‘আলোকবর্তিকা তুমি, তুমিই বাংলাদেশ’

77

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তনয়া। গণতন্ত্রের মানস কন্যা, জননেত্রী, দেশরত্ন, ভাষাকন্যা, শান্তিদূত, মাদার অব হিউম্যানিটি নানা বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয় তাঁকে। তবে পুরনো দিনের মানুষেরা একান্ত আপন ভেবে নিজের মত করে ডাকেন ‘শেখের বেটি’। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বিজয় অর্জনের অর্ধশতকের দ্বারপ্রান্তে এসে আজ বাংলার মানুষের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথ প্রদর্শক হয়ে উঠেছেন তিনি। ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, ‘সব বিকল্পে বিকল্প আছে, এখন শেখ হাসিনার কোন বিকল্প নেই’। এটি বলার কারণ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যথার্থভাবে। যে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে বিদ্রুপ করা হয়েছিল, সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল। অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ বহুমাত্রিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পেছনে চালকের আসনে আছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। এখন শেখ হাসিনা একটি নাম নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। কর্মবহুল বৈচিত্র্যে ভরপুর শেখ হাসিনার জীবন। ‘হাসিনা এ ডটারস টেল’ মুভিটি যারা দেখেছেন তাঁরা হয়তো বঙ্গবন্ধুর ছোট কন্যা শেখ রেহেনার একটি সংলাপ লক্ষ্য করেছেন। তিনি যথার্থ বলেছেন, ‘মাকে যদি বলতে পারতাম তোমার হাসু আর আলসে ঘরের মেয়ে নেই, যে মেয়েটা নাকি গল্পের বই পড়ে, গান শুনে দিন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিল, সেই মেয়েটিই এখন বাঙালি জাতির পরিত্রাণ কর্তা, বাঙালি জাতির বিকল্পহীন অবলম্বন’। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধু ও ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের জৈষ্ঠ্য কন্যা শেখ হাসিনা। অসাধারণ মানুষ হয়ে সাধারণ জীবনযাপনের পাঠ নিয়েছেন রাজনীতিবিদ পিতার কাছ থেকে। রক্তের উত্তরাধিকার সূত্রেই মনোজগতের ভাবনায় ছিল বাঙলা ও বাঙালির অধিকার শোষণ মুক্তির কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী থাকাকালীন রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রজীবন থেকেই সকল গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে স্বপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পর ছয় বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে তিনি স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দীর্ঘ একুশ বছর স্বৈরাচার ও সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন তিনি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। অনেকেই কল্পনা করেননি এদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে। শেখ হাসিনা সেই কল্পনাকে মিথ্যা প্রমাণিত করেন। ১৯৯৬ সালের ২ নভেম্বর ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ রহিতকরণ’ বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। ১৪ নভেম্বর মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরের পর বিলটি আইনে পরিণত হয়। ফলে বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের মাধ্যমে জারি হওয়া অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ প্রশস্ত হয়। এই বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হয়।
শেখ হাসিনার চলার পথ কখনও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। সামরিক ও স্বৈরশাসকরা তাঁকে ঘরে-বাইরে অন্তরীণ করেছেন বারে বারে। জীবন মৃত্যুর নিত্য লড়াইয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন অবিরত। ১৯৮৩ সালের ১৫ ফেব্রূয়ারি সামরিক সরকার তাঁকে আটক করে ১৫ দিন অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৪ সালের ফেব্রূয়ারি এবং নভেম্বর মাসে তাঁকে দু’বার গৃহবন্দি করা হয়। ১৯৮৫ সালের ২ মার্চ তাঁকে আটক করে প্রায় ৩ মাস গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর থেকে তিনি ১৫ দিন গৃহবন্দি ছিলেন। ১৯৮৭ সালের ১১ নভেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করে এক মাস অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ ফেব্রূয়ারি শেখ হাসিনা গ্রেফতার হয়ে গৃহবন্দি হন। ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই সেনাসমর্থিত তত্ত্বাধায়ক সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে সংসদ ভবন চত্বরে সাবজেলে পাঠায়। প্রায় ১ বছর পর ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তিলাভ করেন। তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে উল্লেখযোগ্য হামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে, ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে পুলিশের গুলিবর্ষণ। এতে যুবলীগ নেতা নূর হোসেন, বাবুল ও ফাত্তাহ নিহত হন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে স্বৈরশাসক এরশাদের পুলিশ বাহিনী গুলিবর্ষণ করে। এ ঘটনায় শেখ হাসিনা অক্ষত থাকলেও ২৪ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শহিদ হন। লালদীঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাঁকে লক্ষ্য করে ২ বার গুলিবর্ষণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে ঈশ্বরদী রেল স্টেশনে তাঁর কামরা লক্ষ্য করে অবিরাম গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০০০ সালে কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাডে এবং জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দু’টি বোমা পুঁতে রাখা হয়। শেখ হাসিনা পৌঁছার পূর্বেই বোমাগুলো সনাক্ত হওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তাঁর উপর সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা হয় ২০০৪ সারের ২১ আগস্ট। ঐদিন বঙ্গবন্ধু এভিন্যুয়ের জনসভায় বক্তব্য শেষ করার পরপরই তাঁকে লক্ষ্য করে এক ডজনেরও বেশি আর্জেস গ্রেনেড ছোঁড়া হয়। লোমহর্ষক সেই হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে রক্ষা পেলেও আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ নেতাকর্মী নিহত হন এবং ৫শ’র বেশি মানুষ আহত হন। শেখ হাসিনা নিজেও কানে প্রচন্ড আঘাত পান। শত বাধা-বিপত্তি এবং হত্যার হুমকিসহ নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে শেখ হাসিনা ভাত-ভোট এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অবিচল থেকে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তাঁর অপরিসীম আত্মত্যাগের ফলেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।
আমরা কোথায় ছিলাম, শেখ হাসিনা আমাদের কোথায় নিয়ে এসেছেন। মূল্যায়নের সময় এসেছে আজ। যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয় তখন গড় আয়ু ছিল ৩৬। এখন গড় আয়ু ৭২ বছর। যখন স্বাধীন হয় তখন মাথাপিছু আয় ছিল কয়েকশ ডলার, এখন তা ২০৬৪ ডলার। প্রাথমিক স্কুলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৯৩% এর কাছাকাছি। প্রসূতি মৃত্যু দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে বাংলাদেশে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নারীদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে বাংলাদেশ প্রথম। বস্ত্র রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয়। ছাগ মাংস উৎপাদনে পঞ্চম, চামড়া উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে সপ্তম। ১৯৭১ সালে দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল না। এখন জমির পরিমাণ ১৯৭১ সাল থেকে কমপক্ষে ২০ ভাগ হ্রাস পেয়েছে কিন্তু খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ। গ্রাম হবে শহর স্লোগানে গ্রামে নগরায়নের ছোঁয়া লেগেছে। পদ্মা সেতু এখন দৃশ্যমান, মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে বঙ্গবন্ধু টানেলের কাজ শেষ পর্যায়ে। পায়রা গভীর সমুদ্র বন্দর, পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র, দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন উন্নয়নের পথে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। ৫৭তম দেশ হিসেবে আকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। অনুন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তর হয়েছি আমরা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ প্রথম, করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারী মোকাবিলা করে বর্তমানে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫.২৪%। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বাংলাদেশের অবস্থান সুদৃঢ় করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ঘাতকের কারণে কাজ শেষ করতে পারেননি। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা জল-স্থল ও অন্তরীক্ষ জয় করেছেন। তিনি বাংলাদেশের জল ও স্থল সীমা নির্ধারণ করেছেন। ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে বলব গত ১১ বছরে শেখ হাসিনা যা করেছেন, গত কয়েক শ বছরে আর কোন নেতা করতে পারেন নি। শেখ হাসিনা এখন শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বনেতা।
আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা তাঁর পিতৃপুরুষের জন্মস্থান কেনিয়া সফরে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কেনিয়া যেন বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে এই দুই দেশকে অনুসরণ করে।’ এটাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বের অসাধারণত্ব। গণতন্ত্র, শান্তি, উন্নয়ন ও অগ্রগতি, নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য দেশে-বিদেশে পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালে পেয়েছেন সাউথ সাউথ ভিশনারি পুরস্কার ও শান্তিবৃক্ষ, ২০১০ ও ২০১৩ সালে জাতিসংঘ পুরস্কার, ২০১৩ সালে রোটারি শান্তি পুরস্কার, ২০১২ সালে গোভি পুরস্কার, ২০১০ সালে ইন্দিরা গান্ধি শান্তি পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে পার্ল এস বার্ক পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে সিআরইএস মেডাল, ১৯৯৮ সালে এস কে গান্ধী পুরস্কার, ১৯৯৮ সালে মাদার তেরেসা শান্তি পুরস্কার লাভ করেছিল। পরিবেশ সংরক্ষণে পেয়েছেন ‘চ্যাম্পিয়ান অব দি আর্থ’ পদক। বিশ্বের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছেন সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি।
প্রতিক‚ল পরিবেশ, দীর্ঘ কন্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করেছেন শেখ হাসিনা। পৃথিবীর সর্বত্র আজ শেখ হাসিনা একটি আলোচিত নাম। তিনি অনেক কারণে বাঙালির জীবনে জরুরী আছেন, থাকবেন। বিশ্বসভা থেকে বাংলার গ্রামের প্রান্তিক মানুষের ভালোবাসাও তিনি অর্জন করেছেন। আমরা শুনেছি ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার গরিব রিকশাচালক হাসমত আলীর কথা। যিনি শেখ হাসিনার জন্য জমি কিনে রেখে যান। মৃত্যুর আগে হাসমত আলী তাঁর স্ত্রী রমিজা খাতুনকে শেষ ইচ্ছের কথা জানিয়ে গিয়েছিলেন। ২০১০ সালের ১০ এপ্রিল সকালে কালেরকণ্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক হায়দার আলীকে জড়িয়ে ধরে রমিজা খাতুন কাঁদলেন। বললেন, ‘মরার আগে কাদিরের বাবা (হাসমত আলী) জমির দলিলডা হাতে দিয়ে আমারে কইছিল, আমি মইরা গেলে আমার এতিম মাইডার কাছে (শেখ হাসিনা) জমির দলিলডা পৌঁছাই দিবি। আমি দলিলডা তাঁর হাতে দিয়ে যেতে পারলে মইরাও শান্তি পামু। পরবর্তীতে নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় জমিটি শেখ হাসিনা রমিজা খাতুনকে হস্তান্তর করে একতলা বাড়ি বানিয়ে দেন। এভাবে তিলে তিলে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি।
পাকিস্তানের জেল জুলুম নির্যাতন সহ্য করে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে এনে দিয়েছিলেন পরম অরাধ্য স্বাধীনতা। সেই স্বাধীন বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত করতে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবিভর্‚ত হয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ ৭৩ বছর পূর্ণ করলেন, ৭৪ বছরে পদার্পণ করেছেন। তিনি আমাদের কাছে স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদী চেতনার শব্দব্রহ্ম। লোকায়ত বাংলার ইহজাগতিকতার বীজমন্ত্র। কবির ভাষায় ‘আলোকবর্তিকা তুমি, তুমিই বাংলাদেশ’। শুভ জন্মদিনে শেখ হাসিনার শতায়ু প্রার্থনা হোক বাংলার ঘরে ঘরে।
লেখক : ইতিহাস বিষয়ক গবেষণাকর্মী