে চাইলে আল্লামা ফারুকী হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারপূর্বক বিচারের আওতায় আনুন। তাতেই বেরিয়ে আসবে কারা জঙ্গিবাদের মূল হোতা। মনবতাবাদী, মমতাময়ী প্রধানমন্ত্রী, আপনি আন্তরিক হলে কোটি হৃদয়ের কান্না থামবে। ফারুকী হত্যার বিচার হলে দেশ চিনবে দেশদ্রোহী, শান্ত হবে কোটি সুন্নি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী