আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দামপাড়া পুলিশ লাইন

269

জামাল উদ্দিন

১১ মার্চ প্রকাশিত পরবর্তী অংশ

গাড়ি সরাসরি চলে গেল সার্কিট হাউজে। সেখানে চট্টগ্রামের সামরিক প্রধানের সাথে দেখা হল, কথা হল। সেখান থেকে শত্রæসেনাদের পাহারায় তিনি চলে গেলেন লালদিঘির পাড়স্থ সদর দপ্তরে। তখন সেখানে এক মেজর এসপির দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর সাথেও কথা হল। জানতে পারলেনÑ প্রশাসন ৮ মার্চ থেকে তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। ডিআইজির মুখে তাঁকে চাকরিতে জয়েন করার কথাটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যে। হয়তো তিনি পাকহানাদারদের প্রিয়ভাজন হবার জন্য এমনই ফন্দি করেছিলেন। ১৫ ও ১৬ এপ্রিল বিনিদ্রভাবে শত্রুসেনার প্রহরায় অফিসেই কাটালেন। ১৬ এপ্রিল তাঁকে জানিয়ে দিলেন ক্যান্টনমেন্ট যেতে হবে। আগেই দেখা করে যেতে হবে সার্কিট হাউজের সামরিক প্রধানের সাথে। ১৭ এপ্রিল নির্দেশমতে শত্রুসেনাদের প্রহরায় গাড়িতে উঠার আগেই সাথে নিলেন সার্ভিস ফাইলটি। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, যদি আর ফিরে না আসি এই ফাইলটি স্ত্রীর হাতে তুলে দেবেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তারা যেন কোনো সময় সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা পায়। সার্কিট হাউজে গেলেন। সামরিক প্রশাসক বললেন ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে ইন্টারোগেশান অফিসে দেখা করতে। তিনি সম্মতি দিয়ে বললেন, স্যার আমি কি একটু আমার স্ত্রী ও দু’সন্তানকে দেখে যেতে পারি? সম্মতি দিলেন। গাড়ি সার্কিট হাউজ থেকে বের হয়ে এনায়েত বাজারের যে বাসা থেকে তিনি বন্দি হলেন সে বাসার সামনে পৌঁছলেন। তাঁর স্ত্রী ও দু’সন্তানকে সামনে নিয়ে আসা হলো। হাতে থাকা সার্ভিস ফাইলটি স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, আমি যদি না থাকি এই ফাইলটি হয়তো একদিন তোমাদের কাজে লাগতে পারে। সন্তানদের মাথায় হাত বুলিয়ে, আদর করেন। পকেটে থাকা মাত্র ৫০টি টাকা স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললেন, আমার হাতে আর কোনো টাকা নেই। তোমরা একটু কষ্ট করে চল। এই বলে শত্রুসেনাদের সাথে বাসা থেকে বের হয়ে গাড়িতে চড়লেন। স্ত্রী মাহমুদা হক তারপর থেকে স্বামীর কোন খবর পাচ্ছিলেন না।
২ দিন পর ১৯ এপ্রিল তিনি বড়বোনের স্বামী মোখলেছুর রহমানকে সাথে নিয়ে সার্কিট হাউজে সামরিক আইন প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার হাসান-এর সাথে দেখা করলেন। তাঁর কাছে জানতে চানÑ ‘আমার স্বামী কোথায় আছে, কেমন আছে।’ তিনি কিন্তু নানা কথার ছলে বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। অবশেষে মাহমুুদা বললেন,Ñ
‘আজ আমার স্থলে যদি আপনার স্ত্রী হতেন, তিনি কি স্বামীর খোঁজে ঘর থেকে বের হতেন না? স্ত্রী হয়ে আমার জানারও কি অধিকার নেই আমার স্বামী কোথায় আছে?’ অবশেষে তিনি মুখ খুললেনÑ “দেখুন, বেগম ছাহেবা, আপনার স্বামী সাধারণ মানুষ নন, তিনি পুলিশ লাইনে যুদ্ধ পরিচালনা করে আমাদের এক মেজর ও ৭ জন সৈনিককে হত্যা করেছেন, এটা কি সাধারণ ঘটনা? তিনি সরকারি উচ্চ স্তরের অফিসার হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, কোর্ট মার্শালে তাঁর বিচার হবে, আপনি আসতে পারেন।” অতঃপর তিনি সার্কিট হাউজ থেকে বাসায় ফিরে এলেন। দু’সন্তানকে নিয়ে অনিশ্চয়তার মাঝে দিনাতিপাত করছেন মাহমুদা হক। বড়মেয়ে সাহরিন সামস্-এর বয়স তখন তিন বছর, ছোটমেয়ে রেলান সামস্-এর বয়স মাত্র ১১ মাস। অবশেষে মাহমুদা হক দু’সন্তাকে নিয়ে চট্টগ্রাম ছেড়ে চলে গেলেন ঢাকায়। উঠলেন এক আত্মীয়ের বাসায়। তখনো তাঁর বিশ্বাস ছিলো স্বামী জীবিত আছেন। অর্থকষ্টে দিন যাচ্ছে। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এমনই সময় তাঁর নিকটআত্মীয়রা তাঁর জন্য একখানা চাকরির ব্যবস্থা করলেন, ঢাকা কলেজে অধ্যাপনা। তিনি অধ্যাপনার কাজে যোগ দিলেন। এরই মধ্যে তিনি খবর পেলেন চট্টগ্রামের সামরিক আইন প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার হাসান বদলী হয়েছেন। তাঁর স্থলে দায়িত্ব নিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার কাইয়ুম। তিনি চট্টগ্রামে এসে ব্রিগেডিয়ার কাইয়ুমের সাথে দেখা করলেন সার্কিট হাউজে। তাঁকে সবকিছু বুঝিয়ে বললে, তিনি ফাইলপত্র ঘেঁটে আশ্বস্ত করলেন কয়েকদিনের মধ্যে খবর জানানো হবে। মাহমুদা হক ফিরে গেলেন ঢাকায়। এদিকে আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা কলেজের ঠিকানায় তিনি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন থেকে প্রেরিত একখানা পত্র পেলেন। চট্টগ্রামের তৎকালীন এডিসি মশিউর রহমানের স্বাক্ষরে উক্ত পত্রে লেখা আছে, ‘আপনার স্বামী এপ্রিল ১৯৭১ -এ মারা গেছেন।’ কিন্তু কোনো তারিখ উল্লেখ নেই। তখন তিনি নিশ্চিত হলেন যে, স্বামী নেই। এবার তিনি কিভাবে স্বামীর মৃত্যু হল তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্রে তিনি জানতে পারলেন যে, ১৭ তারিখ তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে নেয়ার পর ইন্টারোগেশন শেলে হাজির করা হলো। বসানো হলো ইলেকট্রিক চেয়ারে। সামরিক অফিসাররা তাঁকে একের পর এক প্রশ্ন করছেনÑ সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা, অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র সরবরাহ, দামপাড়া পুলিশ লাইন যুদ্ধে এক পাকিস্তানি মেজরসহ ৭ জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যার স্বীকারোক্তি এবং সহযোগী অন্যদের অবস্থান সম্পর্কে তথ্য পেশ, তিনি কিছুই স্বীকার করলেন না। অবশেষে শত্রুসেনারা তাঁকে ঐদিনই বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁর মরদেহের কোনো খোঁজ মিলেনি।
স্বাধীন দেশের মাটিতেই চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন বিপ্লবী সূর্য সেনের অনুসারী দেশের এই সূর্যসন্তান। স্মরণীয় যে, ব্রিটিশ সরকার মাস্টারদাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে যেভাবে তাঁর মরদেহ সাগরে নিক্ষেপ করে গুম করেছিলো, ঠিক একইভাবে এসপি শামসুল হকের মরদেহও শত্রুসেনারা গুম করে ফেলে।

শহীদ হলেন পুলিশ লাইনের আর আই আকরাম
হোসেন
১৭ এপ্রিল শহীদ হলেন আর আই আকরাম হোসেন। দামপাড়া পুলিশ লাইনে ২৮ মার্চ শত্রæবাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে এসপি শামসুল হকের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে অসম সাহসী যোদ্ধা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছেন, তিনি হলেন দামপাড়া পুলিশ লাইনের আর আই আকরাম হোসেন। কোতোয়ালী থানার ওসি আবদুল খালেক ছাড়াও এসপি শামসুল হকের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন আকরাম হোসেন। বলতে গেলে পুলিশ লাইনের দায়-দায়িত্ব ছিল তাঁর হাতেই। এসপি শামসুল হক ২৬ মার্চ থেকে লালদীঘি পাড়স্থ তাঁর দপ্তর ছেড়ে চলে যান আরেক দপ্তর দামপাড়া পুলিশ লাইনে। সেখানেই তিনি কন্ট্রোলরুমের কার্যক্রম শুরু করেন। বিশ্বস্ত আর আই আকরাম হোসেনকে সাথে নিয়ে তিনি যুদ্ধ পরিচালনায় নানা পরিকল্পনা হাতে নেন। ২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত নৌ-বাহিনীর ভারি গোলাবর্ষণ ও চতুর্মুখী আক্রমণের মধ্যেও আকরাম হোসেন পুলিশ লাইনের শৃঙ্খলা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এসপি শামসুল হক এখান থেকেই এক এক গ্রæপে বিভক্ত করে পুলিশ সদস্যদেরকে শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে শত্রæবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য পাঠিয়েছিলেন। এসব কাজে আকরাম ছিলেন তাঁর পরামর্শক। ২৮ মার্চ দিবাগত রাত প্রায় ৫টার দিকে শত্রæবাহিনী দামপাড়া পুলিশ লাইনে ত্রিমুখি আক্রমণ শুরু করলে পুলিশও তার পাণ্টা জবাব দেয়। দীর্ঘক্ষণ ধরে পুলিশ অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শত্রæবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে। তারা আশা করেছিলো শহরে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনী বা অন্য কোন মুক্তিযোদ্ধা গ্রæপ তাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। এক পর্যায়ে পুলিশ বাহিনীর গোলাগুলি ফুরিয়ে যায়। ফলে শত্রæবাহিনীর গুলির আঘাতে প্রাণ হারাতে থাকে একের পর এক পুলিশ। প্র্রায় ঘন্টাব্যাপী এই যুদ্ধে এক এক করে ৫১ জন পুলিশ বীরত্বের সাথে জীবন উৎসর্গ করে। এমনই সময় পুলিশ সুপার অন্য সকল পুলিশ সদস্যদের নিয়ে পশ্চিমে পাহাড়ের ঢালুতে অবস্থান নেন। তাদের উদ্দেশ্যে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রেখে পুলিশ সুপার শামসুল হক পুলিশ লাইন ত্যাগ করেন। আর আই আকরাম হোসেনও পুলিশ লাইন ত্যাগ করে বাকলিয়ায় গিয়ে এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নেন। উল্লেখ্য যে, এসপি শামসুল হকের মত তিনিও ২৬ মার্চ তাঁর পরিবারের সদস্যদেরকে শহর থেকে দূরে সাতকানিয়া থানার চুনতি গ্রামে এক পরিচিত জনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ১ এপ্রিল বাকলিয়া থেকে তিনি শেষবারের মত স্বল্প সময়ের জন্য পরিবার পরিজনের সাথে দেখা করতে যান চুনতি গ্রামে। সেখানে তাঁর মন টিকছিলো না। নিজের পরিবারের নিরাপত্তার চাইতেও মাতৃভূমিকে শত্র“র কবল থেকে রক্ষা করাই হল নৈতিক দায়িত্ব।
৭ দিন পর ৯ এপ্রিল চুনতি থেকে আবারো ছুটে আসলেন শহরে। বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের একত্রিত করে হানাদারদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার প্রচেষ্টা চালান। ১২ এপ্রিল আন্দরকিল্লা এলাকা দিয়ে যাবার পথে এক বিহারি পুলিশ তাঁকে চিনে ফেলে। ধরা পড়ে যান অসম সাহসী বীরযোদ্ধা আকরাম হোসেন। ঐদিনই তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সার্কিট হাউজস্থ পাকিস্তানি সামরিক প্রধানের সম্মুখে। সেখান থেকে শত্রুসেনারা তাঁকে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে তাঁকে অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। তাঁর মুখ থেকেও এসপি শামসুল হক ও অন্যরা কোথায় আছে তা বের করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তাঁর মুখ থেকে কোনো তথ্যই বের করতে পারেনি। এমনই সময় ১৭ এপ্রিল এসপি শামসুল হককেও শত্রুবাহিনী গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে। শেষবারের মতো এই দুই বীর যোদ্ধার মুখোমুখি দেখা হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ঐদিনই নিষ্ঠুর শত্রুসেনারা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে এসপি শামসুল হক ও আর আই আকরাম হোসেনকে।
শহীদ শামসুল হকের মতো শহীদ আকরাম হোসেনের মরদেহেরও কোনো খোঁজ পায়নি তাঁর পরিবারের সদস্যরা। আকরাম হোসেন ১ অক্টোবর ১৯২৪ সালে পাবনা জেলার বরওয়ারী নগর ফরিদপুর থানার কল্যাণী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আফাজ উদ্দিন মোল্লা। তিনি ১৯৪১ সালে বরওয়ারীনগর উচ্চবিদ্যালয় থেকে মানবিক বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। সিরাজগঞ্জ কলেজে আই এ ক্লাসে অধ্যয়নকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি মিত্র বাহিনীর হয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। দেশ বিভক্তির পর ১৯৪৮ সালের ২ ফেব্রæয়ারি সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে পাকিস্তান পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন খুলনা’তে। এস আই পদে ১৯৪৮ থেকে খুলনা ও ঢাকায় এবং ১৯৬২ পর্যন্ত পাবনা ও রংপুরে আর আই পদে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬০ সালে আর আই পদে যোগ দেন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটিতে। ৬৫ সালের মার্চে বদলি হয়ে আসেন রাজশাহীতে। একই বছরের সেপ্টেম্বরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। ১৯৬৭ সালে রংপুরে। চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইনে বদলী হয়ে আসেন ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে।

শহীদ হলেন কোতোয়ালী থানার ওসি আবদুল খালেক
২২ এপ্রিল কেতোয়ালী থানার ওসি আবদুল খালেককে চট্টগ্রাম ক্যান্টেনমেন্টে নির্মমভাবে হত্যা করল হানাদার বাহিনী। ১৬ এপ্রিল তিনি গ্রেপ্তার হন। অসম সাহসী এই যোদ্ধা ১ মার্চ থেকে চট্টগ্রামের এসপি শামসুল হকের হাতে হাত রেখে হানাদার প্রতিরোধে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ, ছাত্র, যুবকদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া, নিজেই পুলিশ বাহিনী নিয়ে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ২৮ মার্চ দিবাগত রাতে দামপাড়া পুলিশ লাইনে পাকবাহিনী হামলে পড়লে এসপি শামসুল হক তাঁকেই প্রথম খবরটি জানান। তিনি সাথে সাথে কয়েকজন সিপাহী নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন পুলিশ লাইনের দিকে। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করলেও শত্রুবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সামনে টিকতে পারেনি পুলিশ বাহিনী। ফলে একে একে ৫১ জন পুলিশ ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। যুদ্ধে প্রাণে বেঁচে গেলেও ঐদিন অর্থাৎ ২৯ মার্চ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার একটু পরেই এসপি শামসুল হকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কোতোয়ালী থানার দিকে রওয়ানা হলেন। তিনি ভেবেছিলেন থানায় তখনো সিপাহিরা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। ছুটলেন থানার দিকে। কিন্তু ততক্ষণে থানা শত্রæবাহিনী দখল করে নিয়েছে। অবস্থা বুঝতে পেরে তিনি পশ্চিম মাদারবাড়িস্থ তাঁর কাকা করম আলীর বাসায় চলে যান। সেখানে থেকে শত্রæবাহিনী প্রতিরোধে নানা পরিকল্পনা করছিলেন। সতর্কতা অবলম্বন করলেও অবাঙালি কয়েক পুলিশ তাঁর গতিবিধির ওপর নজর রাখছিল তা হয়তো খেয়াল করেননি। কাকার বাসায় যাওয়া-আসা সূত্রে এই অবাঙালি পুলিশ সদস্যরা বাসাটি আগে থেকেই চেনে। ১৬ এপ্রিল তাদের সহায়তায় শত্রæসেনারা ঐ বাসাটি ঘেরাও করে গ্রেপ্তার করে ওসি আবদুল খালেককে। তারপর তাঁকে হত্যা করে সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতায়।
২০ মে ১৯৭২, ঢাকার দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় প্রকাশিত নূরুল ইসলামের এক প্রতিবেদনে সেই বর্বরতার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে এভাবে- ১৬ এপ্রিল শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম শহরের কোন প্রত্যক্ষদর্শী যদি শহরের রাজপথের খোলা একখানি জীপ গাড়ির সামনে দু’হাত দু’দিকে দিয়ে বিধ্বস্ত একটা লোককে বাঁধা অবস্থায় হানাদার দস্যুদের গাড়িতে ঘোরাতে দেখে থাকেন Ñতবে তিনি নিশ্চয়ই বিবস্ত্র লোকটার ওপর খড়িমাটি দিয়ে সাদা অক্ষরে লেখা ক’টিও পড়ে থাকবেন, ‘কোতোয়ালী ওসি খালেক এরেস্টেড।’
সম্ভবত দস্যুরা প্রেপ্তারের পর এভাবে আর কোন বাঙালিকে প্রকাশ্য রাজপথে প্রদর্শনী সহকারে পাশবিক অত্যাচার করেনি-কিন্তু কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার জনাব আবদুল খলেককে নিয়ে তারা তাই করেছে। শুধু তাই নয়, চলন্ত গাড়িতে পশুর দল রাস্তায় ওসি খালেকের গায়ে জুতা, লাঠি, কিল, ঘুষি মারছে।
এভাবে সারা বিকেল তারা শহর প্রদক্ষিণ করিয়ে তাঁকে কোতোয়ালী এনে হাজির করে সন্ধ্যায়। তারপর সারারাত বিরামহীনভাবে খালেক সাহেবের উপর চালায় অমানুষিক অত্যাচার। এরপর পাঠানো হয় তাঁকে ক্যান্টেনমেন্টের জল্লাদখানাতে। ১৮ এপ্রিল বিকেল বেলা জল্লাদখানা থেকে এক ফাঁকে জনাব খালেক তাঁর কাকার বাসায় টেলিফোন করে জানান যে, কাকা যেনো তাঁর মুক্তির তদ্বির করেন।
খবর পেয়ে তিনি ক্যান্টেনমেন্টে যানÑখালেক সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। কিন্তু তিনি অনুমতিতো পান-নি বরং সেনাদের অশ্রাব্য গালি-গালাজ শুনে বাসায় ফিরে আসেন। ২২ এপ্রিল সকালের দিকে তিনি আবার তাঁর কাকার বাসায় টেলিফোন করলেন, জানতে চাইলেন কাকা তাঁর জন্য কিছু করতে পেরেছেন কিনা। জনাব খালেকের কাকা করম আলী সাহেব জানিয়েছেন, ২২ তারিখ সকালে খালেক টেলিফোন করেছিল এবং বিকাল বেলায় আর তাকে জীবিত রাখা হয়নি।
প্রথমে হাতের আঙ্গুল ও হাত, এর পর পায়ের আঙ্গুল ও পা কেটে এবং শেষে দু’চোখ উপড়ে ফেলে দেওয়ার পর খালেক আর বেশীক্ষণ বেঁচে থাকেননি।
অশ্রæসিক্ত নয়নে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে জনাব আলী বললেন, খালেক পশ্চিম মাদারবাড়িতে আমার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল। সেখান থেকে বাড়ি ঘেরাও করে তাকে ধরে নিয়ে আসে এবং আমার টাকা-পয়সা, স্বর্ণালঙ্কার, রেডিও, সেলাই মেশিন, কাপড়-চোপড়, ট্রাঙ্ক, স্যুটকেস, দলিলপত্র এবং আমাদের যাবতীয় সার্টিফিকেট তারা নিয়ে যায়। জনাব আলী জানান যে, তিনি খালেককে ছোটবেলা থেকে লালন-পালন করে মানুষ করেছেন। কারণ তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। খালেক সাহেব চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করেন, চাটগাঁ কলেজ থেকে বিএসসি পাস করেছিলেন। যদিও বাড়ি ছিল ঢাকা জেলার অন্তর্গত বৈদ্যের বাজার থানার মুচার চর গ্রামে, তথাপি তিনি তাঁর এ চাচার লালন-পালনে চাটগাঁতেই ছিলেন আশৈশব।
জনাব আলী জানান যে, খালেক সাহেব আওয়ামী লীগ রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ছাত্রজীবন থেকে জড়িত ছিলেন। তখনকার অসহযোগ আন্দোলন পর্ব থেকে জীবনের শেষ মুহূর্তে পর্যন্ত খালেকের রাজনৈতিক সমর্থন ও কার্যকলাপের ব্যাখ্যাদান বাতুলতা হবে মাত্র। তিনি বললেন, ২৫ মার্চের পর ২৬, ২৭ এবং ২৮ মার্চ পর্যন্ত দক্ষিণে বার্মা সীমান্তের টেকনাফ থেকে আরম্ভ করে রাঙ্গামাটি, রামগড় ইত্যাদি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে অসহযোগ আন্দোলনকারীদের জন্য বিপুল পরিমাণে অস্ত্র এবং গোলাবারুদ সংগ্রহের কাজে খালেক অত্যন্ত সক্রিয় সহযোগিতা দিয়ে এসেছেন।
শহীদ খালেক তাঁর বিধবা স্ত্রী এবং শিশুসন্তান রেখে গেছেন। এরা সবাই করম আলী সাহেবেরই পোষ্য হিসেবে চট্টগ্রামে বসবাস করছেন।
চট্টগ্রামের এসপি শহীদ শামসুল হক ও শহীদ আকরাম হোসেনের মত ওসি আবদুল খালেকের মরদেহেরও কোনো খোঁজ পায়নি তাঁর পরিবারের সদস্যরা।
ছাত্র জীবনে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের একনিষ্ঠ কর্মী ও সংগঠক ছিলেন। মেধাবী আবদুল খালেক পাকিস্তান পুলিশ বিভাগে কর্মজীবন শুরু করে ছাত্রজীবনের মতো কৃতিত্বের সাথে খুব সল্প সময়ের মধ্যে ওসি পদে উত্তীর্ণ হয়ে কোতোয়ালী থানার দায়িত্ব লাভ করেছিলেন। তখন গণআন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্ব। চট্টগ্রামের এসপি শামসুল হকের হাতে হাত রেখে একজন রাজনৈতিক নেতার মতোই তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কঠোর ভূমিকায় ছিলেন। যে কারণে অবাঙালি পুলিশরা তাঁর প্রতি ভীষণ ক্রুদ্ধ ছিল। শেষ পর্যন্ত তারাই তাঁকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরে দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করল। – সমাপ্ত

লেখক: গবেষক ও প্রকাশক