আবারও শিশু নিপীড়ন ও হত্যা অপরাধীর বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হোক

13

বন্দরনগরী চট্টগ্রামে বেড়েই চলেছে শিশুদের উপর নৃশংসতা। কখনো ধর্ষণের পর হত্যা, কখনো নির্মম হত্যা, মায়ের বুক থেকে চুরি সবই যেন ঘটছে নিষ্পাপ শিশুদের সাথেই। গত বছর অক্টোবর থেকে ২০২৩ এর মার্চ মাস পর্যন্ত শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৫২টিরও বেশি, শিশু চুরির ঘটনা অন্তত ১৫টি। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয় থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। গত বছর ডিসেম্বরে বন্দরটিলায় ৫ বছরের শিশু আয়াতকে ৬ টুকরা করে হত্যা এবং জামালখান রোডে ৭ বছরের শিশু বর্ষাকে পাশবিক নির্যাতনের পর মরদেহ খালে ফেলে দেয়ার সর্বশেষ দুটি ঘটনা হার মানিয়েছে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও। পাশাপাশি হাসপাতাল থেকে নবজাতক এবং খেলার মাঠ থেকে শিশু চুরির ঘটনাও ঘটছে সমান্তরালে। এসব আলোচিত ঘটনার রেশ না কাটতেই এবার তাদের পরিণতিই বরণ করতে হয়েছে পাহাড়তলীর ওয়ার্লেস-এ মুরগীর ফার্ম এলাকার দশ বছর বয়সী আবিদা সুলতানা আয়নীকে। দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়, গত ২১ মার্চ শিশু আবিদা সুলতানা আয়নী স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পর নগরীর পাহাড়তলী থেকে নিখোঁজ হয়। পরে শিশু আয়নী অপহরণের শিকার হয়েছে অভিযোগ করে নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক শরমিন জাহানের আদালতে এ মামলা করেন তার মা পোশাক কারখানার কর্মী বিবি ফাতেমা। মামলায় তাদের প্রতিবেশি তরকারি বিক্রেতা মো. রুবেলকে আসামি করা হয়। শিশু আয়নী পাহাড়তলী এলাকার আব্দুল হাদি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী। পাহাড়তলীর কাজীর দীঘির পাড় এলাকায় তাদের বাসা। তার বাবা আবুল কাশেমও ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। আসামি রুবেল একই এলাকার মৃত আব্দুল নূরের ছেলে।
অপহরণের অভিযোগে আদালতে মামলার পরদিন গত বুধবার ভোর রাতে আলম তারা পুকুরপাড়ার ডোবা থেকে শিশু আয়নীর বস্তাবন্দী অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করেছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিশন বা পিবিআই সদস্যরা। বিকালে আদালতে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন আসামি মো. রুবেল। আসামি রুবেল পেশায় সবজি বিক্রেতা এবং ভিকটিম আয়নীর প্রতিবেশি। আমরা আশা করি আসামী যখন গ্রেফতার ও অপরাদ স্বীকার করেছে তখন তার বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে আর কালবিলম্ব হবে না। অতীতে নগরীর জামাল খান, হালিশহর, বন্দর ও পাহাড়তলী এলাকায় যেসব শিশু নিপীড়ন ও হত্যাকাÐের ঘটনা ঘটেছে আসামি গ্রেফতার হলেও তাদের পূর্ণাঙ্গ সাজার রায় এখনও হয় নি। বিচার কার্যক্রমের এ দীর্ঘসূত্রতা এবং কঠোর ও সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। তাদের তদন্ত কার্যক্রম দ্রæত না হওয়াসহ মামলার দুর্বল ধারা সংযোজন আসামিরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের গভীর মনোযোগ দেয়া জরুরি। আমরা মনে করি শিশু আয়নীর নৃশংস হত্যাকাÐ সাধারণের মদ্যে নতুনভাবে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েেেছ। মা বাবারা জীবন-জীবিকার দায়ে চাকরি করবে বলে সমাজ তাদের সন্তানদের নিরাপত্তা দিতে পারবে না, এটি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। পবিত্র রমজান মাসের মত একটি সাধনার মাসে এমন ঘটনা যেই বা যারা করতে পারে, তারা নরপিশাচ, তারা মানবতার শত্রæ। তাদের কোন ক্ষমা হতে পারেনা। দ্রæত বিচার আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করাই এখন জরুরি। একই সাথে আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায় রয়েছে এ শিশুদের প্রতি-এটি ভুলে গেলে চলবে না। সরকারের উচিৎ শিশু নিপীড়ন ও হত্যাকাÐ রোধে কঠোর আইনি বিধান প্রয়োগ করা, সমাজ ও পরিবারের দায় হচ্ছে সচেতনতা সৃষ্টি ও নৈতিক শিক্ষায় শিশুদের গড়ে তোলা। আমরা জানি, বিভিন্ন উন্নত দেশে শিশুদের স্কুলেই শিক্ষা দেয়া হয়। ফলে তারা কখনো অপরিচিত কারোর সাথে কোথাও যায় না। এমনকি কোন পরিস্থিতিতে যাবে সেটিও স্কুল থেকেই শিক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন এ শিক্ষাটি শিশুদের দেয়া হয় না। শিশু নির্যাতন, অপহরণ এবং হত্যার প্রবনতা বৃদ্ধির নেপথ্য কারণ চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, সমাজ ও অপরাধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, অপরাধীরা বিভিন্ন মিডিয়া থেকে খারাপ দৃশ্যগুলো দেখে সমাজকে কলুষিত করছে। ইন্টারনেটের অপব্যবহার বন্ধের জন্য প্রচলিত আইনকে সংশোধন করতে হবে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া এসব বিষয় যেন কোনোভাবেই আমাদের শিশু-কিশোররা দেখতে না পায় সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি মনে করেন, শুধু আইন প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতাও জরুরি বলছেন আইনজীবীরা। আমরা মনে করি, অপরাধ বন্ধ করা না গেলে শুধু অপরাধীকে শাস্তি দিয়েই অপরাধ থামানো যাবে না। সব স্তরে একটি কার্যকর শিশু সুরক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।