আবুল মনসুর আহমদের ছোটগল্পে প্রথাবিরোধী চিন্তার ধারা

189

তামাশা নিয়ে তামাশা করার মানুষ এ সমাজে অভাব না থাকলেও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক প্রক্রিয়ায় সমাজের সমস্ত অসঙ্গতি ও চলমান অনৈতিক কার্যকলাপ তামাশার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার মানুষ বিরল।
যে সমাজে নেতাদের পা চেটে বড় হওয়ার প্রতিযোগিতা, যেখানে ধর্মীয় অপসংস্কৃতি প্রধান সমস্যা, যে দেশে রাজনীতির নামে নেতাদের উদর বড় করা হয়, যেখানে ধর্মের নামে হালাল কাজের দোহায় দিয়ে মাজারের দানবাক্স ভরতি করা হয়,ঠিক সেই সমাজেই প্রয়োজন পড়ে প্রথা বিরোধী লেখক আবুল মনসুর আহমদের মতো রম্যরচয়িতাদের।
আপনি যে বিষয়টা সিরিয়াস ভাবে বলতে পারবেন না, যে কথাটা গুরুত্ব দিয়ে জনসভা বসিয়ে নেতা/নেত্রীদের সম্মুখে কোকিল কণ্ঠে মার্জিত ভাষায় আলোকপাত করেও ঠাঁই পাবেন না,ঠিক সেই বিষয়টাই যখন হাসির ছলে ব্যঙ্গ করে উপস্থাপন করবেন;আপনার কথায় সত্য প্রকাশিত হলেও তথাকথিত অসাধু নেতা/নেত্রীগণ রাগ দেখাতে পারবেন না। হাসির ছলে কথার জালে কাউকে খুন করে ফেললেও হয়তো-বা সেটা গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পৌঁছায় না। আর সেকারণেই হয়তো-বা বলা হয়ে থাকে, “হাসি এমন একটি অস্ত্র; যা আপনাকে যেমন খুশি করতে পারে, তেমনি জ্বলন ধরাতে পারে প্রতিপক্ষের মনে।”
বাংলা সাহিত্যে আবুল মনসুর আহমদ এমন একজন স্পষ্টভাষী লেখক যাঁর প্রতিটি লেখায় ফুটে উঠেছে সমাজের নানান সঙ্গতি-অসঙ্গতি,দুঃখ-দুদর্শা,ধর্মীয় অপসংস্কৃতি ও অনৈতিক কার্যকলাপের কথা। তিনি এমন একজন লেখক যিনি সাহিত্য জগতে সত্য প্রকাশের নতুন ভাষা সৃষ্টি করে গিয়েছেন। হাসতে হাসতে কীভাবে সত্য প্রকাশ করা যায়,কীভাবে ব্যঙ্গ করে বাঙালি জাতির অসাধু কার্যকলাপ ফুটিয়ে তোলা যায়,কীভাবে রম্য প্রক্রিয়ায় ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করা যায়,তা হয়তো-বা আবুল মনসুর আহমদের লেখা না পড়লে কখনোই জানতে পারতাম না।
ছোটবেলায় যখন ‘আদুভাই’ গল্পটি পড়েছিলাম,তখন লেখক সম্পর্কে কিছু না জানলেও তাঁর লেখা সৃষ্টিশীল গল্পটি দাঁগ কেটেছিল আমার অন্তরে। দিনে দিনে বুঝতে শেখার পর পরিুত হওয়ার সাথে সাথে ‘আদুভাই’ খ্যাত লেখকের ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থটি পড়ার পর লেখকের প্রতি ভালোবাসার আলাদা জগৎ সৃষ্টি হয় আমার হৃদয়ে।
একটা মানুষ কত চমৎকারভাবে হাসির ছলে সত্য প্রকাশ করতে পারে,তা হয়তো-বা ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থটি না পড়লে আমার জানা হতো না। আয়নায় যেমন মানুষ তার প্রকৃত রূপ দেখতে পায়, দেহের রঙ কালো হলে কালো আর সাদা হলে সাদা-ই ভেসে উঠে,ঠিক তদ্রুপ আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’ গ্রন্থে ফুটে উঠেছে তৎকালীন সমাজের বিভিন্ন অপসংস্কৃতি মূলক চিত্রকর্ম।
অনেক সময় মনে হতে পারে, লেখকের বোধহয় বিশেষ কোন ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী/ সম্প্রদায়ের উপর তুমুল রাগ আছে, যার ফলে এ গ্রন্থটির সৃষ্টি। কিন্তু আসলে তা নয়; তাঁর সমস্ত রাগ-অভিমান অজ্ঞতা, কুসংস্কার আর ভন্ডামির বিরুদ্ধে। নিউটনের তৃতীয় সূত্রের ক্রিয়া- প্রতিক্রিয়ার মতো তাঁর সরস লেখাগুলো পড়ে হাসতে হাসতে যেমন গড়াগড়ি খাবেন, পরক্ষনেই সে হাসির আঁড়ালে থাকা কঠিন কথাগুলো ভাবতে বাধ্য হবেন। মনে হবে ঠিকই তো! এমনই তো হচ্ছে আমাদের সমাজে। যদিও গল্পগ্রন্থটি ১৯৩৫ সালের দিকে তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে,তবুও গ্রন্থটি পড়ার পর আপনার মনে সর্বপ্রথম বর্তমান সমাজের চিত্রই ফুটে উঠবে।
গ্রন্থটি মূলত সাতটি ছোটগল্পের সংকলন। হুযুর কেবলা, গো-দেওতা-কা দেশ, নায়েবে নবী, লীডরে কওম, মুজাহেদীন,বিদ্রোহী সংঘ, ধর্ম রাজ্য ইত্যাদি।
মূল বিষয়বস্তু বলতে ধর্মের নামে ভন্ডামি (যা পূর্বেও ছিল এখনও আছে), সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অজ্ঞতা, কুসংস্কার ইত্যাদি আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’ দিয়ে আমরা যেন তৎকালীন সমাজের চিত্রই দেখতে পাই। কিছু কিছু জায়গায় চরিত্রায়ন কিংবা ডায়লগের ক্ষেত্রে লেখক বেশ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। দুঃখকে পরিহাস হিসেবে, তখনকার রাজনীতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ত্রূটি, সে সময়কার বাঙালি সমাজ ও অসাধু ব্যক্তিবর্গ এবং তাদের মন-মানসিকতা তুলে ধরেছেন আশ্চর্য দক্ষতায়।
স্বার্থের জন্যে মানুষ কীভাবে পশু হয়ে যায়, ধর্মের দোহায় দিয়ে স্বার্থ হাসিল করার তাগিদে মানুষে-মানুষে কীভাবে হাঙ্গামা সৃষ্টি করা যায় ইত্যাদি তৎকালীন সমাজের ধর্মীয় গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা,কুসংস্কার, অপসংস্কৃতি, নোংরা রাজনীতি সবকিছুই যেন হাস্য রসাত্মক প্রক্রিয়ায় চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক।
অনায়াসেই বলা যায়- আবুল মনসুর আহমদ সমকাল, সমাজ, জনগণ ও রাজনীতি সচেতন গল্পকার। সমাজের অতি-নিকটে কথকের বসবাস। জীবনের কঠিন বাস্তবতায় পায় হেঁটে চলায় নানা অণুঘটনা ভীড় করেছে তার অভিজ্ঞতার ডালিতে। আর খোলা চোখে দেখা ঘটনাপুঞ্জ ও চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে তাঁর সাহিত্য কর্মে, তার মধ্যে ‘আয়না’ গ্রন্থটি উল্লেখযোগ্য। ‘আয়নার ফ্রেম’ নামক ভূমিকায় কাজী নজরুল ইসলাম স্পষ্ট ধারুা দিয়েছেন- “এমনি আয়নায় শুধু মানুষের বাইরের প্রতিচ্ছবিই দেখা যায়। কিন্তু আমার বন্ধু শিল্পী আবুল মনসুর যে আয়না তৈরি করেছেন, তাতে মানুষের অন্তরের রূপ ধরা পড়েছে। যে সমস্ত মানুষ হরেক রকমের মুখোস পরে আমাদের সমাজে অবাধে বিচরু করছে আবুল মনসুরের আয়নার ভেতরে তাদের স্বরূপ মূর্তি বণ্য মন্দিরে, মসজিদে, বক্তৃতার মঞ্চে, পলিটিকসের আখড়ায়, সাহিত্য সমাজে বহুবার দেখেছি বলে মনে হচ্ছে।” [সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার]
এছাড়াও লেখকের আরো তিনটি অন্যতম ব্যঙ্গরচনা ‘ফুডকনফারেন্স’, ‘আসমানি পর্দা’ ও ‘গালিভরের সফরনামা’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলো যেন এ সমাজের চরম বাস্তবতার চিত্র ফুটিয়ে তোলে। শতাব্দির পর শতাব্দি কেটে গেলেও হয়তো-বা তাঁর গল্পের বাস্তব কথাগুলো থেকে যাবে সবার অন্তরে। লেখক যে অসাধারু দক্ষতায় রক্ষণাত্মক ভঙ্গিমায় হাসির ছলে সত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে গিয়েছেন,তা হয়তো-বা চিরকাল অমর থেকে যাবে ভক্তদের হৃদয়ে।
লেখকের ‘ফুডকনফারেন্স’ গ্রন্থের প্রতি মুগ্ধ হয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় বলে গিয়েছেন, “‘ফুডকনফারেন্স’ গ্রন্থটির মাধ্যমেই আবুল মনসুর আহমদ অমর হয়েছেন।”
লেখকের চমৎকার রচনাশৈলী যেমনি ভাবে মুগ্ধ করেছে সবাইকে,ঠিক তেমনিভাবে সমাজের অনৈতিক কার্যকলাপের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে।
প্রায় নয়টি গল্পের সমন্বয়ে ‘ফুডকনফারেন্স’ গ্রন্থটি রচিত হয়েছে। যেখানে ফুটে উঠেছে হিন্দু-মুসলিম সভ্যতা,সংস্কৃতি, বেহায়াপনা, সামাজিক বৈষম্য, অসাধুদের অনৈতিক কার্যকলাপ, বাঙালি জাতির হীনমন্যতা, নীচু মন-মানসিকতা,কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি।
লেখক ব্যঙ্গ করে বাঙালি জাতির চলমান অপসংস্কৃতি ফুটিয়ে তুলেছেন বিরল সাহসিকতায়।
বাঙালি ব্যবসায়ীদের অসাধু কার্যকলাপের মাধ্যমে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বিনাশ,তাদের প্রতিবেশী ও এক সময় তারা নিজেরাই কীভাবে নিজেদের বিপদ ডেকে আনে তার চমৎকার বিবরু তুলে ধরা হয়েছে ‘সায়েন্টিফিক বিজনেস’ নামক গল্পটিতে। যেখানে বাঙালিদের ধূর্ততা তাদের অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল; এবং এক সময় তাদের এমন অবস্থা দাঁড়ায় যে,তাদের মৃত্যুর পর কান্না করার জন্যেও অবশিষ্ট থাকে না কেউ। তাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে গ্রষ্টা পুরো জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেন পৃথিবী থেকে। তাদের অপকর্ম্মের ছাপ এতটাই নিকৃষ্ট ছিল যে,তাদেরকে গ্রহণ করার মতো অবশিষ্ট ছিল না কেউ ধরুীতে।
প্রথা বিরোধী এমন অসাধারু আর্টিকেল লেখক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর গল্পগ্রন্থে ফুটিয়ে তুলেছেন হাসির ছলে। যা তৎকালীন সমাজে চলমান দুর্দশাগ্রস্ত সংস্কৃতির বৈপরীত্যে বিপ্লবের ধ্বনি সৃষ্টি করে।
লেখক আবুল মনসুর আহমদ তাঁর কলমের আঁচড়ে অপসংস্কৃতির দেয়াল ভেঙে সংস্কৃতির পতাকা উত্তোলনের যে চিত্র এঁকে গিয়েছেন,তা যুগ যুগ শিক্ষা হিসেবে থেকে যাবে সকলের অন্তরে। নোংরা রাজনীতির কবলে সমাজের নিভে যাওয়া প্রদীপের আলো সঞ্চালনে যে আশ্চর্য ভূমিকা রেখে গিয়েছেন তিনি,তা হয়তো-বা বর্তমান বাংলা জননীর উৎকৃষ্ট আদর্শ। দলবাজি, বিভেদ,দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ভেদাভেদ ইত্যাদি অসভ্যতার জগত থেকে বেরিয়ে এসে সভ্যতার বাতি জ্বালাতে আবুল মনসুর আহমদের জুড়ি নেই।
তিনি নিজেও একসময় লাল তুর্কী টুপি মাথায় পরে মোহাম্মদীদের পক্ষ নিয়ে তর্কে শামিল হয়েছেন। অতঃপর নিজের ভুল বুঝতে পেরে ধর্মের নামে সকল ভন্ডামি উচ্ছেদ করতে সাহসিকতার সাথে এগিয়ে যান সত্যের পথে। ব্যক্তিগত জীবনে সত্যের পথে চলমান প্রথার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে নানান বাঁধা বিপত্তির সম্মুখীন হলেও পিছপা হননি কিছুতেই। তাঁর সমস্ত রচনাতে পীর পূজারী,মাজার পূজারী, ধর্ম ব্যবসায়ী ও মানুষে-মানুষে বিভেদকারীদের বিপক্ষে হাস্যরসাত্মক ভাবে আক্রমণাত্মক তলোয়ারের প্রতিবাদী স্লোগান ভেসে উঠেছে। তিনি যে চলমান নোংরা প্রথার ঘোর বিরোধী, তা তাঁর লেখার মাধ্যমেই ফোটে উঠেছে বারংবার।
গল্প লিখতে গিয়ে লেখক আবুল মনসুর আহমদ ব্যঙ্গ করে গরু, মহিষ,ছাগল,কুকুর ইত্যাদি বিভিন্ন পশুর চরিত্রায়ন ঘটিয়েছেন বহুরূপে। লেখক তাঁর লেখনীর যাদুকরী কৌশলে পশু চরিত্রের মাধ্যমে যেমনি ভাবে পশুদের জীবনের আর্তনাদ ফুটিয়ে তুলেছেন, ঠিক তেমনিভাবে সমাজের কিছু মানুষ যে পশুর চেয়েও অধম হয়ে গিয়েছে তার রূপরেখা চমৎকার ভাবে অঙ্কন করে গিয়েছেন। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাথেও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
মানুষের লোভ-লালসা,অহংকার-দাম্ভিকতা ও নীচু মন-মানসিকতা তাদেরকে যে পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট করে তোলে তার চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায় আবুল মনসুর আহমদের রচনায়। মাওলানা সেজে সমাজের সমস্ত ভালো কাজের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করে স্বার্থ হাসিল করার যে নোংরা ধর্মব্যবসার প্রচলন,তার বিরুদ্ধে লেখকের ব্যঙ্গ করা গল্পগুলো যেন আজও সমস্ত ধর্ম ব্যবসায়ীদের আঘাত করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। লেখকের রাজনৈতিক জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে,জীবদ্দশায় বহু রাজনৈতিক সংঘটনের সাথে যুক্ত ছিলেন তিনি।
আর সেকারণেই হয়তো-বা রাজনীতি সম্পর্কে তাঁর ছিল আশ্চর্য দক্ষতা। তিনি ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ স্বৃতিকথায় চমৎকারভাবে রাজনীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে যারা জনমানবকে অধীকার থেকে বঞ্চিত করে এসেছে,তাদের বিরুদ্ধে লেখক প্রতিবাদ করে গিয়েছেন আজীবন। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি গঠনে, ধর্মের নামে অরাজকতা বন্ধ করণে, মুসলিম সমাজের অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূরীকরণে লেখক আবুল মনসুর আহমদ কাজ করে গিয়েছেন অনবরত। পেশায় একজন আইনজীবী হওয়া স্বত্বেও তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে ছাপিয়ে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন রম্যরচয়িতা হিসেবে। যিনি তাঁর প্রতিটি লেখায় পরিহাসের সুরে অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন প্রতিনিয়ত। সমাজের সমস্ত অন্যায়,অত্যাচার,দুঃখ-দুদর্শা,পাপাচার, নোংরা রাজনীতি ও ধর্মীয় গোঁড়ামির কথা হাস্যরসাত্মক ভাবে ফুটিয়ে তোলার দিক দিয়ে তাঁর মতো অবদান রাখতে পারেনি কেহ। একজন সৎ ও আদর্শ সাংবাদিক হওয়ার পাশাপাশি কলমের আঁচড়ে, গল্পের বাহানায় হাসির ছলে সত্য প্রকাশে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর সমস্ত লেখনী তৎকালীন প্রথার বিরুদ্ধে জাগরু সৃষ্টি করলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটকেই যেন ইঙ্গিত করছে বারবার। মনে হয়, তিনি যেন বর্তমান সমাজের আদর্শ।
তাঁর গল্প পড়লেই বর্তমান সমাজের চিত্র ভেসে উঠে বারবার। সমাজে চলমান অন্যায়,অবিচার,দুর্নীতি, নোংরা রাজনীতি আর ধর্মব্যবসার চিত্রগুলো সামনে আসলেই মনে পড়ে লেখক আবুল মনসুর আহমদের কথা। মনে হয়, লেখক যদি বর্তমান যুগে জন্মাতেন তাহলে হয়তো-বা তাঁর সৃষ্টিশীল রচনার মাধ্যমে ভেঙে দিতেন অপকর্ম্মের তালা,উন্মোচন করতেন অসাধুদের মুখোশ, আর রুখে দিতেন সকল অরাজকতা।
প্রতিবাদী লেখক আবুল মনসুর আহমদ ১৮৯৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহের ত্রিশালে জন্মগ্রহন করেন এবং ১৮ মার্চ ১৯৭৯ সালে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে রেখে গিয়েছেন অসংখ্য স্বৃতি;যা তাঁকে বারবার মনে করাতে বাধ্য করে।
বর্তমান সমাজের দিকে তাকালে নিজের অজান্তেই লেখক আবুল মনসুর আহমদের কথা মনে পড়ে যায়।মনে হয়, সমাজের সমস্ত অপকর্ম্মের তালা ভেঙে দেয়ার জন্যে তৎকালীন সময়ের(১৯০০-১৯৯০) মতো এ যুগেও প্রয়োজন রয়েছে একজন আদর্শবান আবুল মনসুর আহমদের। যিনি তাঁর কলমের আঁচড়ে এ সমাজে চলমান অপসংস্কৃতির কথা তুলে ধরবেন, তুলে ধরবেন রাতের আঁধারে ঘটমান সকল নোংরা অপকর্ম্মের কথা। রাজনীতিকে যারা মানুষ মারার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে,দিন দুপুরে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যারা ধর্ষনের সেঞ্চুরি করছে,যারা কি-না ধর্মের দোহায় দিয়ে নিত্য নতুন অপকর্ম্ম করে বেড়াচ্ছে; অন্ততপক্ষে তাদের মুখোশ উন্মোচন করার জন্যে হলেও প্রয়োজন রয়েছে আরেকজন আবুল মনসুর আহমদের।
আজ লেখকের শূন্যতা অনুভব করছে বাংলা জননী, লেখকের কলম নিঃসৃত প্রতিবাদী স্লোগান মাখা রম্যরচনার অভাব অনুভব করছে বাংলা সাহিত্য। তাঁর সমস্ত গ্রন্থ যে বাংলা মায়ের অধিকার নিয়ে কথা বলতো,কথা বলতো আপামর জনতার হয়ে, ভেঙে দিতো দুর্বৃত্তদের কালো হাত। তাঁর লেখনী যেমন সমাজ সংস্করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে,ঠিক তদ্রূপ পাঠকগণও পেরেছে রম্যরচনায় ডুবে গিয়ে প্রাণ খোলে হাসতে। আর সেকারণেই হয়তো-বা প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলে গিয়েছেন, “ভাষার কান মলে রস সৃষ্টির ক্ষমতা আবুল মনসুরের অসাধারু।
আবুল মনসুরের ব্যঙ্গের একটা অসাধারু বৈশিষ্ট্য এই যে, সে ব্যঙ্গ যখন হাসায়, তখন হয় সে ব্যাঙ। কিন্তু যখন কামড়ায়, তখন সে হয় সাপ; আর সে কামড় গিয়ে যার গায়ে বাজে,তার মুখের ভাব হয় সাপের মুখের ব্যাঙের মতই করুন।”