আবুল হোসেন নব বসন্তের কবি

294

চৌধুরী শাহজাহান

বাঙালি মুসলমান কবিদের মধ্যে প্রথম আধুনিক কবি ছিলেন আবুল হোসেন (১৯২২-২০১৪)। ত্রিশের দশকে তাঁর লেখালিখির সূত্রপাত হয়। তিনি চল্লিশ দশকের বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি ছিলেন। তিনি ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট বাগেরহাট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম মেহেরুননেসা। তাঁর পিতা একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। হোসেনের পৈতৃক নিবাস খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার আইচগাতী ইউনিয়নের দেয়াড়া গ্রামে। তাঁর শৈশব কাটে পশ্চিম বঙ্গের কৃষ্ণনগরে, এরপর কলকাতায় ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশে। তিনি ১৯২৯ সালে সাত বছর বয়সে কৃষ্ণনগর কলিজিয়েট স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন এই স্কুল ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৭ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেন কুষ্টিয়া হাই স্কুল থেকে। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪২ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক ও পরে সমাজ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।
সরকারি চাকরি দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। কর্মজীবনে তিনি উচ্চ প্রদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। কর্মজীবনের শুরুতে প্রথম তিনি কলকাতা আয়কর কমিশনারের অফিসে এক্সামিনার অব অ্যাকাউন্টস পদে যোগদেন। দেশ বিভাগের পর তিনি ময়মনসিংহে সহকারী বিক্রয় কর অফিসার হিসেবে আসেন। ১৯৫০ সালের মাঝামাঝিতে তিনি ঢাকার রেডিও পাকিস্তানে একটি সমপর্যায়ের চাকরিতে যোগ দেন। তারপর তিনি ব্যাংককে সিটো পাবলিক ইনফরমেশন অফিসে ইন্টারন্যাশনাল স্টাফ হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর তিনি সেখান থেকে বাংলাদেশে ফিরে তিনি জনসংযোগ বিভাগে যোগ দেন এবং ১৯৮২ সালে বাংলাদেশ সরকারের যুগ্ম সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি প্রখ্যাত লেখক আকবর উদ্দিনের বড় মেয়ে সাহানার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সাহানা ১৯৯৪ সালে মারা যান। প্রিয়তমা পতœীর বিয়োগের পরও কবি আরো বিশ বছর বেঁচে ছিলেন।
আবুল হোসেন কবিতা চর্চা শুরু করেছিলেন স্কুল জীবন থেকেই। তখন থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চা আর সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠনের লালনে তিনি সময় দিয়েছেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বীন্দ্র পরিষদের সম্পাদক ছিলেন। তাঁর লেখালেখির শুরুর সময়ের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতা হল ডাইনামো, ট্রেন, ডিএইচরেলওয়ে, ঘোড়সওয়ার, ও বাংলার মেয়ে। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির কার্যকরী পরিষদ, পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ডের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদ ও বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। রবীন্দ্র চর্চা কেন্দ্রের সভাপতি ছিলেন। তার গ্রন্থসংখ্যা ২৫টি।
আবুল হোসেনের মাত্র ২১ বছর বয়সে প্রথম কাব্যগ্রন্থ নববসন্ত প্রকাশের পর তিনি নতুন ধারার কবি হিসেবে সুধী পাঠক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য। ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোগ পেয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, জীবনানন্দ দাশ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন, আবদুল কাদির, সুফিয়া কামাল, হুমায়ুন কবির, সৈয়দ মুজতবা আলী, আবু সয়ীদ আইয়ুব প্রমুখ কবি-লেখক-সমালোচকদের সঙ্গে। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ নববসন্ত ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয়। প্রথম জীবনে প্রচুর লিখলে ও পরে আবু সয়ীদ আইয়ুবের পরামর্শে লেখা কমিয়ে দিয়েছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আবু সয়ীদ আইয়ুব বললেন, এতযে লিখছেন, এতে কি লেখার মান ধরে রাখা যায়? আবু সয়ীদ আইয়ুবের কথাটা আমার ভালো লাগলো, আমি গুরুত্ব দিলাম। উনি অনেক বড় মাপের সাহিত্য সমালোচক ছিলেন।’ আবুল হোসেনের সাহিত্য-রুচি গড়ে উঠেছে আইয়ুবের আদর্শে। উত্তরকালে আবুল হোসেন লেখালেখিতে বিরলপ্রজ, সংযত-রুচিশীল শিল্পবোধের পরিচায়ক হয়ে ওঠেন। নববসন্তের পর তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ বিরস সংলাপ (১৯৬৯) প্রকাশিত হয় প্রায় ২৮ বছর পর। তাঁর অন্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে হাওয়া, তোমার কি দুঃসাহস (১৯৮২), দুঃস্বপ্ন থেকে দুঃস্বপ্নে (১৯৮৫), এখনও সময় আছে (১৯৯৭), নির্বাচিত কবিতা (১৯৯৭), আর কিসের অপেক্ষা (২০০০), রাজকাহিনী (২০০৪), অনুবাদ-ইকবালের কবিতা (১৯৫২), আমার জন্মভূমি (১৯৭৮), অন্য ক্ষেত্রের ফসল (১৯৯০), আবুল হোসেনের ব্যঙ্গ কবিতা (১৯৮২), আবুল হোসেনের প্রেমের কবিতা (২০০৮), স্মৃতি কথা-আমার এই ছোট ভুবন (২০০০), আর এক ভুবন (২০০৫)। তাঁর অনুবাদকরা উপন্যাস হচ্ছে- অরণ্যের ডাক। তিনি পার্বত্যের পথে নামক একটি ভ্রমণ কাহিনীও লিখেছেন।
নিরন্তন কবিতা ছাড়াও তিনি অনুবাদ করেছেন অনেক গদ্য ও পদ্য। লিখেছেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক নানা সমালোচনা। আরো লিখেছেন স্মৃতিকথা, ছোটগল্প ও ভ্রমণ বৃত্তান্ত। আবুল হোসেন আধুনিক কবিতার পুরোধা পুরুষ ও পথিকৃৎ। তিনি প্রথম আধুনিক মানসিকতার, চেতনা-অবচেতনার কবি। তিনি ছন্দবদ্ধ সমিল গদ্য কবিতারও পথিকৃৎ ।
কবিতার মতো তাঁর গদ্যেরও আলাদা মূল্য আছে। বিশেষ করে তাঁর স্মৃতি কথাগুলো খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর স্মৃতি কথার বইগুলো হলো-আমার এই ছোট ভুবন (২০০৩), আর এক ভুবন (২০০৫) , কালের খাতায় (২০০৮),স্বপ্ন ভঙ্গের পালা (২০০৯), অপরাহ্নের স্মৃতি (২০১৪)। ইতিহাসের এমন একটাকাল তিনি অতিক্রম করেছেন যার সাক্ষ্য তিনি রেখে গেছেন এই স্মৃতি কথার বইগুলোর মধ্যে। তাঁর বা তাঁর সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের চল্লিশের দশকের যে সামাজিক-রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে বেড়ে-ওঠাতার পরিচয় এই স্মৃতি কথাগুলোতে পাওয়া যাবে। তাঁর সাহিত্য সমালোচনামূলক গদ্য রচনাগুলোও খুবই মূল্যবান। বাংলাদেশের সাহিত্য ভাবনায় সেগুলোর গুরুত্ব, মূল্যায়ন ও আলোচনার দাবি রাখে।
বাংলা সাহিত্যে অবদান রাখার জন্য তিনি ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৮০ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়া তিনি জাতীয় কবিতা পুরস্কার নাসিরুদ্দীন স্বর্ণ পদক, পদাবলী পুরস্কার, কাজী মাহবুবুল্লাহ পুরস্কার ও স্বর্ণ পদক, আবুল হাসানাৎ সাহিত্য পুরস্কার, জনবার্তা স্বর্ণ পদক, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার, জনকন্ঠ গুণীজন সম্মাননা ও জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক সংবর্ধনাসহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।