আব্দুল ওয়ালি খান (১৮৫৬-১৯২৬)

23

পন্ডিত, নৃবিজ্ঞানী ও সংগ্রাহক। জন্ম ১৮৫৬ সালে সাতক্ষীরা জেলার সরুলিয়া গ্রামে। আব্দুল ওয়ালির পিতা আব্দুর রউফ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে একজন মুনসিফ ছিলেন। কর্নওয়ালিস-এর সময়ে মুনসিফ কোর্ট ছিল বিচার বিভাগের সর্বনিম্ন ধাপ এবং তা পরিচালিত হতো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মুনসিফ উপাধিধারী দেশিয় বিচারকবৃন্দের দ্বারা। ১৮৪০ সালের পূর্ব পর্যন্ত ক্ষয়িষ্ণু মুগল শাসনামলে মুনসিফদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান। মৌলবি আব্দুর রউফ ছিলেন এ মুসলিম মুনসিফদের একজন। তাঁর পিতামহ মোল­া নঈম ফোর্ট উইলিয়ম কলেজএর ফারসি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। আব্দুল ওয়ালি তাঁর নিজ গৃহেই ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। প্রাচীন ঐতিহ্যে বিশ্বাসী একজন পেশাদার শিক্ষকের কাছে তিনি ফারসি, আরবি এবং উর্দু ভাষায় বিশেষ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। ইংরেজি শিক্ষার জন্য আব্দুল ওয়ালি কলকাতা মাদ্রাসায় অ্যাংলো পার্সিয়ান বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পাস করার পর তিনি ১৮৮৩ সালে বি.এ পড়ার জন্য কলকাতায় মিশনারিদের দ্বারা পরিচালিত সেন্ট-জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন। ১৮৮৪ সালে আব্দুল ওয়ালি সরকারের ল্যান্ড রেজিস্ট্রেশন বিভাগে রুরাল সাব-রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন। তাঁর চাকুরির কারণেই অধিকাংশ সময়ে তাঁকে মফস্বল এলাকায় কাজ করতে হয়েছিল। চাকুরির শেষ পর্যায়ে ১৯১১ সালে আব্দুল ওয়ালি কলকাতায় রেজিষ্ট্রার অব অ্যাসুরেন্স হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। ওয়ালি খান তাঁর গ্রামে থাকা সময়কে অর্থবহ করে তুলেছিলেন গ্রামীণ জীবন ও সংস্কৃতির নানা চালচিত্র সংগ্রহ ও গবেষণা করে। তিনি গ্রামীণ জীবনের নানাবিধ উপাদান, সাধারণ মানুষের জীবনচর্চা ও বিশ্বাসসহ প্রচলিত লোকধর্ম এবং জাতিভেদ সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।
আব্দুল ওয়ালি তথ্যানুসন্ধান ও পরিসংখ্যান নির্মাণে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে গবেষণা পদ্ধতি হিসেবে প্রয়োগ করেন এবং পাশাপাশি সে সময়ের বিভিন্ন পরিবারে সংরক্ষিত নানা পান্ডুলিপি এবং পুস্তকাদি থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেন। তাঁর এসব গবেষণা কর্মের বিবরণ, ৩৫ টিরও অধিক নিবন্ধে তৎকালীন প্রথম শ্রেণির পত্র-পত্রিকায় যেমন, জর্নাল অব দি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল, ইন্ডিয়ান অ্যান্টিকোয়ারিয়ান, ক্যালকাটা রিভিউ, জর্নাল অব দি অ্যান্থ্রোপোলোজিক্যাল সোসাইটি অব বোম্বে, জার্নাল অব দি বিহার, ওরিষ্যা রিসার্চ সোসাইটি, ইসলামিকা, জার্নাল অব দি মোসলেম ইন্সটিটিউট প্রভৃতিতে প্রকাশিত হয়েছিল। ওয়ালি খান তাঁর এ সব বিবরণে লোকজ সংস্কৃতি, বিশ্বাস, আচার-আচরণ, মুসলিম সমাজের মধ্যে বিরাজিত বর্ণবৈষম্য বা শ্রেণি বিভাজন, ধর্মীয় স¤প্রদায়, জাতিতত্ত¡, লোকধর্ম, সাধু, ফকির এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন যা আজও অনেক পন্ডিত ও গবেষকদের দৃষ্টি বহির্ভূত রয়ে গেছে। তাঁর Ethnological notes on the Muhammadan Castes of Bengal 1904 Journal of the Anthropological Society of Bombay, (Vol. VII, No. 2)-তে প্রকাশিত হয়। এ প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেন যে, ইসলামে জাতিভেদ প্রথা বা বর্ণবাদ না থাকলেও বঙ্গীয় মুসলিম সমাজে জাতিভেদ প্রথা এবং বর্ণবাদ প্রচলিত রয়েছে। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং Census of India (১৯০১) এর বাংলাদেশ বিষয়ক সম্পাদক ও সুপারিন্টেন্ডেন্ট, জাতিতত্ত¡, মিঃ ই.এন. গেইট জাতিতত্ত্ব বিষয়ে Census of India এর চতুর্থ, সপ্তম এবং নবম পরিচ্ছদ লেখার সময় জনাব আব্দুল ওয়ালির বিশেষ সাহায্য ও সহায়তা কামনা করেন।
ওয়ালি খান ইতঃপূর্বে বাঙালি জাতিতত্ত্ব বিষয়ে মি. রিজলে এবং মি. ডালটন এর কতিপয় সিদ্ধান্ত সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেন এবং এ বিষয়ে তাঁর মতামত তিনি Journal of the Asiatic Society of Bengal (LXVII: 1898, LXVIII: 1899, LXXII: 1903) এ প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের সুফি ফকির, বাউল এবং অন্যান্য লোকধর্ম বিষয়ে আব্দুল ওয়ালিই সর্বপ্রথম বিভিন্ন জার্নাল এবং পত্র-পত্রিকায় আলোকপাত করেন। সূত্র: বাংলাপিডিয়া