আমার দেখা কৃষিখাত ওরা স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন দেখায়

37

 

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সম্ভবনাময় খাতগুলোর মধ্যে কৃষি অন্যতম। এখনো এদেশের প্রান্তিক কৃষকের স্বপ্ন গুলো আলোকিত হয় কৃষিকে কেন্দ্র করে। আমাদের কৃষকের সোনালি স্বপ্নের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের স্বপ্নও। কৃষকের এই স্বপ্নের সাথে বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষিত তরুণরা কৃষিকে উদ্যোগ হিসেবে গ্রহণ করার বিষয়টি আশাব্যঞ্জক। ধীরে ধীরে শিক্ষিত তরুণদের কৃষিক্ষেত্রে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ আস্থার স্থান সৃষ্টি হচ্ছে। এ তরুণ উদ্যোক্তারা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তাদের খামারে সৃষ্টি করে যাচ্ছেন কর্মসংস্থানের সুযোগ। আমার দেখা, কৃষি খাতে অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছেন তেমন তিন জন কৃষি উদ্যোক্তার পরিচয়, তাদের ইচ্ছা, শক্তি, মেধা ও উদ্যমের কথা তুলে আনার চেষ্টা করবো আজকের আলোচনায়।
কৃষি উদ্যোক্তা মো. শাহেদ আয়াতুল্লাহ খান :
কৃষকবন্ধু শাহেদ খান। আমরা স্কুল গÐি এক সাথে পার করেছি। এরপর শাহেদ চলে যায় অন্য কলেজে সেখান থেকে মাস্টার্সের পর্ব শেষ করে চাকুরী পিছনে না ছুটে চট্টগ্রাম শহরের পতেঙ্গায় ভাড়া জায়গা নিয়ে বাবার সাথে দুগ্ধ খামার তৈরি করেন। এরপর আরো সাহসী ও উদ্যমী হয়ে একক প্রচেষ্টায় খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার রসুলপুর গ্রামে গড়ে তুলেন তরুছায়া এগ্রো ফার্ম নামে একটি দুগ্ধ খামার, বাণিজ্যিক রিসোর্ট ও কৃষি বান্ধব মিশ্র ফলের বাগান। গত বছর ৯ অক্টোবর ২০২০ তারিখে আমাদের স্কুলের ১৫/২০ জনের বন্ধুগ্রুপ শাহেদের আমন্ত্রণে তরুছায়া এগ্রো ফার্মে করা শুভ্র সাদা ও সবুজ রঙের রিসোর্ট যাওযা হয়। তপ্ত দুপুর পেরিয়ে বিকালবেলায় ঘুরে ফিরে আমি সরেজমিনে যা দেখলাম দুগ্ধ খামার ছাড়াাও পাহাড়ে উন্নত জাতের লেবু, কমলা, মাল্টা, পেয়ারা, আম, আপেল কুল বড়ই আর স্বল্প মেয়াদি সারি সারি পেঁপে চাষ করেছেন। কৃষি উদ্যোক্তা কৃষক বন্ধুর মুখেই শুনলাম তাইওয়ানের উচ্চ ফলনশীল বামন প্রজাতির রেডলেডি পেঁপে চাষের গল্প। সেইদিন বন্ধুর চেহারা ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি। এ যেন লাল জাতের পেঁপে চাষে সাফল্যের বীজ বুননের গল্পের নায়কের হাসি।
কৃষি উদ্যোক্তা শাহীনূর মোহাম্মদ আলী:
আমার আরেক স্কুল বন্ধু পৈত্রিক ব্যবসার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত করেছেন চট্টগ্রামের সলিমপুরে ‘এন এ এগ্রো’ ফার্ম। উদ্যোক্তা বন্ধু প্রথমে শুরু করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ান জাতের বিডিং করা গাভী দিয়ে দৈনিক ৪০০ লিটারের দুগ্ধ খামার। ছাগলের পাশাপাশি ও ভেড়ার খামার। পোল্ট্রি শিল্পের সম্ভাবনার নতুন খাতগুলো মধ্যে হাঁস ও মুরগির খামার ছাড়াও কোয়েল, তিতির পাখি ও টার্কি খামার উল্লেখযোগ্য বলা যায়। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশীয় জাতের গরু সংগ্রহে করে মোটাতাজাকরণের সাফল্য পেয়েছে। এ এগ্রো ফার্মে নতুন সংযোজন অস্ট্রেলিয়া থেকে ভাল জাতের সবল সুস্থ ঘোড়া এনে দেশের মধ্যে থেকে এশিযান জাতের ঘোড়ার সাথে ক্রস ব্রিডিং এর কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন অন্যতম। এগ্রো ফার্মে কর্মসংস্থানের সৃষ্টির মাধ্যমে অন্যান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছেন । উদ্যোক্তা বন্ধুর এগ্রো সাফল্য দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে।
কৃষি উদ্যোক্তা তারিকুল ইসলাম জুয়েল:
আমার কৃষি ভাবনার শেষ অধ্যায়ে আমি যার কথা উপস্থাপন করবো উনার সাথে আমি ২০১১ সাল থেকে মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। সেই থেকে উনার বাবার দূরদর্শী পরিকল্পনার গল্প শুনেছি। আমার সাবেক বসের বাবা ডা. আমিনুল ইসলাম স্যার গত ৩০ বছরের পরিশ্রমে তৈরি করা সাতকানিয়ায় তারাখোলা গ্রামে কৃষি খামার। ২০১৪ সালে ব্যাংকিং সেক্টরকে বিদায় দিয়ে ইপিজেডে পোষক শিল্পে মনোযোগী
হয়েছেন ঠিকই। কিন্তু অসুস্থ বাবার পরিশ্রমের কৃষি খামার ও অর্কিড বাগান নিয়ে কিভাবে প্রযুক্তির আধুনিকতায় পরিপূর্ণ একটি কৃষিবান্ধব খামার করা যায় সেই স্বপ্নই আমি খুঁজে পেযেছি উদ্যোক্তার পরিকল্পনায়। বছর দুইয়েক আগে প্রায় ৩০ একর নাল জমি ও পরিত্যক্ত পাহাড়ি টিলা ভূমি নিয়ে তারাখোলা খামারে কৃষি বান্ধব ধান চাষ, প্রাকৃতিক উপায়ে গরু মোটাতাজকরণ, আ¤্রপালিসহ মিশ্র ফলের বাগান, মাছ চাষের বিনিয়োগে আগ্রহী হযেছেন এ উদ্যোক্তা। জেলা প্রাণী সম্পদ প্রধানের পরামর্শে নিয়ে এক বছর আগে ১০টি দেশীয় জাতের গরু নিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে মোটাতাজাকরন করে এবছর ঈদুল আজহার সময়কালিন বিক্রয়ের সাফল্যের গল্পটা যেকোনো উদ্যোগী যুবকের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে। এগ্রোর পাশাপাশি কৃষি প্রজেক্টকে পর্যটন শিল্পের দিকে রূপান্তরের ইচ্ছা থেকে ‘কৃষি রিসোর্ট’ পরিকল্পনার কথা আমার কাছে ভিন্নতা পেয়েছে। কৃষির প্রতি ভালোবাসা থেকে খামারে সৃষ্টি করেছেন কর্মসংস্থানের সুযোগ। আমার সরেজমিনে দেখা, বর্তমানে স্থায়ী ভিত্তিতে প্রজেক্ট ব্যবস্থাপনায় ৬ জন শ্রমজীবিসহ বাগানে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে গড়ে ১০ জন কৃষি শ্রমিক কাজ করে যাচ্ছেন। উদ্যোক্তা প্রায়শই সাপ্তাহিক ছুটির দিনটি তারাখোলায় এগ্রো খামারে আনন্দে কাটিয়ে আসতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। স্বপ্নচারী তারিক ভাই শিল্প উদ্যোক্তার পাশাপাশি কৃষিবান্ধব উদ্যোক্তার সাফল্য দেশের কৃষি অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবেন সেই ব্যাপারে আমি আশাবাদী। পাহাড়ের মাটির উর্বরতা ও অনুক‚ল পরিবেশের মধ্যেও তাইওয়ান বামন প্রজাতির রেডলেডি পেঁপে চাষ করে যাওয়া শাহেদ, দুগ্ধ খামারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সাথে তাল মিলিয়ে দৈনিক ৪০০ লিটার দুধ উৎপাদন করতে পারা শাহীনূর, অভিজ্ঞ মানুষ না পেয়েও নিজের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে মোটিভেশন দিয়ে অভিজ্ঞ মানুষে পরিণত করা তারেক ভাই। এ সেক্টরে তিন জনই আমার কাছে জাতীয় অর্থনীতির স্বপ্নবিলাসী কৃষক। নিজে স্বপ্ন দেখার পাশাপাশি, দেশের অর্থনীতিকেও স্বপ্ন দেখিয়ে যাচ্ছেন এ উদ্যোক্তারা।
দেশের শিক্ষিত তরুণদের একটি বৃহৎ অংশ চাকুরীর আশা নিয়ে হতাশায় ভুগছে। চাকুরী পেছনে ছুটতে ছুটতে কেউ চাকরি পেয়েছেন, আর না পেয়ে কেউ হতাশাগ্রস্ত হয়ে বেছে নিচ্ছেন বিভিন্ন অন্যায়, অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্যনের প্রন্থাগুলো। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে চাকরির পেছনে না ছুটে অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোগী হয়ে আপনিও হতে পারেন সফল কৃষি-উদ্যোক্তা।
আসুন, কৃষিকে ভালোবাসি, আমরা স্বপ্ন দেখি এবং বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখাই। তবেই দেশের অর্থনীতি বাঁচবে, মানুষও বাঁচবে।

লেখক: সমাজচিন্তক