আমার বাবাকে যেভাবে দেখেছি মো: রেজওয়ান

93

আমার জন্ম ১৯৫৮খ্রি.। আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি তখন আমাদের বাসায় প্রায় সময় লোকজন ভরপুর থাকত। তখন আমার আম্মাকে জিজ্ঞেস করি, এত লোক কেন আসে। মা আমাকে উত্তর দিল তোমার বাবা রাজনীতি করে এই জন্য লোকজন আসে। তখন আমার বয়স ৭ বৎসর অর্থাৎ রাজনীতি আমি বুঝি না। একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম বাবা এক লোকজন কেন আসে? তখন বাবা হাসিয়া বলল, তুমিতো এখন ছোট বড় হইলে বুঝবে। আমি রাজনীতি করি দেশের জন্য, মানুষের জন্য, তাই আমার কর্মী বাহিনী বাসায় আসবে ও চা নাস্তা এবং ভাত খাবে। কর্মীরা যাওয়ার সময় আবার আমার বাবা গাড়ি ভাড়া দেয়। ১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম থেকে ৩ জনই আওয়ামীলীগের মনোনয়ন চাইলেন এরা হলেন মুহাম্মদ আশরাফ খান, এড. ওমর হায়াত ও ইসহাক মিয়া। কিন্তু ইসহাক মিয়াকে কেন মনোনয়ন দিলেন। শুধুমাত্র একটি কারণেই মনোনয়ন দিলেন সেটা হল ইসহাক মিয়া বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী এবং ঘনিষ্ঠ সহচর হওয়াতে মনোনয়ন পেয়ে গেলেন আমার বাবা। আমার বাবাকে ঢাকার সরকারি প্লট নেওয়ার কথা বললাম, উত্তরে বাবা বলল, সারা জীবন রাজনীতি করেছি দেশের জন্য, যুদ্ধ করেছি দেশ স্বাধীন করার জন্য, তাই দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার যে জায়গা আছে সেটা নিয়া তোমরা থাকবা।
সারা জীবনটা দেশের জন্য, মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন কিন্তু নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, কিছুই করেন নাই। জীবনে অনেক লোক এসে আমার বাবাকে লক্ষ লক্ষ টাকার লোভ দেখিয়ে অনেক কাজের কথা বলেছেন কিন্তু বাবার কোন লোভ লালসা ছিল না এবং কাজের প্রতি কোন পাত্তা দেয় নাই। আর একটা কথা হলো দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু আমার বাবা জননেতা ইসহাক মিয়াকে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রশাসক নিযুক্ত করেছিলেন। বন্দরের প্রশাসক বা চেয়ারম্যান থাকাকালে অনেক লোক ইস্টিস্টারিং লাইসেন্স (জাহাজের লাইসেন্স) এর জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। কিন্তু কোন আত্মীয় স্বজনকে আমার বাবা লাইসেন্স দেয় নাই এমনকি নিজের পরিবারের কারো জন্যই লাইসেন্স নেয় নাই। এক কথায় যারা উপযুক্ত তাদেরকে ইস্টিভিটারিং লাইসেন্স দিয়েছে। আর একটা কথা দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে আমার বাবার একটি ব্রিকফিল্ড, একটি তৈলের মিল, ৩টি ট্রাক ও ১ জীপ গাড়ি ছিল। কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে এইগুলো সবই শেষ করে দিলেন আমার বাবা ইসহাক মিয়া।
আমার বাবার সাথে আমার একটি দুর্লভ স্মৃতি আছে যা আমার জীবনের স্মরণীয় ও গৌরবদীপ্ত স্মৃতি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে আওয়ামীলীগের প্রাক্তনমন্ত্রী বাংলাদেশ প্রেসিডিয়াম সদস্য সে সময়কার সংসদ সদস্য জননেতা মোশারফ হোসেন এমপি আমাদের বাসায় টেলিফোন করলে আমি ঐ ফোন ধরেছিলাম। ঐ সময়ে আমার বাবাও চট্টগ্রাম আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। মোশারফ হোসেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্দেশে বন্দরে অবস্থান পাকিস্তানি সমস্ত যুদ্ধের জাহাজ সোয়াত জাহাজ প্রতিরোধ করার নির্দেশনা বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। আমার বাবা মরহুম ইসহাক মিয়াও ডবলমুরিং আগ্রাবাদ তথা উনার নির্বাচনী এলাকায় লোকজন নিয়ে ২৭ তারিখে সকালে প্রায় ৫০০০ হাজার নেতা-কর্মী সোহয়াত জাহাজ প্রতিরোধ করে। এ প্রতিরোধে সোয়াত জাহাজ আর যুদ্ধের কাজে অগ্রসর হতে পারিনি।
পাকিস্তান আমলে আমি যখন ৫ম শ্রেণিতে পড়ি তখন আমার ফুফাতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে মুসলিম লীগ নেতা আলিম উল্লাহ চৌধুরী বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কটুক্তি করায় তাকে চেয়ার তুলে মারে আর এজন্য তাঁকে ডবলমুরিং থানা গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। একদিন রাখার পর থানা থেকে ছাড়া পায়। এভাবে বাবা মৃত্যুর আগদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু আদর্শ দেশপ্রেমের প্রতি অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস ছিল।
জীবনে কখনো কোন লোভ লালসার মাঝে আমার বাবাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিসর্জন দিতে দেখিনি। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বাবা সবসময় অভিভাবকের মত সকল গ্রæপকে সাথে নিয়ে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে ভূমিকা রেখেছিলেন। ৮৬ বছর বয়সেও অসুস্থ শরীর নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মকাÐে স্বাধীনতার স্বপক্ষে যে কোন আন্দোলন সংগ্রামে আমার বাবা সবার আগে উপস্থিত হয়ে দলের নেতাকর্মীদের উৎসাহ যোগাতেন। একজন অসাধারণ মনের মানুষ হিসেবে আমার বাবাকে কখনো নিরাশ হতে দেখিনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পরপর ২ বার কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা হতে পেরে আমার বাবা খুবই খুশি হয়েছিলেন সর্বশেষ বয়স ও অসুস্থতার কারণে আমার বাবা বাদ পড়ার কথা অনেকে বলেছিলেন। তখনো দেখেছি আমার বাবার দৃঢ় মনোবল। আমার বাবা জোরালো মনে সব সময় বলতেন আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে রাজনীতি করেছি আর বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বাদ দিবেন না। ২য় বারের মত উপদেষ্টা হয়ে আমার বাবা মনে প্রাণ আনন্দিত হয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে আমার বাবা একটা স্বপ্ন শুধু অপূর্ণ শুনতে পেয়েছিলাম সেটা হলো দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার মহান স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া আর এ জন্য আমার বাবা দৃঢ় আশাবাদী ছিলেন।
আমার বাবা মৃত্যুর আগদিন পর্যন্তও নিজ হাতে পরিবার ও কর্মীদের জন্য ওনার পারিবারিক ঘরভাড়া থেকে প্রাপ্ত টাকা খরচ করতেন। আমার বাবাকে যারাই দেখতে আসতেন কাউকে তিনি খালিমুখে যেতে দিতেন না। যেটা আমাদেরকেও পালন করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমার বাবা আমার কাছে শুধু একজন বাবা নয়। একটি আদর্শিক প্রতিষ্ঠান। যে প্রতিষ্ঠানে আর্থিক অভাব থাকলেও সাহস আর প্রেরণার কোন অভাব ছিল না। আমার রাজনীতিতে আমার বাবাই বড় প্রেরণা। যদিও আমার বাবা ইসহাক মিয়াকে তেমন বেশি মেলামেশার সুযোগ পায়নি। কারণ আমার বাবা বেশিরভাগ সময় মানুষের কল্যাণে রাজপথে সময় দিয়েছেন, কাজ করেছেন। আমি বেশিরভাগ সময় দূর থেকে বাবাকে দেখেছি দলীয় নেতাকর্মীদের একজন বিশ্বস্ত রাজনৈতিক অভিভাবক হিসেবে। আজ আমার বাবা নেই সেটা এখনো তেমন অনুভব হয় না। মনে হয় আমার বাবা কোন সভায় যোগ দিতে দারুল ফজল মার্কেট বা গণভবনে গেছে। আবার সন্ধ্যায় চলে আসবে। কিন্তু বাস্তবে আমার বাবা আজ আমাদের থেকে অনেক দূরে। হৃদয়ের মণিকোটায় আমার বাবা, আমার নেতা মরহুম জননেতা ইসহাক মিয়ার ৩য় মৃত্যুবার্ষিকী ২৪ জুলাই। আল্লাহর কাছে এই ফরিয়াদ আমার বাবাকে আল্লাহ জান্নাতবাসী করুক এই কামনা।
বঙ্গবন্ধু যখন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন তখন আমাদের বাড়ীতে জায়গা ছোট হওয়ায় হাজী পাড়া ডা: নুরুল আবছারের বাড়ীর সামনে একটি প্যান্ডল করেছিলাম এবং ঐ মঞ্চে বসার পর বঙ্গবন্ধুকে আমি ফুলের মালা দিয়েছিলাম। এরপর আমাদের বাড়ীতে এসে ডাল, ভাত খেয়েছে।
চট্টগ্রামের এম.এ আজিজ সাহেব প্রায় সময় আমাদের বাড়ীতে আসতেন, বিশ্্রাম করতেন, ভাত খেতেন এরপর বাবাকে নিয়ে শহরের নেতাদের বাসায় যেতেন অর্থাৎ আতাউর রহমান খান কায়সার, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, মির্জা আবু মনছুর, ইঞ্চিনিয়ার মোশারফ হোসেন, আবদুল্লাহ আল হারুন, ওহাব মিয়া, এদের বাসায় গিয়া বৈঠক করতেন কারণ চট্টগ্রামে কাকে কোথায় মনোনয়ন দিবেন সিদ্ধান্ত নিতেন। ১৯৮৬ সালে আমার বাবা এম.পি থাকা অবস্থায় জেলে ছিলেন ঐ সময়ে সাবেক মেয়র এ.বি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী বর্তমান এম.পি মোছলেম উদ্দিন আহমেদ, ছালেহ জহুর, সিরাজ মিয়া, সাবেক রাষ্ট্রদুত বিএনপি নেতা ডা: ইউসুফ ও জেলে থাকত। বাবাকে ঠওচ মর্যাদা দেওয়ার জন্য চেষ্টা করেন জেল কর্তৃপক্ষ। বাবা জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভার্গেনিং করিয়া অন্য নেতাদেরকেও ঠওচ দেওয়ার জন্য বলেছেন শেষ পর্যন্ত বাবার কথায় সবাই ঠওচ মর্যাদা পেলেন।
লেখক : মরহুম জননেতা ইসহাক মিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান