আর. কে. নারায়ণ

2

আর. কে. নারায়ণ, একজন ভারতীয় লেখক। কাল্পনিক দক্ষিণ ভারতীয় শহর মালগুডির পটভূমিকায় লেখা তার রচনাগুলির জন্য তিনি সর্বাধিক পরিচিত। তার পুরো নামটি হল রাসীপুরম কৃষ্ণস্বামী আইয়ার নারায়ণস্বামী। ইংরেজি ভাষায় ভারতীয় সাহিত্যের প্রথম যুগের তিন জন পুরোধা ব্যক্তিত্বের অন্যতম ছিলেন নারায়ণ (অন্য দুজন ছিলেন মুল্ক রাজ আনন্দ ও রাজা রাও)। তারাই এই সাহিত্যকে বিশ্বে সুপরিচিত করে তুলেছিলেন।
নারায়ণ তার পরামর্শদাতা ও বন্ধু গ্রাহাম গ্রিনের সাহায্যে আত্মপ্রকাশ করেন। গ্রিনই তার প্রথম চারটি বইয়ের জন্য প্রকাশক সংগ্রহে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এই চারটি বইয়ের মধ্যে তিনটি আংশিক আত্মজীবনীমূলক বই স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস্, দ্য ব্যাচেলর অফ আর্টস্ ও দি ইংলিশ টিচার অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া তার অপর রচনা দ্য ফাইনান্সিয়াল এক্সপার্ট ১৯৫১ সালে অন্যতম সর্বাধিক মৌলিক রচনা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। তার অপর একটি রচনা দ্য গাইড বইটির জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন। এই বইটি অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় ও একটি ব্রডওয়ে নাটক মঞ্চস্থ হয়।
নারায়ণের গল্পগুলির অধিকাংশেরই পটভূমি মালগুডি নামক কাল্পনিক শহরটি। স্বামী অ্যান্ড ফ্রেন্ডস্ বইতে এই শহরের প্রথম উল্লেখ দেখা যায়। তার গল্পগুলিতে সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতটি আলোচিত হয়েছে। চরিত্রগুলির দৈনন্দিন জীবন এগুলিতে সহানুভূতির সঙ্গে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তাকে উইলিয়াম ফকনারের সঙ্গে তুলনা করা হয়। ফকনারও তার রচনায় সত্যিকারের শহরের আদলে একটি কাল্পনিক শহর গড়ে তুলেছিলেন, সাধারণ জীবনের মধ্যে থেকে হাস্যরস ও জীবনীশক্তি বের করে এনেছিলেন এবং মানবতাবাদের প্রতি গভীর সহানুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন। নারায়ণের ছোটোগল্প লেখার ভঙ্গিটিকে গাই দে মঁপাসার গল্পরচনার ভঙ্গিটির সঙ্গে তুলনা করা হয়। উভয়েই গল্পের উপাদানগুলির আকর্ষণীয়তা বজায় রেখে গল্পরচনায় দক্ষ ছিলেন। গদ্য ও ভাষ্যের অতিসরলীকরণের জন্য নারায়ণ সমালোচিতও হয়েছেন।
নারায়ণের লেখক জীবন ষাট বছরেরও বেশি সময় জুড়ে পরিব্যাপ্ত। তিনি একাধিক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। এগুলির মধ্যে রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচারের এসি বেনসন মেডেল, ভারতের তৃতীয় ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা যথাক্রমে পদ্মভূষণ ও পদ্মবিভূষণ উল্লেখযোগ্য। তিনি ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হয়েছিলেন।
১৯৯০ সালে তার পরবর্তী উপন্যাস দ্য ওয়ার্ল্ড অফ নাগরাজ প্রকাশিত হয়। এটিও মালগুডির পটভূমিকায় রচিত হয়েছিল। নারায়ণের বয়স তার রচনার উপর ছাপ ফেলতে শুরু করে। তার সাহিত্যিক জীবনের প্রথম দিকের কাজগুলিতে যে বিস্তারিত বিবরণগুলি পাওয়া যেত, এখানে তা আর দেখা যায়নি। এই উপন্যাসটি রচনার কাজ শেষ করার পরেই নারায়ণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি মাদ্রাজে তার মেয়ের পরিবারের কাছে চলে আসেন। ১৯৯৪ সালে তার মেয়ে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। নারায়ণের নাতনি ভুবনেশ্বরী (মিনি) তার দেখাশোনা শুরু করেন। এর পাশাপাশি ভুবনেশ্বরী ইন্ডিয়ান থট পাবলিকেশনস চালানোর ভারও গ্রহণ করেন। এই সময় নারায়ণ তার শেষ বই গ্র্যান্ডমাদার’স টেল প্রকাশ করেন। এই বইটি ছিল একটি আত্মজীবঞ্জীমূলক অনু-উপন্যাস। বইটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন তার প্রমাতামহী। তিনি ও তার স্বামী বিয়ের অল্প দিন পরেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। তার দিদিমা ছোটোবেলায় তাকে সেই গল্প শোনান।
জীবনের শেষ দিনগুলিতে কথাবার্তায় সদা উন্মুখ নারায়ণ প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যাই দ্য হিন্দু পত্রিকার প্রকাশক এন. রামের সঙ্গে কাটাতেন। তারা কফি খেতে খেতে মধ্য রাত পর্যন্ত নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন। লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা তার বিশেষ পছন্দের হলেও, এই সময় তিনি সাক্ষাৎকার দেওয়া বন্ধ করে দেন। টাইম পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় সেই নিবন্ধটির অলংকরণের জন্য তাকে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়ে গিয়ে তার ছবি তোলা হয়েছিল। এর ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে কিছুদিন হাসপাতালে কাটান। এই জন্যই তিনি সাক্ষাৎকার দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
২০০১ সালের মে মাসে নারায়ণ হাসপাতালে ভর্তি হন। তাকে ভেন্টিলেটরে রাখার কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি তার পরবর্তী উপন্যাসের পরিকল্পনা করছিলেন। সেটি ছিল তার দাদামশাইকে নিয়ে একটি গল্প। নারায়ণ নিজের নোটবই সম্পর্কে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। তিনি এন. রামকে একটি নোটবই এনে দিতে বলেন। যদিও নারায়ণ আর সুস্থ হয়ে ওঠেননি। ফলে উপন্যাসটি তিনি শুরুও করতে পারেননি। ২০০১ সালের ১৩ মে ৯৪ বছর বয়সে নারায়ণ চেন্নাই শহরে প্রয়াত হন।
১৯৬০ সালে ‘গাইড’ উপন্যাস লেখার জন্য সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হন আর. কে. নারায়ণ। এর পরে ১৯৮০ সালে রয়্যাল সোসাইটি অফ লিটারেচারের পক্ষ থেকে বেনসেন পদক লাভ করেন তিনি। বহুবার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হলেও পুরস্কার পাননি তিনি। ২০০১ সালে মৃত্যুর আগে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করে। সূত্র : উইকিপিডিয়া