আবার বৃষ্টিবলয়, সঙ্গী শিলাবৃষ্টি ও বজ্রঝড়

191

শীতের বিদায়ের পর বসন্তের প্রথম সপ্তাহেই আগাম কালবৈশাখীর জানান দিয়েছে প্রকৃতি। চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মৌসুমের প্রথম তুমুল শিলাবৃষ্টি ও বজ্রঝড় কেড়ে নিয়েছে দুই শিশুসহ চারজনের প্রাণ।
আমের মুকুল, গাছপালা ও ক্ষেতের ফসলের বুকে রেখে গেছে ক্ষতচিহ্ন। এবার দেশের দিকে ধেয়ে আসছে বছরের তৃতীয় শক্তিশালী বৃষ্টিবলয়। যা সঙ্গী করেছে শিলাবৃষ্টি ও তীব্র বজ্রপাতকে। সবমিলিয়ে এটি চলতি বছরের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শক্তিশালী বৃষ্টিবলয় হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।
এদিকে দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে এবারের আগাম কালবৈশাখীর প্রথম শিলাবৃষ্টির ধরন স্থানীয় বাসিন্দাদের ‘চোখ কপালে’ তুলে দিয়েছে। বিশেষ করে রাজশাহীর পুঠিয়ায় শিলাবৃষ্টির তান্ডবলীলার সাক্ষী হয়ে স্থানীয় প্রবীণরা বলছেন, বিগত ৬০ বছরে এমন ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি তারা আগে কখনও দেখেননি।
গত ১৭ ফেব্রæয়ারি ভোরের এই শিলাবৃষ্টির অসংখ্য ছবি এবং ভিডিওচিত্র গণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ছবিগুলোর দিকে তাকালে দেশের প্রত্যন্ত জনপদের যে কোনও মানুষের চোখ হঠাৎ করে আটকে যেতেই পারে বিস্ময়ে! এমন দৃশ্য আমাদের দেশে খুব একটা পরিচিত নয়। দেখে মনে হবে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার মত শীতপ্রধান কোনও দেশের তুষারপাতের দৃশ্য। শিলাবৃষ্টির তীব্রতা এতোটাই বেশি ছিল যে, গ্রামগুলোতে টিনের চাল ছিদ্র হয়ে ঘরেও শিলা ঢুকে যায়। শিলাবৃষ্টি থামার তিন ঘণ্টা পরও বাইরে চলাচল করা সম্ভব হচ্ছিল না। স্থানীয়রা কোদাল দিয়ে রাস্তায় জমে যাওয়া শিলা সরিয়ে চলাচলের উপযোগী করে। ৩৮ মিনিট স্থায়ী শিলাবৃষ্টিতে ১৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে দিল্লিতে অনেকটা একই ধরনের শিলাবৃষ্টি হয়েছে। ধোঁয়াশা-দূষণের সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দিল্লিতে শিলাবৃষ্টি কখনো-সখনো হয়, কিন্তু এত তীব্র শিলাবৃষ্টি শহরের অনেক বাসিন্দাই আগে দেখেননি। সাথে সাথেই শোরগোল পড়ে যায় সামাজিক মাধ্যমে। বহু লোক ফেসবুক-টুইটার-হোয়াটস অ্যাপে শিলাবৃষ্টির ছবি ও বরফ-ঢাকা রাস্তায় গাড়ি চালানো কিংবা হৈ-হুল্লোড়ে মাতামাতির ছবি পোস্ট করতে থাকেন।
আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত সংরক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণকারী নানা সংস্থার ওয়েবসাইট ঘেঁটে জানা গেছে, গতকাল রবিবার দিবাগত রাতেই বছরের তৃতীয় বৃষ্টিবলয় প্রতিবেশি দেশ ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে দেশের আকাশ নিজের দখলে নেয়ার কথা।
আজ সোমবার থেকে সার্বিক আবহাওয়া পরিস্থিতিতে যার প্রভাব দৃশ্যমান হতে পারে। যা অব্যাহত থাকতে পারে চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিন পর্যন্ত। তবে, বৃষ্টিবলয় কার্যকর থাকার সময়ে দেশের আকাশ মেঘলা থাকলেও কোথাও একটানা বৃষ্টির শঙ্কা নেই। অধিকাংশ এলাকায় বৃষ্টি হতে পারে আকস্মিকভাবে স্বল্প থেকে ও মাঝারি স্থায়ী।
বাড়তি সতর্কতার পরামর্শ দিয়ে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বৃষ্টিবলয়ে যথেষ্ট শিলাবৃষ্টি হতে পারে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট বিভাগের অনেক এলাকায়। পাশাপাশি তীব্র বজ্রপাত ও কালবৈশাখীর তাÐবের শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন অনেকে। সবচেয়ে বেশি শিলাবৃষ্টি ও বজ্রঝড় থাকতে পারে রাজশাহী, নাটোর, নবাবগঞ্জ, পাবনা, রাজবাড়ি, ফরিদপুর, নড়াইল, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা, ঢাকা, সিলেট বিভাগের সব এলাকা, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ, শরিয়তপুর, নায়ায়নগঞ্জ, নরসিংদী, শেরপুর, বরিশাল, ফেনী, চট্টগ্রামসহ আশপাশের এলাকায়। আর তুলনামূলক কম সক্রিয় থাকতে পারে বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায়।
বৃষ্টিবাহী মেঘ ও ঝড় আসবে উত্তর পশ্চিম দিক থেকে। বৃষ্টিবলয় চলাকালীন আকাশ হঠাৎ পরিস্কার হয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ঝড়ের আঘাত হানার পূর্ব লক্ষণ বলে আবহাওয়াবিদরা মনে করেন। এ সময় উত্তর বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকতে পারে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের আবহাওয়াবিদ মো. আরিফ হোসেন পূর্বদেশকে বলেন, ‘প্রতিবছর ২২ ডিসেম্বর উত্তর গোলার্ধে দিনের ব্যাপ্তি কম থাকে। এই তারিখে রাত হয় দীর্ঘ। এর পরপরই সূর্যের অবস্থান বদলে দিন বড় হতে থাকে। সূর্যের কিরণের তেজও বাড়তে শুরু করে তখন থেকে। এর সঙ্গে পশ্চিমা লঘুচাপ এবং পূর্বদিক থেকে বাংলাদেশ ও আশপাশের অঞ্চলের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যেতে শুরু করে। পশ্চিমা লঘুচাপ ও পূর্বদিকের বাতাসের সংমিশ্রণ ঘটলে বজ্রঝড় ও শিলাবৃষ্টির শঙ্কা তৈরি হয়। এমনিতে মার্চ মাসে এ ধরনের ঝড়-বৃষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তবে মধ্য ফেব্রæয়ারি থেকে বজ্রঝড়-বৃষ্টির প্রাক পর্ব শুরু হয়।’
শীতের বিদায়ের পর বসন্তের প্রথম সপ্তাহে গত ১৬ ফেব্রæয়ারি দিবাগত রাত থেকে ১৭ ফেব্রæয়ারি সকাল পর্যন্ত চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ঝড়ো হাওয়া। সেই সঙ্গে ছিল ব্যাপক শিলাবৃষ্টি। শিলাবৃষ্টি যেন তান্ডব চালিয়েছে ফসলি ক্ষেতে। ভোরের এই শিলাবৃষ্টিতে চট্টগ্রামের সীতাকুÐ ও হাটহাজারীর পাশাপাশি রাজশাহী, নাটোর ও হবিগঞ্জের অনেক গাছের আমের মুকুল ঝরে গেছে। নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ও মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে বজ্রপাতে মারা গেছে স্কুলছাত্রসহ চারজন। শিলার আঘাতে আমের মুকুল, সরিষা, মসুর, পেঁয়াজ, আম, ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
আবহাওয়াবিদদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের তালিকায় নতুন করে ঠাঁই করে নেয়া বজ্রপাত ক্রমেই প্রাণসংহারী রূপ নিয়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশে বজ্রপাতও বেড়েছে। শীতের পর কালবৈশাখীর প্রাক মৌসুম থেকে শুরু করে আশ্বিনের শেষ পর্যন্ত ভয়ঙ্কর বজ্রপাতসহ ঝড়-বৃষ্টির শঙ্কা বেড়ে যায়। তাপমাত্রা যত বাড়বে, তত বাড়বে বজ্রপাতের পরিমাণ।
গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে ২০ শতাংশ বজ্রপাত বৃদ্ধি পায়। সে হিসাবে গত ৪০ বছরে প্রায় বজ্রপাতের হার ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। বজ্রপাতের পূর্বাভাস না জানায় হতাহতের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে বলে তারা জানান।
সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি জরিপ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের ১৫টি দেশ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে নবম স্থানে। এছাড়া ১৫টি দেশের মধ্যে ৯টি বিভিন্ন দ্বীপদেশ রয়েছে।
বিদায়ী ২০১৮ সালের বিশ্ব ঝুঁকি প্রতিবেদনে একশ’ ৭২ টি দেশের ভূমিকম্প, সুনামি, হারিকেন এবং বন্যার ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং দুর্যোগ মোকাবিলা করার সক্ষমতা যাচাই করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। জার্মানির রুহর বিশ্ববিদ্যালয়, বোখাম এবং ডেভেলপমেন্ট হেল্প অ্যালায়েন্স নামে একটি জার্মান বেসরকারি মানবিক সংস্থা যৌথভাবে এই গবেষণা পরিচালনার পর এ প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশ করে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) তড়িৎ কৌশল বিভাগের অধ্যাপক অচিন্ত কুমার চক্রবর্তী পূর্বদেশকে বলেন, ‘লাইটনিং ডিটেক্টরের মাধ্যমে আকাশে মেঘ জমার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। যন্ত্রটি যে স্থানে স্থাপন করা হবে, সেখান থেকে চারদিকের ২৫০ কিলোমিটার এলাকার পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব। বজ্রপাতের পূর্বাভাস যদি মেঘ জমার সঙ্গে সঙ্গে দেয়া যায়, তবে হতাহতের সংখ্যাও কমে আসবে।’