আমাদের নৌপথ নিরাপদ হোক

16

 

সড়ক দুর্ঘটনার পাশাপাশি নৌ দুর্ঘটনা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। পঞ্চগড়ের নৌ দুর্ঘটনা আমাদেরকে শোকাহত করেছে। অনেক মানুষকে আমরা হারিয়ে ফেললাম। নদীপথে এমন মর্মান্তিক দুর্ঘটনা পঞ্চগড় জেলার মানুষ কখনো দেখেনি বলেও অনেকে মন্তব্য করেছেন। রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নৌকাডুবিতে মৃত্যুর ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছেন। টিভি নিউজ এবং সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায় মহালয়া উপলক্ষে করতোয়া নদী পার হয়ে বদ্বেশ্বরী মন্দিরে যাচ্ছিল শতাধিক পুণ্যার্থী। নৌকাটি নদীর মাঝে গেলে মোড় নেওয়ার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ডুবে যায়। এ সময় উপস্থিত জনগণসহ প্রশাসনের লোকজন উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে ২৪ জনের মরদেহ উদ্ধার করে। মরদেহের মধ্যে আটজন শিশু, ১২ জন নারী ও চারজন পুরুষ রয়েছে। এখনো অনেকেই নিখোঁজ রয়েছে।
স্থানীয়দের বরাত দিয়ে পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের সহকারী পরিচালক শেখ মোঃ মাহবুব ইসলাম সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “ইঞ্জিন-বোটটিতে ৫০ জন যাত্রী বহন করার ক্ষমতা থাকলেও ১০০ জনের বেশি যাত্রী ছিল। স্থানীয় একজন সাংবাদিকদের জানান, নৌকাটি চলতে শুরু করার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ডুবে যায়। নৌকাটিতে অনেক যাত্রী ছিল। অনেক মহিলা যাত্রী তাঁদের বাচ্চাদের সাথে নৌকায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।” বিভিন্ন দেশের অনেক জায়গায় দুর্ঘটনা হচ্ছে। নৌযান চালকদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, অদক্ষতা, ফিটনেসবিহীন নৌযান চলাচল করার ‘সুযোগ’ পাওয়াসহ বিভিন্ন নৌযানে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করাই হচ্ছে এসব নৌ-দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। দেশের কোথাও যখন বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মধ্যে নড়াচড়া শুরু হয়। এই নড়াচড়া যেন সব সময় উজ্জীবিত থাকে তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। এসব দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হওয়ার নজির সৃষ্টি করতে হবে।
বিদ্যমান আইনে লঞ্চ দুর্ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির যে বিধান আছে সেখানে যদি কোনো পরিবর্তন আনতে হয় তার সরকারকে বিবেচনা করতে হবে। সারাদেশে নৌপথে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে প্রয়োজন পর্যাপ্তসংখ্যক সৎ, মেধাবী ও দক্ষ নৌ-পুলিশ নিয়োগ করা যেতে পারে । এসবের পাশাপাশি ঈদ, পূজা, বিভিন্ন ছুটি ও উৎসবের সময়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন পরিহারের লক্ষ্যে বিশেষ নৌ-যান সার্ভিসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার দায়রা নদীতে ফেরি দুর্ঘটনায় ৪৭ জনের প্রাণহানি, একই সালে ভোলাগামী এমভি কোকো-৪-এর দুর্ঘটনা, ২০১২ সালে মুন্সিগঞ্জমুখী ২০০ যাত্রী নিয়ে নৌকাডুবি, একই সালে মেঘনা নদীতে এমভি শরীয়তপুর-১-এর দুর্ঘটনা, ২০১৪ সালের এমএল পিনাক-৬ ও এমভি মিরাজ-৪-এর দুর্ঘটনায় ১০৩ জনের মৃত্যু, ২০১৫ সালে পদ্মা নদীতে ফেরি দুর্ঘটনায় ৬৮ জনের মৃত্যু, ২০১৬ সালে কীর্তনখোলা নদীতে লঞ্চ দুর্ঘটনায় মৃত্যু, ২০১৯ সালে বঙ্গোপসাগরে ট্রলার-ডুবিতে মৃত্যু ও গত ২৯ জুনে বুড়িগঙ্গায় ‘মর্নিং বার্ড’ লঞ্চ ডুবে মৃত্যুর দৃশ্য সা¤প্রতিক বছরগুলোর নৌ-দুর্ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
হাওরাঞ্চল এবং দেশের বিভিন্ন নৌ পথে ইঞ্জিনচালিত ছোট বড় অনেক নৌকা যাত্রী ও মালামাল পারাপারে ব্যবহৃত হচ্ছে। এদের বেশিরভাগ যান বা চালকের নেই কোনো সনদ, নেই কোনো অভিজ্ঞতা ও লাইসেন্স। তাদের যত্রতত্র নৌ-চালনায় ছোট বড় দুর্ঘটনা লেগেই রয়েছে। এগুলোর প্রতি নজরদারি জোরদার করতে হবে। ভ্রমণ পিপাসু মানুষ মনের প্রশান্তির জন্য এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলেছে। কখনো সমুদ্রে, কখনো পাহাড়ে, কখনো চা বাগানে অথবা কখনো হ্রদে। শহরের কর্মজীবী মানুষগুলো প্রকৃতির কাছে গিয়ে একান্তে কিছু সময় তাদের প্রিয়জনের সাথে শেয়ার করতে চায়। যারা ছোটবেলা থেকে শহরের পরিবেশে বড় হয়েছেন তাদের অনেকে সাঁতার জানেননা। এই সাঁতার না জানা ব্যক্তিগুলো যখন পর্যটক হিসেবে কোন হ্রদে বা সমুদ্র পথে বেড়াতে যান তখন একটা ভয় থেকে যায়। তাদের ভাড়াকৃত নৌকাটি পানিতে দুর্ঘটনায় পতিত হলে এই সাঁতার না জানা লোকগুলোর অবস্থা খুব খারাপ হয়।
আবার যে সব মহিলা বোরকা অথবা শাড়ি পড়েন তাদেরও সাঁতার কাটতে অসুবিধা হয়। ছোট শিশুদের অবস্থাও একই রকম। তারাও সাঁতার কাটতে পারেনা। লাইফ জ্যাকেট এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এই জ্যাকেটের সাহায্যে দুর্ঘটনা কবলিত মানুষগুলো পানিতে ভেসে থাকার চেষ্টা করতে পারেন। বেশ কয়েক মাস আগে কাপ্তাই লেকে বেশ কয়েকজন পর্যটকের মর্মান্তিক মৃত্যু খুবই দুর্ভাগ্যজনক ছিল। ইঞ্জিন চালিত নৌকা, ট্রলার বা স্টীমারে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট থাকলে পর্যটকরা অনেক নিরাপদ থাকেন। নৌ পথে রাংগামাটি, সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, কাপ্তাই এবং বাংলাদেশের অন্যান্য পর্যটন এলাকাতে ভ্রমণের সময় লাইফ জ্যাকেট বাধ্যতামূলক সাথে রাখার নির্দেশনা থাকতে হবে। যেসব বড় বড় নদীতে প্রতিদিন নৌ পথ ব্যবহার করে মানুষকে কর্ম সংস্থানে যেতে হয় সেসব জায়গায়ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের প্রত্যেক উপজেলায় নৌ চালকদের ডাটাবেইজের আওতায় এনে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের নৌপথ নিরাপদ হোক এটাই প্রত্যাশা। সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও দায়িত্ব আছে। নৌকার যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা থাকতে হবে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অধিক যাত্রীবাহী নৌকাতে না উঠলেই ভালো হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট