আমাদের ঐতিহ্য লুঙ্গি সমাচার

207

 

লুঙ্গি নিয়ে একটা লিখা হতে পারে তা কখনো ভাবিনী। সাহিত্যিক ও সাংবাদিক আনিসুল হক লিখেছিলেন, বিলুপ্ত প্রায় লুঙ্গির গৌরবের দিন ফিরিয়ে আনতে একটি মিশন হাতে নেয়া হবে। এর নাম লুচক। ‘লুঙ্গি চর্চা কেন্দ্র’। আবার হতে পারে, হতে পারে লুঙি পড়া আন্দলোন বা ‘লুপআ’। মজলুম জননেতা মরহুম আবদুল হামিদ খান ভাসানী লুঙ্গি পড়তেন এবং লুঙ্গি আর বেতের টুপি পরিধান করেই তিনি চীন সফর করেন। শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী পুরুষ হলে তিনিও লুঙ্গি পড়ে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে হাজির হন। মায়ানমার,নেপাল ভূটান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়া ছাড়াও লুঙ্গির প্রচলন বেশি দেখা গেলেও মালদ্বীপ, আফ্রিকার অনেক দেশ, পলিনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ, ক্যারিবীয় অঞ্চল এমনকি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতেও লুঙ্গি বেশ জনপ্রিয়। এছাড়াও মাদাগাস্কার, মালাউই, মোজাম্বিক, মরিশাস, জিম্বাবুয়ে কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকায় লুঙ্গি লাম্বা, চিতেঞ্জে, কাপুলানা, পারেওস, জাম্বিয়াস ও কিকোই নামে প্রচলিত রয়েছে। জাপানেও লুঙ্গির প্রচলন আছে। সেখানে লুঙ্গি একটি উৎসবের পোষাক। ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ায় লুঙ্গিকে সারং বলে অভিহিত করা হয়। এ দুই দেশের মানুষেরা লুঙ্গির ভেতর জামা ইন করে পড়েন। এই লুঙ্গির উপরে সোমালিয়ার মানুষের মতো তারা বেল্টও পড়ে থাকেন। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ লুঙ্গি প্রেমে আচ্ছন্ন। আমাদের দেশে বাচ্চাদের খাৎনার সাথে সাথে একটা লুঙ্গি পরিয়ে দিই। কবি ফরহাদ মঝহার কে লুঙ্গি পড়ে ঢাকা ক্লাবে ঢুকতে না দেয়ায় তাঁর প্রতিবাদী লিখা বাংলার বিপ্লবী সাহিত্যে নতুন মাত্রা লাভ করেছে। লুঙ্গি আসলে এক অপূর্ব সৃষ্টি। বিদেশীদের কাছে এটা অষ্টম আশ্চর্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা লুঙ্গির প্রেমে পড়ে লুঙ্গি পরে রিকশা চালিয়ে ফটোসেশান করেন। দেশে ফিরে যাওয়ার সময় অনেক গুলো লুঙ্গি কিনে সাথে নিয়ে যান। কবি সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সেলাই ছাড়া লুঙ্গি পরেন। এ-র এয়ারকন্ডিশনিং ক্ষমতা অসাধারণ। আমাদের মতো আদ্রতার দেশের জন্য খুবই উপকারী। নদীমাতৃক বাংলাদেশে লুঙ্গির উপকারীতা নিয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখেছেন, এই বর্ষা প্রধান নদীমাতৃক দেশে মানুষ লুঙ্গি বা ধুতিকে তাদের পোশাক হিসেবে বেছে নিয়েছে। কবি কায়সার হক এবিষয়ে একটি দীর্ঘ ইংরেজি কবিতাও লিখেছেন। লুঙ্গি নিয়ে বহু প্রবাদ বাক্যও আছে। যেমন- যষ্মিন দেশে যদাচার, কাছা খুলে নদী পার। অনভ্যস্ত লোকজনের লুঙ্গি ব্যবহার নিয়ে কিছু বিড়ম্বনার কথা শুনা গেলেও বিশ্বে লুঙ্গির কদর এখনো প্রবন। ইউরোপ আমেরিকায় অনেক বাংলাদেশীদের ঘরে ঘরে লুঙ্গি পড়ার অভ্যাস রয়ে গেছে। পেন্ট পরে ঘরে চলা ফেরা ও ঘুমাতে অস্বস্তি অনুভব করেন। মানবাধিকার আইনজীবী বন্ধু শরীফ উদ্দিন আমেরিকা যাওয়ার প্রাক্কালে ডজনখানেক লুঙ্গি নিয়ে গেছেন। ভার্জিনিয়ার স্থায়ী বাসিন্দা আমার ছোট মামা শ্বশুর নওশাদ চৌধুরী বলেন, ‘মামা এখানেও আমি বাসায় লুঙ্গি পরিধান করে আরাম পাই। আমি লুঙ্গি ছাড়তে পারিনি।’ লুঙ্গি পরে ছতর ঢাকার কঠিন সংগ্রামের কথা আজো মনে পড়ে। ঘুম থেকে ওঠে দেখি সামনের গেরো পেছনে চলে গেছে। ছতর ঢাকার জন্যে নীচেও একটা গেরো দিতাম। পরে অবশ্য অভ্যস্ত হয়ে যাই। জনপ্রিয় সিপ্লাস অন লাইন টিভির প্রতিষ্ঠাতা ও চীফ এডিটর প্রিয় সাংবাদিক আলমগীর অপু বলেন, ‘কারো কারো লুঙ্গি পরে ঘুমানোর পর নিজের অজান্তে সকালে নাকি গলার মাফলার হয়ে যায়।’ বেশী মজা পেতাম দাদার বাড়ির পুকুরে লুঙ্গির নীচে গেরো দিয়ে তা বেলুনের মতো ফুলিয়ে পানিতে ভাসা, আহা কি আনন্দ। ঢাকা এবং চট্টগ্রাম এর রিকশা ওয়ালারা এখনো লুঙ্গির ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। জব্বারের বলি খেলায় বলিরা লুঙ্গি গোঁজ মেরে কুস্তি ধরতো। আহারে হাডুডু, গোল্লাছুট কত খেলা লুঙ্গি পড়ে। লাঠি খেলাও দেখেছি। সেই যে আমার নানা রংগের দিন গুলো, কোথায় হারিয়ে গেলো। বোতাম নেই, দড়ি নেই, ফিতা নেই, বেল্ট নেই, সেপ্টিপিন নেই, এ এক আশ্চর্য জিনিস কে আবিষ্কার করেন জানিনা যা মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে পরাভূত করে আনাদের কোমরে থাকে কি করে। আমাদের ঐতিহ্যবাহী লুঙ্গি নৃত্য একথারই প্রমাণ দেয়। বিশিষ্ট বেতার ব্যক্তিত্ব ফযল হোসাইন বলেন, আমার মনে হয় লুঙ্গি পরেনা এরকম বাংলাদেশী খুব কমই পাওয়া যাবে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারের অন্যতম প্রধান সংগঠক শব্দসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা বেলাল মোহাম্মদ আমরণ লুঙ্গি পরেই জীবন কাটিয়ে দিলেন। তিনি সাদা লুঙ্গি এবং সাদা ফতুয়া পরতেন নিয়মিত, এমন কি স্বাধীনতার পর বেতারের কর্মকর্তা পদে থেকেও তিনি ওই একই ড্রেসে অফিস করেছেন। কবি আব্দুস সালামকেও দেখেছি একইভাবে। মনে পড়ছে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল প্রাইমারী স্কুলে আমার প্রিয় শিক্ষক কবি মাষ্টার জনাব আলাদীন আলী নুরের কথা, উনি রঙিন লুঙ্গি এবং রঙিন ফুল হাওয়াই শার্ট পরতেন নিয়মিত। কবি ও বিশিষ্ট ব্যাংকার জাফর আলম এর উক্তিটি ভালো লেগেছে। নতুন প্রজন্মের লুঙ্গি বিমুখতা নিয়ে তিনি আক্ষেপ করে লিখেছেন, লুঙ্গি নিয়ে লেখাটি ভাল লাগল। আমরা যারা পুরনো তাঁদের সাথে লুঙ্গির সখ্যতা কতটুকু তা লেখায় সহজে বুঝানো প্রায় অসম্ভব। দেশ বিদেশে যেখানে যাই সাথে লুঙ্গি যাবেই। বিশেষত লুঙ্গি পরিধান ব্যতিত ঘুমানো কঠিন। স্নিপিং স্যুট, টাউজার ইত্যাদিতে অদ্যাবধি মানিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। একবার লুঙ্গিবিহীন চট্টগ্রাম চলে যাই। অগত্যা রেস্ট হাউজে আমার এক বন্ধু কড়কড়ে একটি লুঙ্গি এনে দেয়। অবশ্য দু’চারবার ধোয়া না হলে লুঙ্গি শরীরের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে চায়না। সেবার বেশ বুজেছি লুঙ্গির কদর। তখন থেকে নিজ দায়িত্বে লুঙ্গি লাগেজ বা ব্যাগে নিতে ভুল করিনা। বাংলাদেশ ছাড়া উপমহাদেশের মায়ানমার, ভারতের কয়েক রাজ্য, নেপাল এবং থাইল্যান্ড, মালেশিয়ায় লুঙ্গির প্রচলন প্রচুর। মালেশিয়া, মিয়ানমারেতো লুঙ্গি জাতীয় পোশাকের অন্তর্ভুক্ত। তবে নব প্রজন্ম মনে হয় লুঙ্গি সংস্কৃতি থেকে দুরে ছিটকে পড়ছে। আমার ছেলেকে যতটুকু মনে পড়ে দু’দফায় দুটি লুঙ্গি ক্রয় করে দিয়েছিলাম ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে। কিন্তু না, রপ্ত করাতে পারলামনা। লুঙ্গির সপক্ষে আন্দোলন মনে হয় মন্দ হবেনা। মজলুম জননেতা ভাসানী থাকলে নিশ্চয় সম্মুখ সারিতে থাকতেন। দু একটা সমস্যা ছাড়া লুঙ্গির উপকারিতা বেশী। লুঙ্গি পরা অবস্থায় অভিব্যক্তি লিখলাম। ধন্যবাদ প্রিয় ভাই জিয়া হাবীব। বিষয়টি নিয়ে প্রিয় গবেষক ও আইনের শিক্ষক সাঈদ আহসান খালিদ জাতির সামনে কথা বলে নিজেকে স্বমহিমায় আবার প্রতিষ্ঠা করলেন এবং লুঙ্গি প্রসংগে আলোচনার সুযোগ করে দিলেন। জাযাকাল্লাহ খাইরান। তাঁর এফবি ওয়াল থেকে লিখাটা এখানে কপি পেস্ট করলাম, এক ডজন আধুনিক লুঙ্গি-স¤প্রসারণ: ১. স্যান্ডো গেঞ্জি ও লুঙ্গি থাকে যবে একসাথে, শ্রেষ্ঠ ঘুম হবে সে রাতে। ২. লুঙ্গির মতো বড়ো পরশ পরিধেয় আর নাই। ৩. লুঙ্গিকে ঘৃণাকারী বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য। ৪. ত্রি-কোয়ার্টার থাকলে স্মার্ট হওয়া যায়; কিন্তু লুঙ্গি না থাকলে সুখী হওয়া যায় না। ৫. প্রয়োজনে আচমকা যে গিট খুলিতে প্রস্তুত, লুঙ্গি পরার অধিকার তাহারই। ৬. লুঙ্গি যে না পরে আর লুঙ্গি যে না সহে তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে ৭. প্যান্ট বলে, লুঙ্গি, তুই বড়ো গ্রাম্য লুঙ্গি বলে, ভাই, আমি একারণেই কাম্য। ৮. কোথায় স্বর্গ কোথায় সুখ কে বলে তা বহুদূর, লুঙ্গির মাঝে স্বর্গ-সুখ, লুঙ্গিতেই রাত মধুর। ৯. নিজের লুঙ্গিতে নাই যার মন কে বলে মানুষ তারে, কমিক সেই জন। ১০. লুঙ্গি দেখে কেউ করিস নে ভয় আড়ালে তার আরাম হাসে; খোস-পাঁচড়ায় হারা হাসি লুঙ্গিতেই ফিরে আসে। ১১. মিথ্যে শুনিনি ভাই- লুঙ্গির চেয়ে বড় কোন আরাম আর নাই। ১২. সংসার সাগরে নানা চুলকানির খেলা লুঙ্গি আরামের একমাত্র ভেলা গরমে লুঙ্গি পরুন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থাকুন। বাংলাদেশের লুঙ্গি শিল্প বিকশিত হয়েছে বহু আগে। আড়ং লুঙ্গি সেরা আরাম। দিনাজপুর, শরীয়তপুর-এ বিখ্যাত লুঙ্গি শিল্প বিদ্যমান। বাংলাদেশে লুঙ্গির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজারগুলো হলো নরসিংদীর বাবুরহাটে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে ও টাঙ্গাইলের করটিয়ার। এই বাজারগুলো থেকেই দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা লুঙ্গি কিনে থাকেন এবং পরবর্তিতে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে থাকেন। নরসিংদীর লুঙ্গি এখন দেশের বাজার ছাড়িয়ে ২০০০ সাল থেকে বিদেশেও রপ্তানী হচ্ছে। এদেশের লুঙ্গি মানসম্মত বিধায় তা বিদেশেও রপ্তানি হয়। আমাদের লুঙ্গি শিল্প বিকশিত হোক,জয় হোক লুঙ্গির।
লেখক: আইনজীবী, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী