আরও কি পৃথিবী আছে

140

এই বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ পেলেন তিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। মহাকাশচর্চার সম্পূর্ণ বিপরীত পরিসরে গবেষণা তাঁদের। এক জনের কাজ সারা মহাজগৎ কোথা থেকে এল, কত বয়েস তার, কী ভাবে মাপা যায় তার বিস্তার, এবং তার মধ্যে আমাদের গ্যালাক্সি আর তারার দল কোত্থেকে এল, এই সব নিয়ে। অর্ধেক পুরস্কার পেলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পিবল্স, যাঁকে সবাই জিম বলে জানে।
অন্য অর্ধেক পেলেন জেনিভা অবজারভেটরি-র মিশেল মেয়র আর তাঁর এককালীন ছাত্র দিদিয়ে কেলোজ, যিনি এখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। অন্য তারাদের আমাদের সূর্যের মতো কোনও গ্রহমÐলী আছে কি না, এ নিয়ে জল্পনা বহু দিনের। মেয়র ও উনত্রিশ বছর বয়স্ক ছাত্র কেলোজ প্রথম এমন গ্রহের (বৃহস্পতির আকারের, যদিও প্রাণহীন) সন্ধান দিলেন ১৯৯৫ সালে। আজ সে ধরনের পৃথিবীমাপের আরও কয়েক হাজার গ্রহের সন্ধান মিলেছে। এত দিনে তার স্বীকৃতি মিলল।
১৯৯৫ সালের কাজের জন্য এত দিনে পুরস্কার? সে তো কিছুই নয়। নোবেল কমিটির মন বোঝা দায়। এ বছর রসায়নে পুরস্কারের কথাই ধরুন। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি পৃথিবীর সব ক’টা মোবাইল ফোন আর ল্যাপটপে ব্যবহার করা হচ্ছে, আবিষ্কার হয়েছে আশির দশকে, তার জন্য জন গুডেনাফ ৯৭ বছর বয়েসে নোবেলসম্মান পেলেন। সুব্রহ্মণ্যম চন্দ্রশেখরের লেগেছিল পঞ্চাশ বছর। জিম পিবল্সের যে কাজ মহাবিশ্বের প্রথম আলো নিয়ে, সেই ১৯৬৫ সালের গবেষণার জন্য ১৯৭৮ সালের নোবেল পাওয়া উচিত ছিল পেঞ্জিয়াস আর উইলসনের সঙ্গে। কিন্তু সে জমানায় পুরস্কার মিলত পরীক্ষামূলক কাজের জন্য শুধু (যে কারণে আইনস্টাইন আপেক্ষিকতা তত্তে¡র জন্য পুরস্কার না পেয়ে পেয়েছিলেন আলোক তড়িৎক্রিয়ার জন্য)। তাই ১৯৭৮ সালের মহাজাগতিক বিকিরণ খুঁজে পাওয়ার স্বীকৃতি মিলেছিল দৈবাৎ সেই বিকিরণ আবিষ্কার করা দুই ইঞ্জিনিয়ারের। ডিকি আর পিবল্স সেই বিকিরণের পিছনে থাকা পদার্থতত্ত¡ বুঝিয়েছিলেন— সেটা নোবেল কমিটির উলে�খযোগ্য মনে হয়নি।
মহাবিশ্বের শুরু অকস্মাৎ একটা বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণে। তার পর থেকে ১৪০০ কোটি বছর ধরে মহাস্ফীতি। গোড়ায় ছিল যে বিকিরণ, মহাবিশ্বের আয়তন যখন কমলালেবুর মতো, তার তাপমাত্রা কোটি কোটি ডিগ্রি। সে বিকিরণের অনেকটাই এখন পদার্থে পরিণত হয়েছে। আমি-আপনি এসেছি এর থেকেই। এত বছর ধরে প্রসারণের ফলে সেই বিকিরণের যতটা পড়ে আছে, তার তাপমাত্রা এখন অনেক কম। জর্জ গ্যামভ অঙ্ক কষে দেখান, ৫-১০ ডিগ্রি কেলভিনের মতো। প্রিন্সটনে রবার্ট ডিকি আর জিম পিবল্স আরও যথাযথ ভাবে কষে বললেন, হয়তো অনেক কম।
এ সব তো আর কেমব্রিজ-প্রিন্সটনের জ্যোতির্বিদ্যা দফতরের বাইরে খুব বেশি লোকের জানার কথা নয়। তবে নিউ জার্সির বেল ল্যাবসে বেলুন-মাধ্যমে আমেরিকা-ইউরোপের ফোন যোগাযোগ স্থাপন করতে চেষ্টা করছিলেন যে দুই ইঞ্জিনিয়ার, সেই পেঞ্জিয়াস আর উইলসন দেখলেন আমাদের চার দিকে সর্বত্র তিন ডিগ্রি কেলভিনের বিকিরণ— তাঁরা ভাবলেন যন্ত্রের গন্ডগোল। পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে প্রিন্সটনে ডিকি আর পিবল্স বোঝালেন— না, এ হল সেই বিগ ব্যাংয়ের থেকে পড়ে থাকা আদিম রশ্মি।
সেই আবিষ্কারের দৌলতেই আজ আমরা জানি মহাবিশ্ব এসেছে কোথা থেকে আর তার বয়েস কত। সে বার নোবেল পেলেন পেঞ্জিয়াস আর উইলসন, তার পর আরও নোবেল পেয়েছেন কোবে নামক কৃত্রিম উপগ্রহের বিজ্ঞানীরা। রবার্ট ডিকি মারা গিয়েছেন ১৯৯৭ সালে। সেই বিকিরণ যে মহাবিশ্বের প্রথম আলো, তা বোঝানোর জন্য পঞ্চাশ বছর বাদে স্বীকৃতি মিলল পিবল্সের।
শুধু সেখানেই থেমে থাকেননি তিনি। আমরা যে তিনটে টেক্সট বই পড়ে কসমোলজি শিখেছি কলেজে, তার সব ক’টাই পিবল্সের লেখা। ওই উষ্ণ বিকিরণ থেকে গ্যালাক্সি আর তারারা কোথা থেকে এল, মহাবিশ্বে গ্যালাক্সিরা ছড়িয়ে আছে কী ভাবে, তা মাপব কী করে, আমাদের নিজস্ব গ্যালাক্সির সৃষ্টি কী ভাবে, সবই পিবল্সের কাজ।
পিবল্সের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় চৌত্রিশ বছর আগে, আমি তখন ইংল্যান্ডে, কেমব্রিজে ডক্টরেট করছি। আমার প্রথম পেপার জমা পড়েছে, তার এক লম্বা বেনামি সমালোচনা ফেরত এসেছে জার্নাল থেকে। প্রশংসা আছে, আবার বিতর্কও। সেটা হজম করার চেষ্টা করছি, এমন সময় অফিসে ঢুকলেন সাড়ে ছ’ফুট লম্বা এক আমেরিকান ভদ্রলোক, দরজায় ঝুঁকে। বসে বললেন, সোমক, তোমার পেপারের সমালোচক আমিই। এখানে এসেছিলাম, ভাবলাম তোমার সঙ্গে আলোচনা করে যাই। তোমার আইডিয়াটা দারুণ। কিন্তু কয়েকটা জিনিস নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। তার পর তিন ঘণ্টা আলোচনা, লাঞ্চসুদ্ধ। আমি প্রথম বর্ষের ছাত্র, উনি কিংবদন্তি, এক বারও মনে হল না উনি আমায় সমবয়সি সহকর্মীর চেয়ে কিছু কম ভাবছেন।
জিম পিবল্সের সব সহকর্মীই একই কথা বলবেন। মৃদুভাষী, উদার, মহানুভব। তবে তা বলে তাঁর সামনে ভুলভাল বকে পার পাওয়া যেত না। চাকরির খোঁজে প্রিন্সটনে ওঁর ডিপার্টমেন্টে সেমিনার দিচ্ছি আমার আবিষ্কার শ্যাপ্লি সুপারক্লাস্টার নিয়ে। শেষে উনি উঠে দাঁড়িয়ে নানা কারণ দেখিয়ে বললেন, তুমি ভুল করেছ, এ রকম কোনও জিনিস থাকতেই পারে না। দশ বছর বাদে ভারতে এই পুণেতেই একটা কনফারেন্সে উনি আমায় বললেন, আমার মনে আছে, আমিই ভুল ভেবেছিলাম তখন। আবার প্যারিসে একটা মিটিংয়ে আমার বক্তৃতার পর, সবার সামনে নয়, আলাদা করে একটা ক্যাফেতে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে আমায় বুঝিয়েছিলেন আমার বক্তৃতার মূল গলতি কোথায়। সে বার উনি ঠিক।
স্পেনের হোটেলে মিটিংয়ের জন্য তৈরি হচ্ছিলেন ৭৭ বছর বয়সি মিশেল মেয়র। নোবেল কমিটি ওঁকে আগে থেকে ফোনে জানানোর সুযোগ পায়নি। সেখানেই কেউ ওঁকে টুইটার দেখে বলল, আপনি নোবেল পেয়েছেন।
পৃথিবীর খুব কাছের জগতে অন্য তারাদের আমাদের সূর্যের মতো কোনও গ্রহমÐলী আছে কি না, সেখানে পৃথিবীর মতো প্রাণধর আর কোনও গ্রহ পাওয়া যেতে পারে কি না, সেখানে জলবাতাস থাকবে কি না, এ নিয়ে জল্পনা বহু দিনের। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে মহাবিতর্ক ছিল, আমাদের সূর্যেরই কি শুধু গ্রহ আছে, অন্য কোনও নক্ষত্রের যদি না থাকে? কারও কারও ধারণা, ধর্মীয় অথবা অন্য কারণে, যে আমরাই মহাজগতে একমাত্র প্রাণী। আর কে কোথায় আছে, তা জানতে গেলে প্রথমে দরকার খুঁজে পাওয়া পাথর-মাটির তৈরি পৃথিবী-সাইজের গ্রহ। বৃহস্পতি বা শনি গ্যাসের তৈরি, সেখানে পা ফেলার জায়গা নেই। বুধ-শুক্রে গরম বেজায়, জল থাকলে বাষ্পীভূত হবে। প্রাণ খুঁজতে গেলে খুব বিশিষ্ট সব অবস্থাসম্পন্ন কোনও গ্রহ দরকার অন্যত্র।
দূরের গ্রহ টেলিস্কোপে দেখা শক্ত। তারার আলোতেই আপ্লুত হয়ে থাকে। তাই গ্রহের টানে তারার অল্প নড়াচড়া মাপতে পারলে গ্রহের খোঁজ পাওয়া সম্ভব, কিন্তু তার জন্য চাই অসম্ভব নিখুঁত ও শক্তিশালী স্পেক্টোগ্রাফ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভিড লেথাম ১৯৮৯ সালে প্রথমে এমন যন্ত্র তৈরি করে এমন এক গ্রহের সন্ধান হয়তো পেলেন, কিন্তু সাহস করে বলতে পারলেন না। আমি তখন লেথামের সঙ্গে কাজ করি, দেখেছি ওঁর মনে দ্বন্দ্ব।
তার পর পোল্যান্ডের আলেকজান্ডার ওলচজান ও আমেরিকার ডেল ফ্রেল আরেসিবো রেডিয়ো টেলিস্কোপ দিয়ে খুঁজে পেলেন এক নিউট্রন তারার পাশে এক গ্রহ। এতে প্রচুর উত্তেজনা হল। কারণ এটা জানা গেল যে, অন্য তারাদের পাশেও গ্রহ থাকতে পারে। কিন্তু নিউট্রন তারার আশেপাশে খুব বেশি গ্রহ পাওয়ার সম্ভাবনা কম, আর পেলেও সেখানে প্রাণ থাকতে পারে না।
এই দৌড়ে জিতলেন জেনিভা অবজারভেটরির মিশেল মেয়র আর তাঁর ছাত্র দিদিয়ে কেলোজ— সবচেয়ে নিখুঁত স্পেক্টোগ্রাফ তৈরি করে। আমাদের থেকে ৫০ আলোকবর্ষ দূরে ‘৫১ পেগ বি’ তারার টলমল গতির মধ্যে খুঁজে পেলেন এক গ্রহ। বৃহস্পতির আয়তনের, ১০০০ ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রা, কিন্তু সূর্যের মতো এক তারার চার পাশে এই প্রথম গ্রহ। সবচেয়ে জরুরি, দেখানো গেল এক প্রযুক্তিকৌশল, যার মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যাবে আরও অনেক গ্রহ কাছাকাছি তারাদের ভিড়ে।
সেই কৌশল প্রয়োগ করে আজকে আমরা খুঁজে পেয়েছি ৩৩০০ নিশ্চিত গ্রহ, আরও ২০০০ গ্রহের অনুমোদন নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে বেশ কিছু পৃথিবীর আয়তনের গ্রহ, কয়েকটিতে বায়ুমÐলও আছে। অনেক তারা পেয়েছি আমরা, যাদের চার পাশে একাধিক গ্রহ, ঠিক সূর্যের মতো। আজ ভারতে ইসরোর মঙ্গলযান আর চন্দ্রযানের উত্তরসূরি হিসেবে পরিকল্পনা চলছে দূরের গ্রহের প্রাণের খোঁজে ভারতীয় আকাশভেলা ভাসানোর। মেয়র-কেলোজের আবিষ্কারের উত্তরাধিকার। সূত্র : ইন্টারনেট