আলো ছড়ানোর আগেই অন্ধকারে প্রকল্প

60

ওয়াসিম আহমেদ

সোডিয়াম লালচে বাতির আলো থেকে এলইডি বাতির ধবধবে সাদা আলোর যুগে প্রবেশ করেছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। অল্প পরিসরে এলইডি বাতি প্রতিস্থাপিত হলেও মোটাদাগে পরিবর্তন আসেনি। তিন বছর আগে ভারত সরকারের এলওসির (লাইন অব ক্রেডিট) প্রক্রিয়ায় ২৬১ কোটি টাকার ব্যয়ে এলইডি বাতি স্থাপনের অনুমোদন দেয় সরকার। এতে নগরজুড়ে ধবধবে সাদা আলো ছড়ানোর আশা জাগালেও দুই দেশিয় কাগুজে জটিলতা, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনায় বাস্তবায়নের আগেই অন্ধকারে ডুব দিচ্ছে প্রকল্পটি। প্রকল্পে এক দফা মেয়াদ শেষ, দ্বিতীয় দফা বর্ধিত মেয়াদে ঠিকাদার নিয়োগ করেও পুনঃদরপত্র আহব্বানের সিদ্ধান্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে চসিক।
বিষয়টি নিশ্চিত করে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক পূর্বদেশকে জানান, দরপত্র আহব্বান ও ঠিকাদার নিয়োগে নিয়মগত অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় মেয়র মহোদয়ের অনুমোদনক্রমে পুনঃদরপত্র (রি-টেন্ডার) আহব্বানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তের অনুমোদিত রেজুলেশন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, প্রকল্পটি ভারতীয় অর্থায়নে তাই মন্ত্রণালয়ভিত্তিক সিদ্ধান্তের বিষয় রয়েছে। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান রফিকুল ইসলাম মানিক।
জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী ভারতের এক্সিম ব্যাংক তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শর্ট লিস্ট পাঠায়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ‘এনার্জি ইফিসিয়েন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড’, ‘সিগনিফাই ইনোভেশন্স ইন্ডিয়া লিমিটেড’ এবং ‘শাপর্জি পালনজি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড’। একইভাবে বাংলাদেশের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয় প্রকল্পের জন্য। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- ‘ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেড’, ‘এইচটিএমএস লিমিটেড’ ও ‘ফটো স্টার লিমিটেড’। শর্ট লিস্টের প্রতিষ্ঠানগুলো দরপত্রে অংশ নেয়। বাছাই শেষে ভারতীয় একটি ও বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান চ‚ড়ান্ত করা হবে। যারা যৌথভাবে কাজ করবে। নিয়ম অনুযায়ী একই ব্যক্তির মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। তবে শর্ট লিস্টে থাকা বাংলাদেশের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেড ও এইচটিএমএস লিমিটেড এর সঙ্গে একই ব্যক্তির সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চসিকের বিভিন্ন নথিপত্রে এইচটিএমএস লিমিটেড এর পরিচালক হিসেবে প্রকৌশলী মো. মাহবুব হোসাইন এর নাম রয়েছে। আবার ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও তার নাম রয়েছে।
এ ঘটনায় গত ২৩ জানুয়ারি কারণ দর্শানো নোটিশ দেয়া হয় বিদ্যুৎ বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশকে। প্রধান প্রকৌশলী স্বাক্ষরিত এ নোটিশ সূত্রে জানা গেছে, খন্ডিত নথি উপস্থাপন করে ফাইল গোপন রেখেছেন পরিচালক। ফলে প্রকল্পের কারিগরী ও আর্থিক প্রস্তাবনা মূল্যায়নে জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং পিপিআর বিধি লঙ্ঘন হয়েছে বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়। এমনকি দরপত্র উন্মুক্ত করণ কমিটি (টিওসি) গঠনের প্রস্তাবনাও নথিতে উপস্থাপন করেনি বলে নোটিশে উল্লেখ রয়েছে।
প্রকল্পটির পরিচালককে শোকজের বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম মানিক বলেন, ‘অনিয়ম সম্পাদিত হয়েছে তাই শোকজ করা হয়েছে। শোকজের (কারণ দর্শানোর নোটিশ) জবাব সন্তোষজনক নয়, তাই ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। বিষয়টি সরাসরি মেয়র মহোদয় মনিটরিং করছেন, তাই পরবর্তী বিভাগীয় ব্যবস্থার বিষয়টিও তিনি সিদ্ধান্ত দিবেন।’
এদিকে প্রকল্পটির পরিচালক চসিকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) ঝুলন কুমার দাশ পূর্বদেশকে জানান, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সিটি করপোরেশন এলাকায় আলোকায়নে বিশাল পরিবর্তন আসবে। বিদ্যুৎ উপ-বিভাগে এটিই সর্ববৃহৎ প্রকল্প। তাই একটু গোছাতে সময় লাগছে। তাছাড়া ভারতীয় অর্থায়ন ও আমাদের মন্ত্রণালয়ে যৌথ ব্যবস্থাপনায় বাস্তবায়িত হচ্ছে প্রকল্পটি। মৌখিকভাবে সিদ্ধান্ত হলেও পুনঃদরপত্র আহব্বানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে শীঘ্রই প্রকল্পের কাজ শুরু করার বিষয়ে বেশ আশাবাদী প্রকল্পের পরিচালক ঝুলন কুমার দাশ।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ‘মর্ডানাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্ট এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ শীর্ষক প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২৬০ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে এলওসির (লাইন অব ক্রেডিট) আওতায় ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ অর্থের যোগান দেবে ভারত। ঋণ হিসেবে দেয়া এ অর্থের পরিমাণ ২১৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ বা ৪৬ কোটি ৪৩ লাখ ৫ হাজার টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার।
জানা গেছে, ২০১৯ সালের ৯ জুলাই একনেক সভায় এই প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হলে সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিল কমে আসবে প্রায় অর্ধেকে। এছাড়াও বাতি নিয়ন্ত্রণের ৫শ সুইচের বদলে হবে মাত্র ৪টি কেন্দ্রীয় সার্ভার স্টেশন। এতে সাশ্রয় হবে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টাকা। সিটি কর্পোরেশন সূত্র আরও জানিয়েছে, নগরীতে মোট ১ হাজার ৪৩ কিলোমিটার সড়কে বাতি রয়েছে। তারমধ্যে সোডিয়াম বাতি রয়েছে ৮৯০ কিলোমিটার এবং এলইডি বাতি রয়েছে ১৫৩ কিলোমিটার।
এদিকে অনুমোদিত প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৪৬৭ কিলোমিটার সড়কে সোডিয়াম বাতির বদলে বসানো হবে এলইডি বাতি। তবে ওই সরানো সোডিয়াম বাতিগুলো নগরীর অবশিষ্ট সড়ক ও নতুন আবাসিকে সংযোজন করা হবে। ফলে নগরীর সবকটি সড়কে বসবে বাতি। এমনটাই মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সূত্রে জানা গেছে, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন এলাকার সড়ক আলোকায়ন ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন কাজ’ শীর্ষক এ প্রকল্পের আওতায় ৪০, ৬০, ৯০, ১০০ ও ২৫০ ওয়াটের ২০ হাজার ৬০০টি এলইডি বাতি এবং ২০ হাজার ২৬৭টি জিআই পোল বসানো হবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের গৃহীত এ প্রকল্পের আওতায় ৪১ ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ১০ কিলোমিটার এলইডি লাইট লাগানো হবে। অন্যদিকে নগরীর আলোকায়নে প্রায় ৫১ হাজার ৫৭৩টি সোডিয়াম বাতি রয়েছে। বিভিন্ন মসজিদ, মন্দির ও সামাজিক সংগঠন কার্যালয়ের ১ হাজার ৫৩৪টি সুইচিং পয়েন্ট থেকে এই বাতিগুলো ‘অন-অফ’ করা হত। এ কাজে প্রত্যেক পয়েন্টে নিয়োজিত আছেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের একজন করে মোট ১ হাজার ৫৩৪ জন ইমাম, মুয়াজ্জিন ও পুরোহিত। তাদের প্রত্যেককে ২ হাজার ৫শ’ টাকা করে সম্মানি প্রদান করে আসছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এমন সুইচ কমে আসবে প্রায় ৫০০টি। ফলে সিটি কর্পোরেশনের সাশ্রয় হবে সাড়ে ১২ লাখ টাকা।
জানা যায়, স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে বাতিগুলোর সুইচ নিয়ন্ত্রণ করা হবে। যার জন্য স্থাপন করা হবে ৪টি কেন্দ্রীয় সার্ভার স্টেশন। যেখান থেকে সহজেই ‘অন-অফ’ ও কমানো-বাড়ানো যাবে। এছাড়াও প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরবর্তী পাঁচ বছর পর্যন্ত সকল ধরনের ব্যবস্থাপনা খরচ বহন করবে বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
জানা গেছে, বর্তমানে ৪০ ওয়াট টিউব বাতি (ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্প), ৬৫ ওয়াট এনার্জি বাতি (সিএফএল), ১৫০ ওয়াট হাইপ্রেসার সোডিয়াম, ৪০০ ওয়াট মেটাল হ্যালাইড বাতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলোতে বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ অপচয় হয় এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডও বৃদ্ধি করে। যা শহরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে ট্রফিক এবং পথচারীদের জন্য কার্যকর ও টেকসই সড়ক বাতির আলোক সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। রাত্রিকালীন শহরের সৌন্দর্য, ব্যবসায়িক সুবিধা, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে। একইসঙ্গে কম কার্বন নির্গমণ এবং শক্তি শোষণ সম্পর্কিত পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ট্রাফিক ও পথচারীর জন্য স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে সড়ক বাতির আলো নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।