আম্মুও বিজ্ঞান জানেন

75

বাজার থেকে মাত্র বাসায় এসেছে তানজিল। এসেই মা’কে ডাক দিয়ে বললো, মা, তোমাকে আগেই বলেছি নিচতলার ঘরে না থাকতে। এখানে কত সমস্যা। মশার উপদ্রব। জানালাগুলো দিয়ে আলো বাতাস চলাফেরা করেনা। আর আজ দেখো ঘরের মেঝেতেও কেমন ভিজে উঠেছে। এত সমস্যা যেখানে সেখানে থাকা যায়?
তার ছোটো ভাই তাকে ডেকে বললো, তুমি এসব কাকে বলছো ভাইয়া? আম্মু তো বাসায় নেই। ফাতিহাকে নিয়ে বাড়িওয়ালার বাসায় গেছেন। তোমার জন্যে রান্নাঘরে নাস্তা রেডি করা আছে। ওখান থেকে নাস্তাটা খেয়ে নাও।

তানজিল বাড়িতে এসেছে বেশ কয়েকদিন হলো। সে বাড়ির বড় ছেলে। পুরো নাম তানজিল আরিফ। ঢাবিতে মাইক্রো-বায়োলজী নিয়ে পড়ছে।
তার ছোটো আরো দু’জন আছে। একজন সালমান আরিফ যে সবেমাত্র নবম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে, বিজ্ঞানের স্টুডেন্ট। আর এই দু’ভাইয়ের আদরের একটি ছোটো বোন আছে। নাম ফাতিহা। বয়স আনুমানিক পাঁচ।

এরপর তানজিল হাত-মুখ ধুয়ে এসে কিচেনে হট-ক্যারিয়ার উল্টিয়ে দেখলো তার জন্যে গরম গরম চিতই পিঠা রাখা যেনো একটু আগেই বানানো হয়েছে। সাথে ছোটো একটা বাটিতে আলুভাজি। সে সেগুলো একটা রুমে এসে জলদি করে খেয়ে নিলো। খাওয়ার গতি প্রমাণ করছে তার অনেক ব্যস্ততা আছে।
তারপর সে পেন্টটা ধুয়ে কিচেনের র‌্যাকে রেখে দিলো আর চার্জে থাকা মোবাইলটা খুলে হাতে নিলো।
আজ সারাদিনে একবারও তার ফেইসবুকে প্রবেশ করা হয়নি, কত মেসেজ আর নোটিফিকেশন এসেছে কে জানে!
তাই সে একটু ফেইসবুকে ঢুঁ মারতে গেলো। হয়তো এটাই তার জলদি খাওয়ার পিছনে প্রধান কারণ।
ঘন্টাখানেক পর কলিংবেল বাজলো তানজিল তার ছোটো ভাইকে ডেকে বললো, -সালমান? আম্মা এসেছে মনে হয়? গিয়ে দেখ তো।

তাদের মা বাসায় আসতেই তানজিল আবারো বললো,

-দেখো তো মা, বাসা কেমন ভিজে উঠেছে! নিচতলার বাসায় থাকতে হবে এমন কোনো কথা আছে? জানালাগুলো দিয়েও আলো বাতাস তেমন চলাফেরা করেনা।

-আরে বাবা বাসাটা দেখছিস না অনেক বড়সড়!
তাছাড়া তোর বাড়িওয়ালা নানু তোদের কত প্রসংশা করে। এমন বাড়িওয়ালা পাওয়া যায় সচারাচর? তবে এটা ঠিক তোর করা নিচতলার ঘরে মশার উপদ্রবের অভিযোগ কিছুটা সত্য। কিন্তু এটাও তোকে মাথায় রাখতে হবে মশার উপদ্রব কম বেশি সব জায়গাতেই আছে।
আর ঘর তো সাধারণত ঘেমে উঠেনা। আজ হয়তো কোনো ভাবে ঘামছে।

– না, আমি এই বাসায় উঠার পর থেকে বলেছি নিচতলার বাসায় থাকবোনা। এ বাসায় তাই থাকছি না ব্যাস।

– বাসা পাল্টানো কত ঝামেলার তুই জানিস? তাহলে তুই-ই খোঁজ কর। যেহেতু আরো কয়েকদিন আমাদের সাথে আছিস।

এটা বলে মা রুমে গিয়ে টিভি খুললেন।
আর তানজিল তার ছোটো ভাই সালমানকে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসেছে। সালমান নবম শ্রেণিতে উঠার পর এই প্রথম তাকে নিয়ে বসলো সে। হাইয়ার ম্যাথ ধরেছে।

– তোর নেক্সট পরীক্ষার সিলেবাসে কোন কোন অধ্যায় আছে রে?

– এই তো ভাইয়া সম্ভাবনা, গুনোত্তর ধারা, ত্রিকোণমিতি, দ্বিপদী বিস্তৃতি, আর জ্যামিতির পার্ট ইত্যাদি।

– আচ্ছা, সম্ভাবনা একেবারে পানিভাত আর বাকিগুলোও তেমন কঠিন না। আমি তোকে ছোটো অধ্যায়গুলো একদিনে আর বড় অধ্যায় হলে দু’দিন শেষ করিয়ে দিবো।

– ভাইয়া এক দিনে একটা চ্যাপ্টার? কীভাবে?

– আমি সেই ইন্টারমিডিয়েট থেকে পড়াচ্ছি। তুই চিন্তা করিস না। বেশি চাপ হয়ে গেলে আমি তো আছিই।

-আচ্ছা ভাইয়া।

-এখন দ্বিপদী বিস্তৃতি চ্যাপ্টারটা খোল। দুইটি পদের সমন্বয়ে গঠিত বীজগাণিতীয় রাশিকে দ্বিপদী রাশি বা ইংরেজিতে ইরহড়সরধষং বলা হয়। এখন প্যাসক্যালের সূত্রের সাহায্যে কীভাবে দ্বিপদী রাশি নির্ণয় করা যায় সেসব নিয়ে ধারণা দেবো।

শোন-

এরমধ্যেই মা ওদের পড়ার ঘরে এলেন।
বললেন- তানজিল এদিকে আয়। তুই না বললি ঘর ঘেমে গেছে? কিন্তু দেখ, রান্নাঘরে আমি চুলায় পানি গরম করতে দিয়েছি কয়েকঘন্টা হলো। পাতিলে পানি আর একটুখানি আছে। একটু হলেই পাতিলে পোড়া লেগে যেতো।
তুই এখানে এসে নাস্তা নিয়েছিস, পেন্ট ধুয়ে রেখেছিস। এতোবার এলি, চুলাটা বুঝি বন্ধ করতে পারলিনা?
আর দেখতো জানালাগুলোও সব বন্ধ। তাইতো অনেক তাপে পানিগুলো বাষ্প হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেছে আর ঘর ভিজে উঠেছে!
দেখছিস জানালা খোলা থাকলে বাষ্প কেটে যেতো। আর ঘরেও এমন ভ্যাপসা গরম থাকতো না।

এদিকে সালমান এসে বললো, -কী ভাইয়া, দেখেছো? আম্মুও টুকটাক বিজ্ঞান জানেন। উনি সায়েন্সের স্টুডেন্ট না হয়েও এতো ছোটো ব্যাপারটা ধরে ফেললো আর তুমি পারলে না?
অথচ তুমি নাকি ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানী।
আম্মু তো বাষ্প হয়ে কী হয়েছে সেটা বললো। আর আমি বলছি কখন বাষ্প হয়? আর কেন হয়?
প্রমাণ চাপে ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় বাষ্প হয়। আর বাষ্প হলো পানির গ্যাসীয় অবস্থা। অর্থাৎ পানি যখন তরল অবস্থায় ছিলো তখন অত্যাধিক তাপের কারণে পানির মধ্যকার কণাগুলো আন্তঃকণা বা নিজেদের ভেতরকার আকর্ষণ শক্তি থেকে প্রায় মুক্ত হয়ে এলেমেলো ভাবে ছোটাছুটি করতে থাকে। যার ফলে পানির কথাগুলো আমরা বাষ্প আকারে দেখতে পাই। ঠিক বলেছি না ভাইয়া?
তানজিলও ভাইয়ের প্রশ্নে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

তবে মায়ের এমন ব্যাখ্যা তানজিলকে আসলেই অবাক করেছে।
তাই সে চোখেমুখে খানিকটা বিস্ময় নিয়ে চুপই থাকলো। তবে সে আসলেই চুলায় যে পানি আছে সেটা খেয়াল করেনি।
যদিও চুলায় থাকা পানির মাধ্যমে বাষ্প ছড়িয়ে পুরো ঘর ঘেমে গেছে এটা তার মাথায় আসতো কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
তানজিল বললো, -আসলেই আম্মুর অভিযোগের চাইতে সমাধানের চিন্তা করা উচিত সব কিছুতে। আসলে নিচতলার বাসায়ও মানুষ থাকে কিন্তু কোনো কিছুর প্রতি অনিহা জন্মালে সেখানে অভিযোগের পদচারণাও বেশি হয়, আজ এটাই বুঝতে পারলাম। যা হোক এখন সালমান চল, তোকে গুনোত্তর ধারা চ্যাপ্টারটা করিয়ে ফেলি।
সালমান বললো,-ভাইয়া, গুনোত্তর ধারা না তুমি দ্বিপদী বিস্তৃতি করাচ্ছিলে।
তানজিল সালমানের দিকে তাকিয়ে ফিক করে হাসি দিয়ে বললো, -ওহ, হ্যাঁ!