আমাদের স্বাধীনতা: অতঃপর ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডি

28

মিয়া জামশেদ উদ্দীন

হৃদপিণ্ডের পালপিটিশন বেড়ে গেল। শিরশির করছিল শিরা-উপশিরা। লোমও খাড়া দিয়ে উঠে। থরথর করে কাঁপছিল শরীর। কোনোভাবেই স্থির রাখতে পারছি না। অনেকটা ঢলেপড়া অবস্থা। তাড়াহুড়া করে শেষ করতে হয়; তবে যে খুব একটা দ্রুত শেষ করেছি তা নয়। পাশে আবু তালেব বেলাল ভাই, তিনিও টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে একমনে-একধ্যানে দোয়াদরুদ পড়ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের ওপর দীর্ঘ বছর ধরে গবেষণামূলক কাজ করে আসছি। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আবারও কেউ কেউ এ বিষয়গুলো গুলিয়ে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের বিষয় নিয়ে দ্বান্ধিকতায় যাবো না, যাবো না শ্রেণি সংগ্রামে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির একটি আবেগের স্থান, যেটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আর সেটি যথা সময়ে কাজে লাগিয়েছেন, তিনি জাতিকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিতে পেরেছেন। আর তিনি হয়ে ওঠলেন জাতির জনকে।
বঙ্গবন্ধু অন্তত বাঙালি জাতিকে একটি জায়গায় ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন এবং পশ্চিমা জান্তাদের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত সশস্ত্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ করেছেন। এটি শুধু হাতা-হাতি বা বাকযুদ্ধ নয়, মরণপণ সশস্ত্র যুদ্ধ। যা আরব্য উপন্যাসের রূপকথাকেও হার মানায়। অন্যদিকে এ যুদ্ধে বিশ্বের এযাবত কালের পরাশক্তিরাও জড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলন ও মহান স্বাধীনতা সংগ্রামকে চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার একমাত্র যাদুকরি ক্ষমতা ছিল বঙ্গবন্ধুর হাতে। তাঁর অসীম সাহস এবং রাজনৈতিক দুরদর্শিতার স্বাক্ষর মিলে। তবে ইতিহাসে অন্যদের ভূমিকা যে একেবারে নেই, তা বলছি না। গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মজলুম জননেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি ও জাতীয় ৪ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী, আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং পাকজান্তাদের আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা, বঙ্গবন্ধুকে এক অনন্য স্থানে আসিন করেন। তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। অবশেষে ৬৯ সালে মার্চমাসে দেশব্যাপী তীব্র আন্দোলনের মুখে আইয়ূব খান ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন এবং পাক সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান দায়িত্ব গ্রহণ করে সামরিক আইন জারি করেন। তারপর ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ৭০ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়। অর্থাৎ জনসংখ্যার ভিত্তিতে বন্টন হওয়া পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৭ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৫ আসনে বিজয়ী হয়। প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে বিজয়ী হয়। জনপ্রিয়তার দিকদিয়ে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ ৩৯.০২শতাংশ, জুলফিকার আলী ভুট্টোর দল পাকিস্তান পিপলস পাটি ১৮.০৬ শতাংশ ম্যান্ডেট পায়। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলের শেষে, ১মার্চ ১৯৭১সালে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের যে অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল, জেনারেল ইয়াহিয়া খান একতরফাভাবে তা স্থগিত ঘোষণা দেন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিজয় দল আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার কথা। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের জান্তারা বাঙালিকে সে অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। এ ঘটনায় পূর্বপাকিস্তানের জনগণ ফুলেফেঁপে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সর্বশেষ ৭মার্চ ঢাকায় রমনার রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণে জাতিকে দিকনির্দেশনা দেন। এ ভাষণ ছিল মাত্র ১৮ মিনিট। তিনি বিকেল ২টা ৪৫মিনিটে শুরু করেন, বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে তা শেষ করেন। এ ভাষণ ছিল ইতিহাসের কালজয়ী, এক অনবদ্য ও অমরকাব্য। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো এ ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম… তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা নিয়ে শত্রæর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়…রক্ত যখন দিয়েছি, প্রয়োজন হলে রক্ত আরো দেব, তারপরও দেশকে মুক্ত করেই ছাড়বো ইনশল্লা…
বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণে চিরতরে পশ্চিম পাকিস্তানের কবর রচনা হয়। এমতাবস্থায় নতুন করে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রয়োজন পড়েনি বাঙালি জাতির। এরপরও ২৫ মার্চ রাতে স্বাধীনতার ঘোষণা আসে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। এ স্বাধীনতার ঘোষণা-বার্তা সর্বপ্রথম চট্টগ্রামে পৌঁছে। টেলিফোন-টেলিগ্রাফসহ নানাভাবে এ ঘোষণা বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। জননেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। সলিমপুর ওয়ারলেসের মাধ্যমেও বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এ ঘোষণা-বার্তা। যারফলে অনুগামী ইস্টবেঙ্গলের সৈনিকরাও বিদ্রোহ (রিভোল্ট) করে স্বাধীনতার স্বপক্ষে অবস্থান নেন। বাংলার আপামর জনসাধারণের মধ্যে সর্বাত্মক গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে পাকজান্তারা গ্রেপ্তার করে। একই সময় পাকসৈন্যদের ক্রাকডাউন শুরু হয়, ঘুমন্ত ও নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর। তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে কারান্তরিন করে রাখে।
শুরু হলো স্বাধীনতাকামীদের সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি। দলে দলে স্বাধীনতাকামী যুবকরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আত্মগোপন করতে থাকে। তাঁরা স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ নিয়ে পুনরায় পাকজান্তা সরকারবিরোধী গেরিলা হামলা শুরু করেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল খুলনা বিভাগের মেহেরপুরে বৈদ্যনাথতলায় এ সরকারের সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন। অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি মনোনিত হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান মেজর জেনারেল (কর্নেল) আতাউল গণি ওসমানি। অন্যান্য পদও বন্টন হয়। সরকারের উপদেষ্টা হলেন ভাসানী ন্যাপের মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানি, কমিউনিস্ট পাটির মণি সিংহ, বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর, ওয়ালি ন্যাপের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদসহ আওয়ামী লীগ থেকে আরো তিন জনকে নেয়া হয়। সর্বমোট ৮ সদস্যবিশিষ্ট এ উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে আত্মপ্রকাশ করে। ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মদান ও লক্ষ লক্ষ মা ও বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা অর্জিত হয়। বাংলাদেশর স্বাধীনতা লাভে পার্শ্ববতী দেশ ভারত ও পরাশক্তিধর রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) সর্বপ্রকার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়ে পাশে অবস্থান নেয়। অপর পরাশক্তি আমেরিকা ভৌতগত রাজনীতির কারনে সর্বাত্মক বিরোধিতা করে সপ্তম নৌ-বহর পাঠিয়ে, তাঁদের অবস্থান প্রত্যক্ষভাবে জানান দেয়।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ৮ জনুয়ারি পাকিস্তানের মিয়ানওয়ান কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১০ জানুয়ারি লÐন ও দিল্লি হয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তখনও সাংবিধানিকভাবে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। দু’দিন পর ১২ জানুয়ারি বঙ্গভবনে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেন। প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এ শপথবাক্য পাঠ করান। প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। অবশ্য একদিন আগে ১১ জানুয়ারি তাজউদ্দীন আহমদ-এর বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠক হয়। বৈঠকে সংসদীয় ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত হয়। এরপর বঙ্গবন্ধু সাময়িকভাবে সাংবিধানিক এ নির্দেশ জারি করেন। অথচ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র ৩ বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধু সপরিবারে প্রাণ হারালেন। কিছু উচ্চবিলাসী সেনা কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষভাবে এ ন্যক্কারজনক ঘটনাটি ঘটায়। যা ছিল অমানবিক ও বর্বরোচিত ঘটনা। এমন কি বঙ্গবন্ধুর শিশু পুত্র শেখ রাসেলও রক্ষা পেলো না। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা। বঙ্গবন্ধুর এ দুই কন্যা দেশের বাহিরে থাকায় ঘাতকদের বুলেট থেকে রক্ষা পেলেন। ঘাতকরা এ ন্যক্কারজনক হত্যাকাÐ সংঘঠিত করারপরও ক্রান্ত হয়নি। ৩রা নভেম্বর ঘাতকদের বুলেটের আঘাতে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় জাতির ৪ নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী ও আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জান প্রাণ হারান। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশ। চারদিকে যুদ্ধ বিধ্বস্থ ধ্বংসস্ত‚প ও ভঙ্গুর অর্থনীতি। সমানহারে বেকার, দরিদ্রতা ও ক্ষুধার তিব্রতা। এ অবস্থায় আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে প্রাণপণ চেষ্টা চলছিল। ধ্বংসপ্রাপ্ত শিল্পকারখানাকে রাষ্ট্রায়ত্ব প্রতিষ্ঠান ঘোষণা করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করলেন। ব্যাংক-বীমাও রাষ্ট্রায়ত্ব ঘোষণা দিয়ে বেকারত্ব ঘুচাতে জরুরি পদক্ষেপ নেন। এভাবে একের পর এক জনকল্যানমূলক ও জনহিতকর কাজ করেই চলেছেন বঙ্গবন্ধু। একটি সমিক্ষায় দেখা গেছে, পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিকদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৩ ডলার। আর ৩ বছরের মাথায় সদ্য-স্বাধীন দেশের নাগরিকের মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১৭৩ ডলারে।
অন্যদিকে দেশব্যাপী চক্রান্ত শুরু হয়ে যায়। সমানে মাঠে নামে একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও দেশীয় লুঠেরা-দালাল এবং আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা। তারা জ্বালাওপোড়াও, লুঠপাট ও ডাকাতি-রাহাজানি এবং নোঙ্গরে থাকা আমদানী করা খাদ্যদ্রব্য বোঝাই জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে দেশে কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। যাতে করে ব্যর্থ রাষ্ট্র পরিণত হয় এবং বহির্বিশ্বে বঙ্গবন্ধুর সুনাম ও ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়। অনেকটা বঙ্গবন্ধুকে চক্রান্তের ক‚টচালে ফেলে কোণঠাসা করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্র। তবুও বঙ্গবন্ধু হাল ছাড়েনি; তিনি জাতিকে স্বনির্ভর করতে গিয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে আবারও ঢেলে সাজাতে চেষ্টা করলেন। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হওয়ার পূর্বেই ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে চক্রটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। তারা কিছু সংখ্যক অথর্ব সেনা কর্মকর্তাদের দিয়ে একঢিলে দু’ শিকার করে বসে; আর ঘটে গেল বিশ্বের ইতিহাসে নিকৃষ্টতম এক কালো অধ্যায়। আজ জাতি মুহ্যমান।
বরাবরই ব্যাকুল মন। কখনো সময়-সুযোগ পেলে জনকের কবর জেয়ারত করার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই। যেন জাতির ঋণ শোধ করার পালা; সেই সুবর্ণ সুযোগটি সৃষ্টি করেন খোদ জনকের কন্যা, সেই স্বপ্নের পদ্মাসেতু পার হয়ে অবলিলায় ইচ্ছে পূরণ হলো। সঙ্গে ছিলেন আরেক জ্ঞানেশ্বর ও বিশিষ্ট সাংবাদিক আবু তালেব বেলালভাই। বরাবরই দীপশিখা প্রজ্বলিত করেন বন্ধুবর শিবু দাস গুপ্ত সুদীপ্ত। পদ্মাসেতু থেকে মাত্র ১১০ কি.মি. অদূরে গোপলগঞ্জের টঙ্গিপাড়া। সেখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ, স্মৃতি কমপ্লেক্স, স্মৃতি যাদুঘর ও লাইব্রেরী এবং দর্শনার্থীদের বিশ্রামাগার। সংরক্ষণ আছে টলমল সোদরা জল, শৈশবের খেলার মাঠ, আঙ্গিনায় চিরসবুজে বেষ্টিত নৌকা, পারিবারি এবাদতখানা এবং সম্মুখে রয়েছে আরেকটি বড়োসড়ো এবাদখানা। ক্ষাণিকটা অদুরে শেখ রাসেল শিশু পার্ক। ঝর্ণার কলকল কলতানে পথিকজন থমকে দাঁড়ায়… কাঁদো বাঙালি, কাঁদো… তোমাদের আজন্ম ক্রন্দন যেন নিরবধি Ñ তার-ই অবিরাম বয়ে যায় পদ্মা-মেঘনা-যমুনার বারিধারা…
আমাদের বাহন ল্যান্ড রোভার সবুজের বুক চিরে শা-শা করে ছুটে চললো। মাত্র দু’ঘণ্টায় আমরা পৌঁছলাম। মাঝপথে ভাঙায় মধ্যাহ্নভোজ সারাতে হয় একটি পেট্রোলপাম্প কাম হোটেলে-রেস্তোরাঁয়। বলতে হয়, পরিপাটি গ্রামিন আবহে প্রতিষ্ঠিত হয় হোটেলটিও। যেন চিরবন্ধনে আবদ্ধ গুচ্ছ গুচ্ছ গ্রামবাংলার নীড়। যতদুর চোখ মেলে বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সোনালী আঁশের পাটক্ষেত, আর একপায়ে মাথা উঁচু দাঁড়িয়ে আছে চিরচেনা তালগাছ। আর বহিছে ঝির ঝির হিমশীতল সমিরণ, সবুজের দোলায় দোলায় কৃষাণিরা ঘুমপাড়ায় দুরন্ত শিশুকে মাসি ফিসির গল্প বলে বলে। আহ্; বুকভরে নিঃশ্বাস নিয়ে নীল আকাশে ভাসায় নাও। যেন পল্লি কবি জসিম উদ্দিনের নকশি কাঁথার মাঠ, অবলিলায় আবারও তা স্মরণ করিয়ে দেয় Ñ এই কী সেই টুঙ্গিপাড়া! যেখানে বঙ্গবন্ধুর দুরন্ত শৈশব ও কিশোরবেলা কেটেছে। ঘাতকরাও স্থানটি বেছে নেয়। সেই অজপাড়া গ্রামে চিরনিদ্রায় শায়িত স্বজনদের পাশে, হাজারো বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
লেখক: কবি, কলামিস্ট ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক