আরো বেশি ডিমের অপেক্ষা হালদায়

85

হাটহাজারি ও রাউজান প্রতিনিধি

হালদা নদীতে মা মাছ ডিম ছাড়লেও পরিমাণে তা খুব কম। ডিম সংগ্রহকারীরা এখন অপেক্ষা করছেন পরবর্তী জোয়ারের জন্য। গতকাল সোমবার ভোরে বৈশাখী পূর্ণিমার জোয়ারের সময়ে হালদায় ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মা মাছ। তবে সে সময় পাহাড়ি ঢল বা বৃষ্টি ছিল না।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম এ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্রে এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুনের শুরু পর্যন্ত বজ্রসহ বৃষ্টি এবং পাহাড়ি ঢল নামলে অমাবস্যা বা পূর্ণিমা তিথিতে নদীতে জোয়ার ও ভাটার সময়ে নিষিক্ত ডিম ছাড়ে কার্প জাতীয় মাছ। সেই ডিম জাল দিয়ে নদী থেকে সংগ্রহ করা হয়। পরে হ্যাচারিতে সেই ডিম ফুটিয়ে রেণু উৎপাদন করা হয়। এবার পূর্ণিমার তিথি শুরু হয়েছিল রবিবার বেলা ১২টা ২১ মিনিটে। হালদা পাড়ের ডিম সংগ্রহকারীরা রবিবার রাত থেকেই নদীতে নৌকা ও জাল নিয়ে অবস্থান করছিলেন।
কিন্তু ভোরে মা মাছ খুবই অল্প পরিমাণে ডিম ছেড়েছে জানিয়ে চট্টগ্রামের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী জানান, ‘ডিম সংগ্রহকারীরা সবাই নদীতে অপেক্ষা করছেন। পরবর্তী জোয়ারের সময় মা মাছ ডিম ছাড়তে পারে বলে আশা করছেন তারা।’
এদিকে হালদা গবেষক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুরুল কিবরিয়া জানান, ‘হালদা নদীর মদুনাঘাট থেকে রামদাস মুন্সির হাট পর্যন্ত এলাকায় খুবই কম পরিমাণে ডিম পাওয়া গেছে। উজানের দিকে তেমন ডিম মিলছে না। জোয়ারের সময় মা মাছ ডিম ছেড়েছে বটে, কিন্তু এবার পাহাড়ি ঢল নেই, বৃষ্টিও হয়নি। তাপমাত্রাও বেশি। পরিমাণ সে কারণেই কম। পরের জোয়ারে কতটা পাওয়া যায়, সেজন্যই অপেক্ষা। পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টি হলে পানিতে যে তরঙ্গ সৃষ্টি হয় তাতে ডিম আর পেটে রাখতে পারে না মাছ। তখন পানির তাপমাত্রাও কম থাকে। এবার সেই পরিবেশ পুরোপুরি তৈরি হয়নি বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল নেই বলে।’
হালদা পাড়ের রামদাস মুন্সির হাট এলাকার বর্ষীয়ান ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর জানান, ‘গত শুক্রবার মা মাছ নমুনা ডিম ছেড়েছিল। খুবই অল্প নমুনা ডিম কেউ কেউ সংগ্রহ করেছিল। এরপর গত রবিবার রাতে গড়দুয়ারা এলাকায় কিছু ডিম মিলেছে। গতরাতে বৃষ্টি হয়েছে। সকালে বৃষ্টি হয়নি। পাহাড়ি ঢলও নেই। ভোরের দিকে ডিম ছাড়লেও তা খুব কম। এখন পর্যন্ত খ্বুই অল্প ডিম সংগ্রহ করা হয়েছে।’ তার লোকজন আটটি নৌকা নিয়ে নদীতে অবস্থান করছেন জানিয়ে কামাল বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার থেকেই নদীতে মা মাছের আনাগোনা বেড়েছে। পরের জোয়ার সকাল ১০টার দিকে শুরু হবে। সেসময় মা মাছ ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা আছে। হালদা যেখানে কর্ণফুলীর সঙ্গে মিশেছে, সেই কালুরঘাট সেতুর কাছের অংশ থেকে উজানে মদুনাঘাট হয়ে নাজিরহাট পর্যন্ত প্রায় ৫০ কিলোমিটার অংশে নদীর দুই তীরে হাটহাজারী, রাউজান ও ফটিকছড়ি এই তিন উপজেলা। মদুনাঘাট থেকে সমিতির হাট পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার অংশে হাটাহাজারী ও রাউজান উপজেলা সংলগ্ন অংশেই নিষিক্ত ডিম মেলে। ডিম ছাড়ার অল্প সময়ের মধ্যেই তা সংগ্রহ করতে হয়। তাই মা মাছের ডিম ছাড়ার অপেক্ষায় নদীতে নৌকা নিয়ে অবস্থান নেন ডিম সংগ্রহকারীরা।’
গতকাল ছিল পূর্ণিমার তিথি। তবে নদীতে ছিল না স্রোতের তীব্র প্রবাহ। বিরূপ প্রকৃতির এমন হেঁয়ালিতে আশা-নিরাশার দোলাচলে এক দফায় নমুনা ডিম দেয়ার পর হালদা নদীতে নমুনার চেয়ে একটু বেশি ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় মা-মাছ। গতকাল সোমবার রাতের আঁধার কাটতেই মানুষের হাঁকডাক বাড়তে থাকে নদীতে। নদীতে নৌকা, জাল ও বালতিসহ নানা সরঞ্জাম নিয়ে অপেক্ষায় থাকা ডিম আহরণকারীরা এ সময় উৎসবের আমেজে মেতে উঠে। তবে জালে ডিমের পরিমাণ বেলা বাড়ার সাথে সাথে না বাড়ার কারণে তাদের মুখে মলিনতার ছাপ পড়েছে। এভাবে ভোররাত থেকে দুপুর পর্যন্ত ৩১৩টি নৌকায় সাড়ে ৬শ জন ডিমসংগ্রকারী মা-মাছের নিষিক্ত ডিম আহরণ করতে দেখা গেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সোমবার ভোর থেকে ডিম আহরণের নানা সরঞ্জাম নিয়ে হালদা নদীর হাটহাজারী ও রাউজান অংশের রামদাশ মুন্সীর হাট, নাপিতের ঘাট, আমতুয়া, মাছুয়াঘোনা, আজিমের ঘাট, খলিফারঘোনা গড়দুয়ারা নয়াহাট, কেরামতলীর বাঁক ও অঙ্কুরিঘোনাসহ আরও ৭-৮টি স্থানে ডিমসংগ্রহ করে। এ সময় প্রতি নৌকায় ডিম সংগ্রহকারীদের কেউ ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ এক কেজির উপরে করে ডিম সংগ্রহ করেছেন। তবে কোন কোন নৌকায় ডিম সংগ্রহকারীরা খালি হাতে ফিরেছেন। সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ প্রায় তিন হাজার কেজির মতো হবে বলে অনুমান করছে সংশ্লিষ্টরা।
দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে বংশ পরম্পরায় হালদা নদী থেকে ডিম আহরণ করে আসা হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা এলাকায় কামাল সওদাগর সব্বোচ্চ ডিম সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন, ‘গত শনিবার মধ্যরাতে হালদা নদীতে মা-মাছ নমুনা ডিম ছেড়েছিল। এরমধ্যে সোমবার ভোরে ভাটার সময় মা-মাছ ডিম ছেড়েছে। তবে এবার ডিমসংগ্রহের পরিমাণ একেবারেই কম। আমি আটটি নৌকায় ১০ বালতি (প্রায় ৮০ কেজির মতো) ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছি।’ এছাড়া ডিম আহরণকারী রবিউল হোসেন (৪০) জানান, ‘আমরা তিনটি নৌকা দিয়ে চার বালতি (৩৫ কেজির মতো) করে ডিম সংগ্রহ করেছি। এবার সংগৃহীত নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ আগের বছরের হিসেবে এক-তৃতীয়াংশের বেশি। গত বছর ২০২১ সালে হালদায় ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল সাড়ে ৬ হাজার কেজির মতো। ফলে এ বছর আশানুরূপ ডিম আহরণ করতে না পারায় সংগ্রহকারীদের মাঝে হতাশার ছাপ দেখা গেছে। তবে বজ্রপাতসহ টানাবর্ষণ হলে হালদায় ফের পুরোদমে ডিম ছাড়বে মা-মাছ ধারণা করছে বিশেষজ্ঞ ও ডিম সংগ্রহকারীরা।’
এদিকে হালদার নদীর পরিবেশ ও সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নের কাজ করা এনজিও আইডিএফ এর জোনাল ম্যানেজার মো. শাহ আলমও পরিবেশগত কারণে কাঙ্খিত পরিমাণ ডিম হালদায় মিলেনি বলে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘হালদা নদীর মা মাছ রক্ষার জন্য পিকেএসএফ এর সহযোগিতায় আইডিএফ দীর্ঘদিন বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এ বছর মা-মাছ রক্ষার জন্য প্রশাসনের সাথে আইডিএফ বিভিন্ন পদক্ষেপ প্রহণ করেছে। তবে পরিবেশ গত কারণে কাঙ্খিত পরিমাণ ডিম ছাড়েনি মা-মাছ। এরমধ্যে দ্বিতীয় দফায় মা-মাছ ডিম ছাড়লে আশানুরূপ ডিম সংগ্রহ করতে পারবে আহরণকারীরা।’
এবার প্রকৃতি অনুক‚লে না থাকায় মা-মাছ প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ পায়নি এমনটা দাবি করে হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহিদুল আলম বলেন, ‘ডিম দেওয়ার পরে কার্প জাতীয় মা-মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় শিকারিরা মা-মাছ ধরতে ফাঁদ পাতে। তাই হালদা পাড়ে সার্বক্ষণিক দুইটি ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গ্রাম পুলিশের সমন্বয়ে পাহারা দেওয়ার জন্য টহলদলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া আমাদের একটি টিম হালদা পাড়ের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত সিসি টিভি’র মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আশা করছি ফের মা-মাছ পুরোদমে ডিম ছাড়লে গত বছরের তুলনায় এবার ডিম সংগ্রহের পরিমাণ অনেক বেশি হবে।’
এদিকে কৃত্রিম রেণু পোনা তৈরিকারীরা হালদায় নমুনা ডিম দেয়ার পর থেকে বেশ সক্রিয়। এছাড়া সংগৃহীত মা-মাছের নিষিক্ত ডিমের পরিমাণ কম হওয়ায় হালদা পাড়ে কৃত্রিম রেণু পোনা উৎপাদনকারী ও বিক্রেতারা বেশ তৎপরতা চালাচ্ছেন। তবে এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন এমনটা জানিয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী জানান, ‘কৃত্রিম রেণু পোনা তৈরি করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর ও নৌ-পুলিশ সক্রিয় অবস্থানে রয়েছে।’
অন্যদিকে রাউজান প্রতিনিধি জানান, নদীর রাউজান, হাটহাজারীর বিভিন্ন পয়েন্টে রুই, ডিম সংগ্রহ হয়েছে। তবে রবিবার রাত ১২টা থেকে গতকাল সোমবার দিনভর সংগ্রহকারীরা নদীতে নৌকা, বাঁশের ভেলায় জাল নিয়ে ডিম সংগ্রহ করে। তবে পর্যাপ্ত ডিম না পাওয়া অনেকে এটি নমুনা ডিম বলে মন্তব্য করছে। তবে অনেক পুরনো সেই বাশের বেলা এবার প্রথম দেখা মেলে বলে অনেকে জানান।
এ বিষয়ে রাউজান উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা জোনায়াদে কবীর সোহাগ, নদীর তীরবর্তী স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান লায়ন সাহাবুদ্দিন আরিফ ও হালদা পাড়ের বাসিন্দা ও ডিম সংগ্রহকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রবিবার রাত ১২টা থেকে নদীর মা মাছ ডিম দেয়া শুরু হয়। কেউ ২-৫ কেজির বেশি ডিম পাননি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নদীর রাউজান অংশের কাগতিয়া, আজিমের ঘাট, ডোমখালী, কাগতিয়ার মুখ, খলিফারঘোনা, মদুনাঘাট, উরকিরচর, নোয়াপাড়া একাংশ, হাটহাজারীর রামদাস মুন্সিরহাট, নয়াহাট, মাছুয়াঘোনা, আমতুয়া, নাপিতের ঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় ডিম সংগ্রহ হয়েছে।
রাউজানের আজিমার ঘাট এলাকার ডিম সংগ্রহকারী নুরুল আজিম বলেন ‘রবিবার রাত ১২টা থেকে সোমবার বিকেল পর্যন্ত নদীতে অবস্থান করে ৫ কেজি ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছি।’ একই উপজেলার গড়দুয়ারা নয়াহাট এলাকার ডিম সংগ্রহকারী কামাল সওদাগর বলেন ‘শুক্রবার ও রবিবার মা মাছ নমুনা ডিম দিয়েছিল। আমি ৮টি নৌকা নিয়ে নদীতে ছিলাম।’
এ প্রসঙ্গে রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জোনায়েদ কবীর সোহাগ বলেন ‘অনেকে বেশকিছু ডিম পেয়েছে, আবার অনেকে কম ডিম পেয়েছে। তবে অন্যবারের চেয়ে এবার ডিরেম পরিমাণ কম।’
রাউজান পশ্চিম গুজরা ইউপি চেয়ারম্যান লায়ন সাহাবুদ্দিন আরিফ বলেন ‘অনেকে দিনভর, রাতভর নদীতে থেকেও পর্যাপ্ত ডিম পাননি।’
জানা গেছে, সংগৃহীত ডিম রাউজান, হাটহাজারীর বিভিন্ন হ্যাচারি বা মাটির কুয়ায় (গর্তে) ফুটিয়ে রেণু হিসেবে গড়ে তোলার পর বিক্রি শুরু হবে।