আবারও শিশু অপহরণে প্রতিবেশী

9

মনিরুল ইসলাম মুন্না

নগরীতে আবারও শিশু অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। অপহরণের এসব ঘটনা প্রতিবেশীর বা পরিচিতজনদের দ্বারা সংঘটিত হওয়ায় বাড়ছে উদ্বেগ-আতঙ্ক। কম বয়সী শিশুরা প্রতিবেশীর হাতে অপহরণ ও ধর্ষণের শিকার হওয়ার সংবাদগুলো প্রকাশ পাওয়ায় সেই উদ্বেগ-আতঙ্ক আরো বেড়েছে। অন্যদিকে উঠকি কিশোর-কিশোরীরাও শিকার হচ্ছেন অপহরণ ঘটনার। সেখানেও সম্পৃক্ততা মিলছে স্বজন-পাড়া-প্রতিবেশীদের। তাদের হাতেই নানানভাবে নির্যাতন হওয়ার এসব ঘটনাকে সচেতনতার অভাব বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল।
তাঁদের মতে, এসব অপরাধ দমনে প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ ও অভিভাবকদের সতর্কতা।
নগরীর জামালখানে ৭ বছরের শিশু মারজানা হক বর্ষাকে ধর্ষণ করে হত্যা, পতেঙ্গায় পাঁচ বছর বয়সী আয়াতকে ধর্ষণের পর ৬ টুকরো করে লাশ ভাসিয়ে দেয়াসহ যত ঘটনা ঘটেছে সবই নিকটাত্মীয়, পরিচিত বা প্রতিবেশী। তারা টাকা, চকলেট, চিপসসহ বিভিন্ন কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে শিশু কিশোরদের উপর এমন এমন বর্বরতা চালায় বলে পুলিশি প্রতিবেদনগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে। ঘটনার পর নেপথ্য কারণগুলো যখন প্রকাশিত হয় তখন সমাজে এর যে প্রভাব পড়ার কথা, যে সচেতনতা সৃষ্টির কথা তা হচ্ছে না কোনোভাবেই। সম্প্রতি বন্দরটিলায় ৫ বছরের শিশু আয়াতকে ৬ টুকরো করে হত্যা এবং জামালখান রোডে ৭ বছরের শিশু বর্ষাকে পাশবিক নির্যাতনের পর মরদেহ খালে ফেলে দেয়ার সর্বশেষ দু’টি ঘটনা হার মানিয়েছে মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও। শুধু তাই নয়, গত দু’মাসে হাসপাতাল থেকে নবজাতক এবং খেলার মাঠ থেকে শিশু চুরির ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১০টি। চলতি বছরে চট্টগ্রামে শিশু নির্যাতনের ঘটনা অর্ধশতেরও বেশি।
এছাড়া গত শনিবার নগরীর বায়েজিদে শিশু অপহরণের ঘটনায় অভিযুক্ত মো. জুয়েল মিয়াকে (২৪) আটক করেছে র‌্যাব ৭ এর হাটহাজারী ক্যাম্পের সদস্যরা। বায়েজিদ বোস্তামি থানার আবাসিক এলাকা থেকে তাকে আটক করা হয়। একইসঙ্গে অপহৃত শিশুটিকেও উদ্ধার করা হয়েছে।
আটক মো. জুয়েল (২৪) সিলেটের বালাগঞ্জ থানার গোয়াইলজুরা বাজার এলাকার মৃত কাশেম মিয়ার ছেলে। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদের জালালাবাদ এলাকার কাশেম কোম্পানির বাড়ির জামাই কলোনির ভাড়া ঘরে থাকতেন।
র‌্যাব জানিয়েছে, অপহৃত শিশুর বাবা পিয়ার মোহাম্মদ (৪৪) একজন ফার্নিচার ব্যবসায়ী। তিনি স্ত্রী ও এক ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বায়েজিদ বোস্তামির জালালাবাদ এলাকায় একটি কলোনিতে ভাড়া বাসায় থাকতেন। সেখানে জুয়েল মিয়ার সঙ্গে পারিবারিকভাবে সম্পর্ক গেড়ে উঠে তাদের। প্রতিবেশি জুয়েলের সঙ্গে পিয়ার মোহাম্মদের ছেলে-মেয়েদেরও সখ্যতা তৈরি হয়। তারা জুয়েলকে ভাই বলে ডাকতো। সেও বিভিন্ন সময় ওই শিশুদের দোকান থেকে চকলেট-চিপস কিনে দিত।
গত শনিবার দুপুরে প্রতিদিনের মতো অন্যান্য শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করছিল পিয়ার মোহাম্মদের ১ বছর ৯ মাস বয়সী মেয়ে সিদরাতুল মুনতাহা। এসময় মেয়েকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি করার এক পর্যায়ে পিয়ার মোহাম্মদ জানতে পারেন তার মেয়েকে প্রতিবেশী জুয়েল কোলে করে দোকানের দিকে নিয়ে গেছে। এরপর অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও জুয়েল এবং তার মেয়েকে কোথাও দেখতে না পেয়ে আতঙ্কিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন পিয়ার মোহাম্মদ।
পরে পরিবারের লোকজন বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজির এক পর্যায়ে জুয়েল ফোন করে জানায়, পিয়ার মোহাম্মদের মেয়ে তার হেফাজতে আছে এবং মেয়েকে সুস্থ পেতে চাইলে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণের দাবি করে জুয়েল। একইসঙ্গে দ্রুত টাকা পাঠানোর জন্য বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দিতে থাকে। আর টাকা তাড়াতাড়ি না পাঠালে তার মেয়েকে আর ফেরত দিবে না এবং হত্যা করে ড্রেনে ফেলে দিবে। পরে অপহৃত শিশুর বাবা পিয়ার মোহাম্মদ বিষয়টি র‌্যাবকে জানালে শিশুটিকে উদ্ধার এবং জড়িত আসামিকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালায়। শনিবার রাতে সাড়ে ৯টার দিকে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি আবাসিক এলাকা থেকে অপহরণকারী জুয়েল মিয়াকে আটক করা হয়। একইসঙ্গে অপহৃত ওই শিশুটিকেও উদ্ধার করা হয়।
র‌্যাবের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. নূরুল আবছার পূর্বদেশকে জানান, জিজ্ঞাসাবাদে আসামি জুয়েল মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে মেয়ে শিশুটিকে অপহরণ করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায় এবং বিভিন্ন প্রকার ভয়ভীতি ও হুমকি দেওয়ার কথাটি স্বীকার করেন। আটক আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বায়েজিদ বোস্তামী থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে শিশু নির্যাতন, অপহরণ এবং হত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির নেপথ্য কারণ চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সিএমপির উপ-কমিশনার (বন্দর) শাকিলা সোলতানা বলেন, কয়েকদিন আগে একটা ঘটনা শুনলাম যেখানে তিন বছরের বাচ্চা শিশুকে পাঁচ বছরের ভাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে বাবা মা কাজে বেরিয়ে গেছেন। অভাবের কারণে তারা এমনটি করেছেন যা কখনো উচিত নয় বলে মনে করি। সুতরাং বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য প্রকৃত অভিভাবক না থাকাতে অপরাধীরা এতে সুযোগ পায়। ফলে অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যার মত ঘটনা ঘটছে। বিভিন্ন উন্নত দেশে শিশুদের স্কুলেই শিক্ষা দেয়া হয়। ফলে তারা কখনও অপরিচিত কারোর সাথে কোথাও যায় না। এমনকি কোনো পরিস্থিতিতে যাবে সেটিও স্কুল থেকেই শিক্ষা দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন এ শিক্ষাটি শিশুদের দেয়া হয় না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানী ও সাবেক উপাচার্য ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী পূর্বদেশকে বলেন, ইন্টারনেটের অপব্যবহার বন্ধের জন্য প্রচলিত আইনকে সংশোধন করতে হবে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া এসব বিষয় যেন কোনোভাবেই আমাদের শিশু-কিশোররা দেখতে না পায় সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
শুধু আইন প্রয়োগই যথেষ্ট নয়, পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতাও জরুরি বলছেন আইনজীবীরা। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী এস এম দিদার উদ্দীন বলেন, অপরাধ বন্ধ করা না গেলে শুধু অপরাধীকে শাস্তি দিয়েই অপরাধ থামানো যাবে না। সামাজিক সচেতনতা, ধর্মীয় অনুশাসন ও অপরাধ করলে অপরাধীকে যে শাস্তি পেতে হয় সেসব বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করতে হবে।