আরো বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে চট্টগ্রাম বন্দরে

28

নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রাম বন্দরের জেটি ১০ মিটার ড্রাফট এবং ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভেড়ানোর উপযোগী হচ্ছে। খুব শিগগিরই এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা শুরু হবে। এর ফলে বেশি পণ্য নিয়ে আরও বড় জাহাজ বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারবে। এতে জাহাজগুলোতে কন্টেইনারের সংখ্যাও বাড়বে। আর গতি বাড়বে পণ্য পরিবহনে।
আজ সোমবার চট্টগ্রাম বন্দরের ১৩৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। এ উপলক্ষ্যে গতকাল রোববার বিকাল তিনটার দিকে বন্দরের শহীদ মো. ফজলুর রহমান মুন্সী অডিটোরিয়ামে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান এ কথা জানান।
তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদীর বহির্নোঙর থেকে কাপ্তাই ড্যাম পর্যন্ত এলাকায় লন্ডনভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান জরিপ চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির রিপোর্টে ইতিবাচক সাড়া পেলে এবং প্রকল্প ব্যয় বাস্তবায়নযোগ্য হলে সেটার উপর ভিত্তি করে বন্দরের জেটিতে ১০ মিটার ড্রাফট এবং ২০০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ ভিড়তে পারবে। বর্তমানে সর্বোচ্চ সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের এবং সর্বোচ্চ ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে জাহাজ বন্দরের বিদ্যমান জেটিগুলোতে ভিড়তে পারে।
তিনি আরও বলেন, নির্মাণাধীন পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনালের (পিসিটি) নির্মাণ কাজ প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে ১ হাজার ২২৯ কোটি ৫৮ লাখ টাকায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এখানে ৬০০ মিটার জেটিতে একসঙ্গে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ও সাড়ে ৯ মিটার ড্রাফটের তিনটি কন্টেইনারবাহী জাহাজ এবং ২২০ মিটার দৈর্ঘ্যরে ডলফিন জেটিতে একটি তেলবাহী জাহাজ ভিড়ানো যাবে। বছরে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা সম্ভব হবে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে পিসিটিতে কার্যক্রম শুরু করার আশা প্রকাশ করেন বন্দর চেয়ারম্যান।
মতবিনিময় সভায় আরও বলা হয়, কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ি টার্মিনাল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বন্দরের সক্ষমতা প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেড়ে যাবে। গত বছর এ প্রকল্পের কাজে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। গত ৩০ মার্চ কক্সবাজার জেলা প্রশাসন এ প্রকল্পের ২৮৩ দশমিক ২৭ একর জমি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিয়েছে। বন্দর নির্মাণ কাজের জন্য ঠিকাদার নিয়োগের লক্ষ্যে খুব শিগগিরই দরপত্র আহব্বান করা হবে। মাতারবাড়ি টার্মিনাল বাস্তবায়িত হলে ১৬ মিটার বা তার চেয়ে বেশি গভীরতা সম্পন্ন বাণিজ্যিক জাহাজ আসা-যাওয়া করতে সক্ষম হবে। যা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।
এছাড়া বে-টার্মিনাল প্রকল্পাধীন ৬৭ একর ব্যক্তিমালিকানার জমির দলিল ২০২১ সালের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে বন্দরকে বুঝিয়ে দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। আরও ৮০৩ একর জমি প্রতীকী মূল্যে বন্দরের অনুক‚লে বরাদ্দ দিতে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভ‚মি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হয়েছে। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে দেড় হাজার মিটার দীর্ঘ মাল্টিপারপাস টার্মিনাল, ১ হাজার ২২৫ মিটার ও ৮০০ মিটার দীর্ঘ দুটি কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য গত এক দশকে ৫ লাখ ৮০ হাজার বর্গমিটার ইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা ৫৫ হাজারে উন্নীত হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং এলাকায় ওভারফ্লো কন্টেইনার ইয়ার্ড এবং সদরঘাট এলাকায় একটি ৭৫ মিটার লাইটারেজ জেটি নির্মাণ করা হয়েছে। এর আগে নির্মিত ৪০০ মিটার লাইটারেজ জেটি ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সচল করা হয়েছে। এতে লাইটার জাহাজগুলো দ্রæততম সময়ে কার্গো খালাস করায় লাইটার জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় কমেছে।
বন্দরের জলসীমা সাতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পোর্ট লিমিট সাত নটিক্যাল মাইল থেকে ৫০ নটিক্যাল মাইলে বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে বন্দরের জলসীমা সাতগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্ধিত পোর্ট লিমিটের সম্পূর্ণ এলাকা ডিজিটাল টাইডাল নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে মাদার ভেসেলগুলো ‘রিয়েল টাইম টাইডাল ইনফরমেশন’ এর ভিত্তিতে গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে নিরাপদে বর্হিনোঙরে যাতায়াত করতে পারছে। বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষায় ‘এক্সেস কন্ট্রোল সিস্টেম’ প্রবর্তন করা হয়েছে। বন্দর এলাকাকে সিসিটিভি কভারেজের আওতায় এনে সিসিটিভি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে। বন্দর ফায়ার ফাইটিং ইউনিটকে শক্তিশালী করার জন্য তিনটি ফায়ার ফাইটিং ফোম টেন্ডার এবং একটি রেসকিউ ভেহিকেল সংগ্রহ করা হয়েছে। তাছাড়া রপ্তানি কন্টেইনার স্ক্যান করার জন্য দুটি অত্যাধুনিক স্ক্যানার সংগ্রহের কার্যক্রম চলমান আছে।
এছাড়া বন্দরের লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়াতে কান্ডারি ৬ ও ১২ নামের দুটি টাগবোট, দুটি মুরিং লঞ্চ, দুটি সাইট স্ক্যান সোনার, দুটি ইকো সাউন্ডার, একটি সমুদ্রগামী হারবার টাগবোট সংগ্রহ করা হয়েছে। আর গত এক দশকে শিপ টু শোর কি গ্যান্ট্রি ক্রেন, মোবাইল হারবার ক্রেন, রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি ক্রেনসহ বিভিন্ন ধরনের ৩৯০টি কার্গো ও কন্টেইনার হ্যান্ডলিং ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে।
সেই সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ইউরোপের পথে সরাসরি শিপিং সার্ভিস চালু, আরএমজি পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে সমুদ্রপথে নতুন মাইলফলক সৃষ্টি হয়েছে। গত ফেব্রæয়ারিতে ‘এমভি সোঙ্গা চিতা’ ৯৫২ কন্টেইনার পণ্য নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়েছিল। একইভাবে চট্টগ্রাম থেকে ইউএসএ রুটেও সরাসরি জাহাজ চলাচলের সুযোগ রয়েছে।
রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান জানান, বেসরকারি আইসিডিতে বিনিয়োগে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে নানা ছাড় দেওয়া হচ্ছে। বন্দরের এক নম্বর জেটি গেটের কাছে মাল্টি স্টোরেড কার শেড নির্মাণ করা হচ্ছে। বিপজ্জনক, তেজষ্ক্রিয় ও রাসায়নিক পণ্য নিরাপদে আমদানি রপ্তানির সুবিধার্থে স্টেট অব আর্ট ক্যামিকেল শেড গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্য মতে, বন্দরে ২০২১ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৩২ লাখ ১৪ হাজার টিইইউস, প্রবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। জেনারেল কার্গো ওঠানামা হয়েছে ১১ কোটি ৬৬ লাখ টন, প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৩ শতাংশ। জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে ৪ হাজার ২০৯টি, প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশ। এ অর্জন বন্দরের ৩০ বছর মেয়াদি প্রক্ষেপণ ছাড়িয়ে গেছে। এসময় চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) এনামুল করিম একটি পেজেন্টেশনের মাধ্যমে বন্দরের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন।
মতবিনিময় সভায় চট্টগ্রাম বন্দরের সদস্য (হারবার ও মেরিন) কমডোর মো. মোস্তাফিজুর রহমান, সদস্য (অর্থ) কামরুল আমিন, সদস্য (প্রকৌশল) ক্যাপ্টেন মাহবুবুর রহমান, সচিব ওমর ফারুকসহ বন্দরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।