আমাদের ব্যবহার, আমাদের রুচি

16

কামরুল হাসান বাদল

প্রকৃতি মানুষের আচার আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে। একটি জাতিসত্তা বা একটি জাতি কীভাবে গড়ে উঠবে তা নির্ভর করে সে অঞ্চলের জলবায়ু, আবহাওয়া বা প্রকৃতির ওপর। যেমন- গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের মানুষ হয় একটু রুক্ষ, উগ্র ও বদমেজাজি। পাশাপাশি শীতপ্রধান দেশের মানুষ হয় নম্র, কিছুটা কোমল ও কৌশলী। পোশাক থেকে খাদ্যাভ্যাস সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় জলবায়ু ভেদে। বন্যাপ্রবণ বৃষ্টিপ্রধান অঞ্চল বলে আমাদের পোশাক লুঙ্গি। শীতপ্রধান দেশে কোট জ্যাকেট আর মরুভূমির গরম ও লু-হাওয়া থেকে বেঁচে থাকবার জন্যে লম্বা আলখাল্লা ধরনের পোশাক। খাবার দাবারেও তাই। এক সময় মরু অঞ্চলে যখন কিছুই উৎপন্ন হতো না সেখানে তারা দিনে সামান্য কয়েকটি খেজুর খেয়েই জীবন ধারণ করতো। তাদের প্রয়োজনীয় ক্যালরির যোগান দিতো খেজুর। যেমন আমাদের বর্তমান এই তাপদাহে অর্থাৎ গ্রীষ্মকালের ফলের দিকে তাকান দেখবেন সব ফলই কেমন রসালো ও ঠাÐা। বর্ষায় লক্ষ লক্ষ বাঙালি কৃষকের ভাতের অভাব পূর্ণ করেছে আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল। ফলনে স্বাদে ও পুষ্টিতে নিরন্ন মানুষের ক্যালরি যুগিয়ে এসেছে প্রকৃতির এই অপার দান। প্রকৃতি তার সন্তানদের এমন করেই রক্ষা করে এসেছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে।
কথাগুলো মনে পড়লো অন্য কারণে। আমাদের এই দেশ এক সময় নাতিশীতোষ্ণ পরিমÐলের ছিল। অর্থাৎ ছয় ঋতুর এই দেশ বেশি গরমও নয় বেশি ঠাÐাও নয়। এটি এমন একটি দেশ অতি বর্ষণ ও অতি শীতের কয়েকটা দিন বাদ দিলে। এখানে খোলা আকাশের নিচেও প্রচুর লোক বাস করতে পারে। শীতপ্রধান বা গ্রীষ্মপ্রধান বা মরু অঞ্চলে তা সম্ভব নয়। তাই এখানে আম খেয়ে আঁটি ছুঁড়ে ফেললেও সেখানে চারা গজিয়ে ওঠে তেমনি এখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও বেশ অধিক। তবে বিগত কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এদেশের আবহাওয়া হয়ে উঠছে চরম ভাবাপন্ন অর্থাৎ অতি গরমের দেশে পরিণত হচ্ছে বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সারা বিশ্বেই উষ্ণতা বাড়ছে এবং এর ফলে মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফ গলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বুদ্ধির সংবাদ নতুন নয়। এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি, আলোচনা হয়েছে, হচ্ছে এবং সামনে আরো হবে। আমার আলোচনার বিষয় সেটিও নয়। আমি ভাবছি প্রকৃতির এই পরিবর্তনের সাথে সাথে এই জাতির মনোজগতেও একটি বিশাল পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে তা অনেকের অলক্ষে হলেও আমি তা নিয়েই আলোচনা করবো।
বাঙালির চরিত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি চমৎকার মন্তব্য করেছিলেন। বলেছিলেন, এদেশের মানুষ যেমন চৈত্রের প্রচÐ শুষ্কতায় ফেটে চৌচির হওয়া মাটির মতো শক্ত হতে পারে তেমনি আবার বর্ষার কাদার মতো নরম ও কঠিন চরিত্রটি বঙ্গবন্ধু বেশ ভালোভাবেই বিশ্লেষণ করেছিলেন। তবে স¤প্রতি জলবায়ুর উষ্ণতা বৃদ্ধির মতো অর্থাৎ চরম ভাবাপন্ন (আবহাওয়ার) মতো মানুষও চরমভাবাপন্ন বা অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে বলে আমার মনে হয়। অর্থাৎ ব্যবহারে আমরা ভীষণ অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিচ্ছি। কোনকিছুর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে হয়ে উঠছি চরম প্রতিক্রিয়াশীল। শালীনতা, ভদ্রতা, ভব্যতা ও মাত্রাজ্ঞান আমাদের লোপ পাচ্ছে প্রতিদিন আশঙ্কাজনকভাবে। সেটি সিনিয়র রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে বাজারের মাছ বিক্রেতা পর্যন্ত। এখন আমরা কথা বলার আগেই তর্ক করছি। তর্ক শুরুর সাথে সাথে মারামারি করছি, মারামারি করতে গিয়ে তুলকালাম কাÐ বাধাচ্ছি তারপরে ধ্বংস নৈরাজ্য আর হত্যার উৎসব করছি। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সামান্য গায়ে গা লাগলেও ঝগড়া বাধাচ্ছি। সবকিছুতেই চরম আচরণ করার প্রবণতা পেয়ে বসেছে আমাদের। এ থেকে এমনকি আমাদের রাজনীতিকরাও মুক্ত নন।
আমাদের রাজনীতিবিদগণ দেশকে পরিচালিত করেন। ভোট দিয়ে তাদেরকে নেতা নির্বাচন করি আমরা। কোথায় তাঁরা আমাদের জন্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন তা না উল্টো তাদের অমার্জিত, অশালীন কথায় আমাদেরই লজ্জা পেতে হয় প্রতিক্রিয়া প্রকাশে এমন অসহিষ্ণু হলে বুঝতে হবে এ জাতির কপালে দুঃখ আছে। অসহিষ্ণুতার অংশ হিসেবে দেশে যে শুধু রাজনৈতিক হানাহানিই বৃদ্ধি পেয়েছে তা না। সামাজিক ও পারিবারিক সহিংসতাও বৃদ্ধি পেয়েছে সমানভাবে। প্রায় প্রতিদিন দেখুন মাছধরাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ মৃত্যু, ফুটবল খেলাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ মৃত্যু দু’ দল গ্রামবাসীর মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ-মৃত্যু, সামান্য ডাব পাড়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ মৃত্যু। চাচার হাতে ভাতিজা, ভাতিজার হাতে চাচা, স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, পিতার হাতে শিশু পুত্র আরো কতো শত নির্মমতার খবর শুনি। চিত্র দেখি প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। ভদ্রতা ভব্যতা শালীনতা ও মাত্রা জ্ঞান লুপ্ত হতে বসেছে মারাত্মকভাবে। আমি এমনও দেখেছি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষকে ডেকে বলছে। আগুনটা দিন তো সিগারেট ধরাবো। সিগারেট ধরিয়ে বললো ঠিক আছে যান। এমন আচরণ একজন সুস্থ মানুষ করতে পারে তা ভেবে আমি বিস্মিত হই।
বাংলা ভাষায় সবচেয়ে কম ব্যবহৃত দুটি শব্দ ধন্যবাদ ও মাফ করবেন। কার আগে কে লাইনে দাঁড়াবে, কাকে কে কনুই দিয়ে ধাক্কা দেবে তার প্রতিযোগিতা চলে সারাদিন। একজন সাধারণ রিকশা চালকেরও যে আত্মসম্মানবোধ থাকতে পারে তা আমাদের মনে থাকে না মোটেও।
সমালোচনা যে ব্যক্তি আক্রমণ নয় সে কথা আমরা ভুলে যাই প্রায়-ই। আর সত্যিকার সমালোচকও যে একজন প্রকৃত বন্ধু সে কথাও মনে রাখি না আমরা। যে কারণে দেখছি এখন ‘ব্যাঙকে খাটো, সাপকে লম্বা’ বলা যাবে না অবস্থা। সমালোচনার নামে আজকাল যা হয় তার অধিকাংশ ব্যক্তি আক্রমণ নয়তো দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক বন্ধুদের পরিস্থিতিতো আরো ভয়াবহ। জাতীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে ওখানে যেভাবে কটাক্ষ করা হয় তা রীতিমত অশালীন। আমাদের ভুলে যাওয়া উচিত নয় অন্যকে চরমভাবে অপমানিত করার মধ্যে কোন বাহাদুরি নেই।
আসলে এই রুচিবোধের পরিচয় ওপর থেকে দিয়ে আসা উচিত। যারা সরকার ও পদ পরিচালনা করেন যাঁরা উচ্চ শিক্ষায় প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষকতা করেন। সমাজে যাঁরা বিশেষভাবে সম্মানিত তারা যদি বিনয়, শালীনতা ও মাত্রাবোধের পরিচয় দিতেন সঠিকভাবে তবে তার কিছুটা প্রভাব হলেও সমাজে পড়তো। আসলে মাথায় পচন ধরলে শরীরের করার থাকে না কিছুই।

লেখক : সাংবাদিক