আবু জাফর শামসুদ্দীন (১৯১১-১৯৮৮)

51

সাংবাদিক, সাহিত্যিক। ১৯১১ সালের ১২ মার্চ ঢাকা জেলার গাজীপুরের দক্ষিণবাগ গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা মোহাম্মদ আক্কাছ আলী ভুঁইয়া; পিতামহ নাদিরুজ্জামান ভুঁইয়া ছিলেন মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরীর শিষ্য ও স্থানীয় প্রতিনিধি। নিজ গ্রামের প্রভাত পন্ডিতের পাঠশালায় আবু জাফরের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয়। ১৯২৪ সালে তিনি জুনিয়র মাদ্রাসা ও ১৯২৯ সালে হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু পরীক্ষা না দিয়েই পড়াশোনা ছেড়ে দেন। দৈনিক সোলতান পত্রিকায় সাব-এডিটর হিসেবে আবু জাফরের কর্মজীবন শুরু হয়। পরে তিনি খুলনা, কলকাতা ও কটকে কিছুকাল সরকারি চাকরি করেন। এর পাশাপাশি তিনি আজাদ, ইত্তেফাক, পূর্বদেশ ও সংবাদ পত্রিকায় বিভিন্ন পদে চাকরি করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ‘অল্পদর্শী’ ছদ্মনামে দৈনিক সংবাদে ‘বৈহাসিকের পার্শ্বচিন্তা’ শীর্ষক সাপ্তাহিক কলাম লিখে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এর আগে তিনি ১৯৬১ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত বাংলা একাডেমিতে সহকারী অনুবাদকের পদে নিযুক্ত ছিলেন।
আবু জাফর প্রথম জীবনে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের (এম.এন রায়) ‘র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির’ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ (১৯৫৭) গঠিত হলে তার প্রাদেশিক সাংগঠনিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ঐতিহাসিক কাগমারি সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির কেন্দ্রীয় আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। আবু জাফর ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী একজন প্রগতিশীল লেখক। উদার দৃষ্টিভঙ্গি, গভীর মানবিকতাবোধ ও সমাজপ্রগতির ভাবনা তাঁর চরিত্রের বিশেষ দিক। তিনি বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ শান্তি পরিষদ, বাংলাদেশ হিউম্যানিস্ট সোসাইটি, বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী পরিষদ, বাংলাদেশ আফ্রো-এশীয় লেখক ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির মতো গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনে উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করেন।
উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়ে আবু জাফরের সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়। তাঁর প্রথম উপন্যাস পরিত্যক্ত স্বামী প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি গল্প এবং প্রবন্ধও রচনা করেন। তাঁর রচনায় গণমানুষের সংগ্রাম ও উদার মানবতাবাদের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা হলো- উপন্যাস: ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান (১৯৬৩), পদ্মা মেঘনা যমুনা (১৯৭৪), সংকর সংকীর্তন (১৯৮০), দেয়াল (১৯৮৫); গল্পগ্রন্থ: জীবন (১৯৪৮), রাজেন ঠাকুরের তীর্থযাত্রা (১৯৭৮), ল্যাংড়ী (১৯৮৪); প্রবন্ধ: চিন্তার বিবর্তন ও পূর্ব পাকিস্তানি সাহিত্য (১৯৬৪), ঝড়পরড়ষড়মু ড়ভ ইবহমধষ চড়ষরঃরপং (১৯৭৩), সোচ্চার উচ্চারণ (১৯৭৭), লোকায়ত সমাজ ও বাঙালি সংস্কৃতি (১৯৮৮) ইত্যাদি। এছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি জীবনী, আত্মজীবনী, নাটক, ভ্রমণকাহিনী এবং স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ রচনা করেন। শিল্পীর সাধনা (১৯৬৭) ও পার্ল বাকের সেরা গল্প (১৯৬৮) তাঁর দুটি অনুবাদগ্রন্থ।
সমাজ ও সাহিত্যক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আবু জাফর বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮), সমকাল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৭৯), একুশে পদক (১৯৮৩), শহীদ নূতনচন্দ্র সিংহ স্মৃতিপদক (১৯৮৬), মুক্তধারা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬) এবং মৃত্যুর পর ফিলিপস পুরস্কার (১৯৮৮) লাভ করেন। ১৯৮৮ সালের ২৪ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।