আলুটিলায় আলু নেই আছে অপার মুগ্ধতা

27

মনিরুল ইসলাম মুন্না, খাগড়াছড়ি থেকে ফিরে

চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়কের মাটিরাঙ্গা উপজেলা থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গেলে দেখা মিলবে রহস্যময় আলুটিলা গুহার। খাগড়াছড়ি শহরে যাওয়ার পথেই পড়বে এ গুহাটি। পর্যটকদের আকর্ষণীয় করতে জেলার কয়েকটি দর্শনীয় স্থানের মধ্যে এটি অন্যতম। আলুটিলার অপার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ পর্যটকরা।
উপজাতীদের সংস্কৃতির পাশাপাশি পাহাড়, ঝর্না, ঝিরি ও কৃত্রিম লেক সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময় জেলা খাগড়াছড়ি। দিনের পর দিন পাহাড়ের রানী খ্যাত খাগড়াছড়িতে ভিড় বাড়ছে পর্যটকদের। শীতের শুরু থেকে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত পর্যটকদের এমন উপচেপড়া ভিড় থাকে এখানে। যা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। পর্যটকরা বলছেন, পাহাড়ি বিভিন্ন এলাকায় নিরাপত্তা নিয়ে এখনও প্রশ্ন রয়েছে। নিরাপত্তা জোরদারে আরও কঠোর হতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের।
ট্যুরিস্ট পুলিশ জানিয়েছে, খাগড়াছড়ি পর্যটন এলাকা হওয়ায় এখানে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। পর্যটকরা নিঃসংকোচে ঘোরাফেরা করতে পারবেন। আর পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, শীত মৌসুমে খাগড়াছড়িতে প্রচুর পর্যটকের সমাগম হয় এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট অনেকের ভাগ্যদুয়ারও খুলে।
আফ্রিদা ট্যুর এন্ড ট্রাভেল্সের স্বত্বাধিকারি শোহরাব হোসেন সৌরভ জানান, ‘মাত্র পর্যটন মৌসুম শুরু হয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে সাজেক, আলুটিলা, রিছাং ঝর্নাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় পর্যটকদের আনা নেওয়া করেছি। এটা আগামী ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল পর্যন্ত চলতে পারে। আশা করি পর্যটন খাতে করোনাকালীন যে ক্ষতিটা হয়েছিল সেটার কিছুটা পুষিয়ে নেয়া যাবে।’
সরেজমিনে গত রবিবার খাগড়াছড়ি জেলার আলুটিলা গিয়ে পর্যটনের বিভিন্ন বিষয়ে জানা যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে খাগড়াছড়ি সদর থেকে জিপের (চাঁন্দের গাড়ি) মাধ্যমে রওনা দিলে দুপুর ১২টার দিকে আলুটিলায় গিয়ে পৌঁছাই। দেখা গেল, অন্য সময়ের তুলনায় এবার পর্যটকের চাপ বেড়েছে। টিকেট কিনতেও দেখা গেল লম্বা লাইন। প্রতিজনের টিকেট বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা দামে। ভেতরেও গাড়ির চাপ ছিল বেশি। পার্কিংয়ের জন্য কিছু জায়গা থাকলেও সেগুলো গাড়িতে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। এ পর্যটন কেন্দ্রে মূল গেটের পাশে দুটি শতবর্ষী বটবৃক্ষ। গেট পার হয়ে ঢুকতেই প্রথমে বাম পাশের রাস্তা দিয়ে হেটে দেখা গেল একটি বিশ্রামাগার ও ওয়াচ টাওয়ার। এখান থেকে খাগড়াছড়ি শহরের বেশ কিছুটা অংশ দেখা যায়। একটু এগিয়ে দূর থেকে দেখা গেল আলুটিলার গুহামুখ। পাকা রাস্তা শেষ করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে পাড়ি দিতে হল প্রায় ২৬৬টি সিঁড়ি। তারপরই দেখা গেল রহস্যময় গুহাটি।
কাছে যেতেই গা ছমছম করা পরিবেশ। সারা শরীর শীতল হতে লাগল। তবে সকলেই নিজ পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালাতে শুরু করল। গুহামুখটির ব্যাস প্রায় ১৭-১৮ ফুট। গুহাটি খুবই অন্ধকার ও শীতল। কোন ধরনের সূর্যের আলো প্রবেশ করে না। একেবারেই পাথুরে এ গুহা।
চলার পথে দেখা গেল গুহায় ওপরের দিক থেকে টিপটিপ পানি পড়ছে। নিচ দিয়ে বইছে ঝর্নার প্রবাহ। খুব সাবধানে পা ফেলে সামনে এগুতে হচ্ছে। সুড়ঙ্গের তলদেশ খুব পিচ্ছিল। জানা গেল গুহাটি একেবারেই নিরাপদ। দেখতে অনেকটা ভ‚গর্ভস্থ টানেলের মত, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ ফুট।
গুহার ভেতরে পানি জমে আছে, রয়েছে বড় বড় পাথর। গুহাটির উচ্চতা মাঝে মধ্যে এতটাই কম যে, কয়েক জায়গায় মাথা নিচু করে হামাগুড়ি দিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে। প্রায় ১৫-২০ মিনিট হাঁটার পর বাইরের সূর্যের আলো চোখে পড়ল। পরে আবার সিঁড়ি বেয়ে একটু ওপরে উঠে আগের পথ ধরে মূল গেটে আসা।
লোকমুখে শোনা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় খাগড়াছড়িতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে এখানকার জনগণ এ পর্বত থেকেই বুনো আলু সংগ্রহ করে তা খেয়ে বেঁচে ছিল। তারপর থেকে এ পর্বতটি আলুটিলা নামেই পরিচিতি লাভ করে। এখনও এখানে নাকি প্রচুর পরিমাণে বুনো আলু পাওয়া যায়।
স্থানীয় দোকানদার নুমংচিং মারমার সাথে কথা বলে জানা গেছে, এটি একটি প্রাকৃতিক গুহা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় আলুটিলা বা আরবারি পাহাড়ে আলুটিলা গুহা বা রহস্যময় সুড়ঙ্গটি অবস্থিত। স্থানীয়রা একে বলে মাতাই হাকড় বা দেবতার গুহা। এটি খাগড়াছড়ি জেলার সবচেয়ে উঁচু পর্বত। নামে এটি টিলা হলেও মূলত এটি একটি পর্বত শ্রেণি। বিশ্বে যতগুলো প্রাকৃতিক গুহা আছে আলুটিলা সুড়ঙ্গ বা গুহা তার মধ্যে অন্যতম।
নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে খাগড়াছড়ি ট্যুরিস্ট পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বিজন কুমার দাশ পূর্বদেশকে বলেন, খাগড়াছড়িতে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তায় নিয়মিত টহল রয়েছে। পাশাপাশি যারা বিভিন্ন স্পটের তথ্য চান তাদের তথ্যগত সহায়তা দেয়া হয়। সাজেকসহ জেলার সব কেন্দ্রে নজরদারি থাকায় পর্যটকরা এখানে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘোরাফেরা করতে পারেন।