আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় করোনার নেতিবাচক প্রভাব

102

বিগত কয়েক মাস ধরে করোনা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন সংক্রমণ আর মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বিশ্বের ২১৩টিরও বেশি দেশে এ করোনা ছড়িয়েছে। আর তাতে প্রতিটি দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। সে প্রভাব একদিকে যেমন নেতিবাচক তেমনি ইতিবাচক প্রভাব ও আছে। তবে নেতিবাচক প্রভাব অনেকটা দৃশ্যমান। যা আমরা দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি। যেমন অর্থনৈতিক প্রভাব; করোনার ধাক্কা বিশ্ব অর্থনীতিতে লেগেছে প্রচÐভাবে। বিশ্বব্যাপী ব্যবসা, শেয়ার, শিল্প, কৃষি, পর্যটন, পরিবহন ধাক্কা তো খেয়েছে এমনকি ওমরা হজ, জুমার নামাজের জমায়েত পর্যন্ত বন্ধ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, একটি বড় রকমের বিপর্যয় বৈশ্বিক জিডিপি ৫% কমিয়ে দিতে পারে (বর্তমান হিসেবে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এছাড়া ছোট বিপর্যয় যেমন ২০০৯ সালে ম্যাক্সিকোতে সুয়াইন ফ্লুর প্রভাব ও কম নয়। সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে ২০০২-০৪ সালে সার্স ভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক জিডিপি ০.৫% হ্রাস পেয়েছিল। ইবোলার কারণে ক্ষতি হয়েছে ৫৩০০ কোটি ডলার। তবে ২০১৯ সালের শেষে উহানে শুরু হওয়া করোনা ভাইরাসের ক্ষতি ১৭ বছর আগের সার্সের চেয়ে অনেক বেশি আর ভয়ংকর হবে। ২০২০ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ৩.৩% হবে বলে আশা করা হলেও করোনা ভাইরাস বিপর্যয়ের পর তা ৩% নিচে নেমে আসবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। উন্নত রাষ্ট্রের তুলনায় উন্নয়নশীল বা তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর বিপর্যয় আরো বেশি হবে। লকডাউনের ফলে সারা বিশ্বের অধিকাংশ কারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে যার প্রভাব আমাদের দেশের ওপরও পড়বে। চীনের সাথে এদেশের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও উদ্যোক্তারা অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে করোনা বাংলাদেশের আর্থিক খাতে প্রভাব ফেলবে সন্দেহ নেই। যে কয়টি খাত ক্ষতির সম্মুখীন হবে তাদের মধ্যে আছে গার্মেন্টস শিল্প, ভোগ্যপণ্য, মূলধনী যন্ত্রাংশ, কাঁচামাল আমদানী, চীনানির্ভর অবকাঠামো এবং রপ্তানি। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০% পোশাক খাত। এ পোশাক খাত আবার ৬০% চীনানির্ভর। সাধারণভাবে হিসাব করলেও ক্ষতির পরিমান দাঁড়াতে পারে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান দুই চালিকাশক্তি রপ্তানি ও রেমিট্যান্স। রপ্তানি আয় কমে গেলে দেশের শিল্প কারখানাগুলোতে শ্রমিকদের আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তা তৈরী হবে। যা ইতোমধ্যে দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। অন্যদিকে, অর্থনীতির চাকা সচল রাখার দ্বিতীয় উৎস রেমিট্যান্স। বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা প্রবাসীরা রেমিট্যান্স না পাঠালে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পরিবার থেকে সমাজে। প্রভাব পড়বে ব্যবসা-বাণিজ্যে। এছাড়া মানুষকে স্বার্থপর করে তুলছে এ করোনা। মানুষ মানুষের পাশে না থেকে মৃত্যুভয়ে অমানবিক আচরণ করছে। মা কে জঙ্গলে ফেলে যাওয়া, বাসা থেকে বের করে দেয়া, কোনো কোনো হাসপাতাল রোগীর চিকিৎসা দিতে রাজি হচ্ছে না। বাড়ছে সামাজিক সংকট। দীর্ঘদিন লকডাউনে বেড়েছে দাম্পত্য কলহ ও পারিবারিক অশান্তি। এমনকি অভাবের তাড়নায় চট্টগ্রামের পটিয়ায় বাবা তার দুই সন্তানকে গলাটিপে হত্যা করে নিজেই আত্মহত্যার চেষ্টা করার মত মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। যা করোনাকালে সম্ভবত প্রথম ঘটনা। আমাদের দেশের মানুষ ঘরে আবদ্ধ থাকতে অভ্যস্ত নয়। দীর্ঘ সময় ধরে আটকা থাকায় স্নায়ু চাপ বাড়ছে ফলে তুচ্ছ ঘটনায় সহিংসতা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা সংক্রমনে একদিকে মানসিক যন্ত্রণা অন্যদিকে কাজ না থাকায় অর্থনৈতিক স্থবিরতা মানুষের জীবনে বিশাল প্রভাব পড়ছে। আইএলও বলছে, করোনা ভাইরাসের কারণে ১৬০ কোটি মানুষ জীবিকার ঝুঁকিতে পড়তে পারে। আর বাংলাদেশ আছে উচ্চ ঝুঁকিতে। বেকারদের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বাড়বে সামাজিক সংকট। কেননা ক্ষুধার্ত মানুষ হয়ে উঠবে অপরাধপ্রবণ। হানাহানি বাড়বে। অস্থিরতা তৈরী হবে। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মানুষ সহিংস হচ্ছে। এরপরও আমরা বলতে চাই, ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’। পৃথিবীতে যুগে যুগে এমন মহামারি দেখা গেছে। সামনের দিনগুলোতেও যে আসবে না তা নয়। এখন উচিত আমাদের এই মহামারি থেকে শিক্ষা নেয়া। মানুষ নিজেদের শক্তির দম্ভে এতটাই বিভোর ছিল যে, প্রকৃতি বলে কিছু আছে ভুলতে বসেছিল। করোনা দেখিয়ে দিল মানুষের সীমাবদ্ধতা। এখন সময় এসেছে অন্তত আমাদের মত দেশে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার প্রতি নজর দেয়া। এ কাজগুলো সরকারকেই করতে হবে। প্রতিটি মানুষের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করার দায় সরকারের উপরই বর্তায়।