আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে ইউজিসি

125

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) কর্মকর্তাদের উচ্চতর স্কেলে বেতন প্রদান, বিধি বহিভর্‚তভাবে বাড়ি ভাড়া প্রদান, শিক্ষক, কর্মকর্তাদের দায়িত্ব ভাতা প্রদানসহ একাধিক ক্ষেত্রে আর্থিক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। আর এসব অনিয়মের কারণে প্রায় ১২ কোটি ৯ লাখ টাকা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট পর্যালোচনার পরিপত্রে এসব অনিয়মের বিষয় তুলে ধরে সুপারিশ করেছে ইউজিসি।
ইউজিসির পরিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার ও সমমানের কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত বেতন স্কেল ৩য় গ্রেডে (অধ্যাপক সমমান) প্রদান করা হয়েছিল এতদিন। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সিটি করপোরেশন এলাকার বাইরে অবস্থিত হলেও বিধি বহির্ভূতভাবে শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বাড়ি ভাড়া ভাতা সিটি করপোরেশন এলাকার হারে প্রদান করা হচ্ছে। এতে ৪ কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়াটারে বসবাসরতদেরও পূর্ণ বাড়ি ভাড়া ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। আর প্রতি মাসে বেতন থেকে ভাতার অর্ধেক এবং অবসর সময় বাকী অর্ধেক কেটে রাখা হয়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এসব বিধি বহিভ‚ত সুবিধা প্রদানের ফলে জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হচ্ছে।
এসব সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলা এবং প্রদত্ত অতিরিক্ত অর্থ আদায়ে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে ইউজিসি। পাশাপাশি যাতায়াত ভাতা প্রদান বন্ধের কথাও বলা হয়।
এদিকে জন্ম তারিখ অনুসারে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির মেয়াদ শেষ হলেও সেশন বেনিফিট দিয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ফলে প্রায় ২ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। তিন বছর আগে শিক্ষকদের ক্ষেত্রে সেশন বেনিফিট সুবিধা বন্ধ হলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রে তা চালু রাখা হয়েছে। যা সরকারি বিধির লঙ্ঘন। জাতীয় বেতন স্কেল বিধান অমান্য করে ভালো ফলাফল, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য শিক্ষকদের অতিরিক্ত ইনক্রিমেন্টসহ বেতন নির্ধারণেও আপত্তি তুলেছে ইউজিসি। এতে প্রায় এক কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি দেখানো হয়েছে। তবে গত বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ৫১৭ তম সিন্ডিকেটেই একাধিক ইনক্রিমেন্ট বাতিল এবং প্রদত্ত অতিরিক্ত অর্থ সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা না মেনে প্রতি বছর জুলাই মাসে শিক্ষক বই ভাতা বাবদ তিন হাজার টাকা প্রদান হয়ে থাকে। এই সুবিধা বন্ধ এবং প্রদত্ত অর্থ আদায়ের সুপারিশও করেছে ইউজিসি।
অতিরিক্ত দায়িত্ব ভাতা ও ভর্তি ফরম বিক্রির অর্থ :
বিধি বহিভর্‚তভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে একটি বিভাগের সভাপতি ও একটি অনুষদের ডিনের দায়িত্ব পালনের জন্য মাসিক মূল বেতনের মোট ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ দায়িত্ব ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তাদের একাডেমিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের জন্য দায়িত্ব ভাতা অবশ্যই মূল বেতনের ৬ থেকে ১৫ শতাংশ প্রদানের নিয়ম রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রায় এক কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের। জাতীয় বেতন স্কেল বিধান অথবা ভাতার হার যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে সুপারিশ করেছে ইউজিসি।
গত বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ফরম বিক্রি বাবদ আয় হয়েছে ৬ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ব্যয় শিক্ষক ও অন্যান্যদের পারিশ্রমিক বাবদ ২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, কাগজ ক্রয় বাবদ ৩৫ লাখ টাকা, মুদ্রণ বাবদ ২৪ লাখ টাকা এবং বিবিধ বাবদ ৩ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। ফলে এ খাতে মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৬ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, যা মোট আয়ের চেয়ে ২৬ লাখ টাকা বেশি। কিন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমসহ অন্যান্য ভর্তি পরীক্ষার ফরম বিক্রি বাবদ মোট আয়ের সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত ব্যয় করতে পারবে। বাকী ৪০ শতাংশ অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজস্ব তহবিলে জমা দিতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব নিয়ামক (ভারপ্রাপ্ত) মো. ফরিদুল আলম চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, এ বছর সব পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হওয়ায় ব্যয় বেড়ে গেছে। পুলিশ প্রশাসন, নিরাপত্তা ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের সম্মানি ভাতা সামান্য বাড়ানো হয়েছে। কোন সময়ই শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সিদ্ধান্ত মানা সম্ভব হয়নি। কোন সময় আয়ের কাছাকাছি খরচ হয়।
আর্থিক ও অফিস বিশৃঙ্খলা :
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ব্যাংক লোন, চা-নাস্তা, ঔষধ, খাবারসহ ব্যক্তিগত পাওনাদি বেতন থেকে কর্তন করা হয়। ফলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কাজের ব্যাঘাত ঘটে এবং সম্পদের অপচয় হয়। এসব পাওনাদি দাপ্তরিকভাবে পরিশোধ বন্ধের সুপারিশ করেছে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রস্তুতকৃত বেতন বিবরণীতে কোন প্রমাণপত্র ছাড়াই ডিপিএসের টাকা দেখিয়ে, আয়কর রেয়াত নেওয়া হয়। এর ফলে আয়কর বিধিমালা লঙ্ঘনের মাধ্যমে রাষ্ট্র আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এক্ষেত্রে আয়কর বিধিমালা অনুসরণের সুপারিশ করা হয়েছে।
এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থ বছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের থেকে আড়াই কোটি টাকা অসমন্বিত অগ্রিম রয়েছে, যা পরিশোধ করা হচ্ছে না। বছরের পর বছর ব্যক্তি পর্যায়ে অগ্রিম অর্থ থাকা অনৈতিক বলছে ইউজিসি। তাই অগ্রিম গ্রহণের ছয় মাস অথবা ৩০ জুন যেটি আগে আসে, এর মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। পাশাপাশি দ্রæততম সময়ের মধ্যে অগ্রিম অর্থ সমন্বয় অথবা আদায়ের সুপারিশ করা হয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাশবুক, লেজার, বিভিন্ন তহবিলের চ‚ড়ান্ত হিসাব যথাসময়ে তৈরি করা হয়নি। এটি আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী উল্লেখ্য করে, প্রতি মাসের ১০ তারিখের মধ্যে ইউজিসিতে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কেএম নুর আহমদ পূর্বদেশকে বলেন, কিছু নীতিমালার মাধ্যমে এসব সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। এখানে আইনকানুনের বিষয় আছে। নীতিমালা সংশোধনের মাধ্যমে ইউজিসি নির্দেশনা পালনের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চেষ্টা করে যাচ্ছে।