আবুল কালাম আজাদ ভাষা সংগ্রামী ও গুণী শিক্ষক

97

সৈয়দ শিবলী ছাদেক কফিল

আবুল কালাম আজাদ একজন গুণী শিক্ষক, আদর্শ সমাজ সংস্কারক, নিবেদিত মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব ও বীর ভাষা সৈনিক। জাতি গঠনে তাঁর অবদান ছিল স্মরণযোগ্য। পল্লী অঞ্চলের তেমনি বহু কৃতী ও গুণী মানুষ বিনা কদরে আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছেন। তিনি (আবুল কালাম আজাদ) চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক জিএস ছিলেন। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ছাত্রনেতৃত্ব, ভাষা আন্দোলন, সমাজসেবা ইত্যাদিতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন।
আবুল কালাম আজাদ চট্টগ্রাম সদর দক্ষিণ মহকুমার তৎকালীন পটিয়া (চন্দনাইশ) থানার উত্তর হাসিমপুর গ্রাামে ১৯২৫ ইংরেজি সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবদুল আজিজ ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের আাদর্শ ব্যবসায়ী। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি গ্রামের বাড়ির মক্তবে। কয়েক বছর পর বাবার সাথে রাঙামাটি চলে যান। ওখানকার রাঙামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। নিজ প্রতিভা ও কৃতিত্বের গুণে তিনি শিক্ষকদের কাড়েন। রাঙামাটির তৎকালীন ডিসি তাঁর আবুল কালাম’র সাথে আাজাদ জুড়িয়ে দেন। এরপর তিনি আবুল কালাম আজাদ নামে পরিচিত হন। ঐ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর মেডিকেল স্কুলে ভর্তি হন। এক বছর পর চিকিৎসা শাস্ত্রে আগ্রহ হারিয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হন। ওখানেও বাজিমাত। সুন্দর সুঠামদেহী আবুল কালাম আজাদের ইংরেজি সাহিত্যে দখল ছিল। মাতৃভাষা বাংলা সাহিত্য ও উর্দুতে ছিলেন মেধাবী। সাহিত্য চর্চা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ইংরেজিতে বক্তৃতা ইত্যাদিতে তাঁর যথেষ্ট প্রতিভা ছিল।
রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়ে ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র লীগের চট্টগ্রাম জেলার নেতা হন। ১৯৪৮ সালে তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ঐ চট্টগ্রাম কলেজেই বিএতে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসেেদর জিএস নির্বাচিত হন। ঐ সময় কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক আবু হেনা। অধ্যক্ষই ছিলেন পদাধিকার বলে প্রেসিডেন্ট। চৌধুরী শাহাবুদ্দীন আহমদ খালেদ, শামসুদ্দীন মোহাম্মদ ইসহাকসহ অনেক বরণ্য ব্যক্তি এ কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি স্নাতক পাস করেন ১৯৫২ সালে ।
বৃটিশ থেকে ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টি হলে তিনি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ- চট্টগ্রাম জেলা শাখার সেক্রেটারি মনোনীত হন। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ১৮ দিনের মাথায় প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের নেতৃত্বে ঢাকায় তমদ্দুন মজলিস গঠন হলে এতে আবুল কালাম আজাদ যোগ দেন। চট্টগ্রামসহ সারাদেশে উপর্যুপরি কর্মসূচির তমদ্দুন মজলিশকে তাঁরা এগিয়ে নেন। এ সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়ে বিভিন্ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন ত্বরান্বিত করেন তিনি।
পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রী ১৯৪৯ ইংরেজি ১২ ডিসেম্বর তারিখে চট্টগ্রাম কলেজ পরিদর্শনে আসেন। এ সময় তাঁর পরিকল্পনায় শিক্ষা, ব্যবসা, বাণিজ্য সম্পর্কিত বিবিধ প্রশ্নাবলী সম্বলিত ইস্তেহার (খোলা চিঠি) বিলি করা হয়। সার্কিটের হাউস যাওয়ার সময় এ ইস্তেহার মন্ত্রীর দৃষ্টিগোচর হলে কলেজ অধ্যক্ষকে ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন মন্ত্রী।
আবুল কালাম আজাদ তমদ্দুন মজলিসের সকল কাজ ঢাকার সাথে সমন্বয় করে চট্টগ্রামে বাস্তবায়ন করতেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রæয়ারি আহুত হরতাল পালনের জন্য প্রচারপত্র ছাপিয়ে বিলি করেন। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম আহবানে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে অংশ নিতে তিনি ১৯ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকায় যান। তাঁর ছোটভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রনেতা মোহাম্মদ সোলায়মান (অধ্যক্ষ মোহাম্মদ সোলায়মান)সহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং-এ যোগ দেন। ২০ ফেব্রæয়ারি সন্ধ্যা থেকে এক মাসের ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ৯৪ নবাবপুরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় ১৪৪ ধারা না ভাঙার এবং ৪৩/১, যোগীনগরে অনুষ্ঠিত ছাত্র সমাজের সভায় ১৪৪ ভাঙার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়। তারা দু’সভায় উপস্থিত ছিলেন। তবে ১৪৪ ধারা ভাঙার ব্যাপারে মতামত দেন। ২১ ফেব্রæয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেতদের মধ্যে তারা উপস্থিত ছিলেন এবং মিছিলে অংশ নেন। ১৪৪ ধারা ভেঙে যে মিছিল হয় তাতে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। তারা আহত হন, মোহাম্মদ সোলায়মান একটু বেশি। গ্রামের বাড়িতে রটে যায়, তাঁরা দুই ভাই ঢাকায় নিহত হন। ২৫ ফেব্রæয়ারি আবুল কালাম আজাদ বাড়ি ফিরলে গণমানুষের মধ্যে আস্থা ও স্বস্তি ফিরে আসে। তার অনুসারিরা আরও বেশি উদ্দীপ্ত হন।
বরণ্য সংগ্রামি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলে এতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন আবুল কালাম আজাদ। তিনি কর্মজীবনের জীবনের শুরুতে ঢাকার জিনজিরা আপগ্রেড ইনস্টিটিউটে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবনে যোগ দেন। তখন প্রধান শিক্ষক হতে গেলে বিএড কিংবা ১২/১৫ বছরের অভিজ্ঞতাও লাগত না। তখন গ্রাজুয়েট লোককে সংখ্যা ছিল খুব কম। তারপর পাঁচ পাঁচটি স্কুলে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর মেজাজ ছিল খুবই গরম। তাই তাঁর ছাত্র-ছাত্রী ও সন্তানেরা প্রায় সময় ভয়ে তটস্থ থাকত। বেশি কথা বলা যেতনা। জিনজিরা আপগ্রেড ইনস্টিটিউটের পর সাতকানিয়া দেওদিঘি উচ্চ বিদ্যালয়, সমাজহিতৈষী উকিল ছিদ্দিক মিয়া প্রতিষ্ঠিত বৈলতলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, উত্তর রাঙ্গুনিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, রাঙ্গুনিয়া খিলমোগল রসিক উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন অতি দক্ষতার সাথে।
আলোকিত জাতি গড়ার জন্য তিনি আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃতই সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন।
চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদ’র সাবেক জিএস, তমদ্দুন মজলিশ সংগঠক, যুক্তফ্রন্ট নেতা ভাষাসৈনিক, স্কাউট লিডার, ক্রীড়া সংগঠক, সাবেক ছাত্রনেতা, ইংরেজির দক্ষ শিক্ষক হিসেবে আবুল কালাম আজাদের প্রশংসা ঢাকা, চট্টগ্রাম সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক স্থানে তাঁকে সংবর্ধনাও দেয়া হয়। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ভক্তকূলের ভালোবাসায় সিক্ত হন।
এ কৃতি পুরুষের একমাত্র পুত্র মাস্টার শাহজাহান আজাদ জানান, পাঁচটি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পালন করে এক প্রকার তাঁর বিরক্তি চলে আসে। এলাকাবাসী তাঁকে চন্দনাইশের গাছবাড়ীয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগ দিতে বললে তিনি প্রধান শিক্ষক নয়, সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার শর্তজুড়ে দেন এবং সহকারী শিক্ষক হিসেবেই যোগ দেন। সর্বশেষ ঐ পদ ও বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০০ ইংরেজি সালের ১১ এপ্রিল উত্তর হাসিমপুর গ্রামের বাড়িতে মৃত্যু বরণ করেন আবুল কালাম আজাদ। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার (আরাকান) মহাসড়কের পূর্ব পাশে উত্তর হাসিমপুর গ্রামে (পুরাতন কলেজ গেইট সংলগ্ন) তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও ছড়াকার