আবদুস সালামের করোনানুভূতি : সময়ের চালচিত্র

35

 

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে আবদুস সালামের (জন্ম-১৯৭২) ছড়া-কবিতার বই করোনানুভূতি। শিরোনামই বলে দেয় আলোচ্য কাব্যের মূল বিষয়বস্তু কি? করোনা নামক ক্ষুদ্র জীবাণু পুরো বিশ্ববাসীকে আতঙ্কিত ও দুনিয়াকে মৃত্যপুরীতে পরিণত করেছে। কেড়ে নিয়েছে লক্ষ লক্ষ তাজা তরুণ মেধাবী প্রাণ। মানুষের জীবন-জীবিকা অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অসংখ্য মানুষ হয়ে পড়েছে গৃহবন্দী ও বেকার। বিশ্ব অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। করোনা ভ্যাকেশনে মানুষ বিনোদন হিসেবে বেছে নিয়েছে মোবাইল ল্যাপটপসহ নানা ইলেকট্রনিকস ডিভাইস। আমাদের আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ করোনানুভূতি। কবি আবদুস সালাম করোনাকালে করোনাকে নিয়ে রচনা করেছেন অসংখ্য ছড়া-কবিতা। তার মধ্যে থেকে ৫৬ টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় ছড়া-কবিতা গ্রন্থটি। সম্ভবত বাংলাদেশে করোনাকে নিয়ে কোনো লেখকের এটিই প্রথম একক ছড়া-কবিতা গ্রন্থ। সে বিবেচনায় কবি আবদুস সালাম ধন্যবাদ পাওয়ার দাবিদার।
এটি লেখকের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। ছড়া-কবিতাগুলো পাঠ করলে মনেই হয় না যে এটি লেখকের প্রথম গ্রন্থ। ছড়ার ছন্দ হচ্ছে স্বরবৃত্ত। কয়েকটি মাত্রাবৃত্তের।সংগত কারণে ছড়া-কবিতাগুলো ছড়ার ছন্দে ছন্দোবদ্ধ। প্রথম পংক্তির সংগে তৃতীয় পংক্তি এবং দ্বিতীয় পংক্তির সংগে চতুর্থ পংক্তির অন্তমিল রেখে কবিতাগুলো রচিত। শব্দ চয়নে কবি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন।
আবদুস সালাম করোনানুভূতি গ্রন্থে আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহারে সফলতা দেখিয়েছেন। তাঁর আঞ্চলিক শব্দের দখল চমৎকার। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের মতো সাহিত্যেও এই ভাষার সফল প্রয়োগ আমরা ইতোমধ্যে বিভিন্ন কবি/ সাহিত্যিকের রচনায় লক্ষ্য করেছি। সালামের তিনটি আঞ্চলিক কবিতাই অসাধারণ। স্মৃতিকাতরতা-সমকালীন বাস্তবতার প্রতিচিত্র কবিতাগুলোতে মূর্ত হয়েছে।
‘মউর দোয়ান’ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেলওয়ে স্টেশনে একটি অতি পরিচিত চায়ের দোকান। এখানে সিঙারা, পেয়াজু, ছনাবুট, পুরি আর চা খায়নি এমন ছাত্র-ছাত্রী খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কবি বলছেন-
“চট্টগ্রামের ভারসিটিতে/শাটল ট্রেনের পরে।/মর্ দোয়ানর্ পরিচিতি /সবার মনে পড়ে। খিদে লাগলে খেতে যেতাম/মউর কাছে যত।/নাসিমা আর সংগীতাতো /বিল দিয়েছে তত।/হঠাৎ গরি মনত্ ফইজ্জি/এতো বছর পরে/এহন্ আঁরা বেগগুন আছি/মউ্ আছে কবরে।”
‘মরার করোনা’ আবদুস সালামের একটি হাস্য-রসাত্মক কবিতা। এ কবিতায় তিনি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দের ব্যাপক ব্যবহার করেছেন। “মানুষ উগ্যা আডি জারগই/মুখত্ ইয়ান্ কিরে/একজনে হর্ ফট্টি ইয়ান্/ন যায়িবা ভিড়ে।/মানুষ ইভার হাচি আইস্যে/জোরে দিইয়ে হাশি।/আরেকজনে ইয়ান্ দেহি/ডাইকতু গেইয়ি মাশি।/ চারমিক্কা ইন্ কি চলের/মানুষ অলে ডরার্/চীনর্ দেশর্ নতুন্ একখান্/অসুখ আইশশি মরার।/এই হতাগান্ উনি এঁরে/মাশি গেল ফরি/মুখুত্ মইধ্যি ফানি মারি/তুলি লইলো অউরি। অউরি হদ্দে কি অঁইয়িদে/এন্ কিয়া গরের্ বউ।/আল্লা আছে আঁরা আছি/ন ডরাইয়ুম কেউ।”
‘আবার আইবু বেয়াগগুনে হঅর্’ কবিতাটিতে করোনার বিষয়-আশয় চমৎকারভাবে চিত্রিত হয়েছে। মাস্ক ব্যবহারে সচেতন হওয়ার কথা এখানে তুলে ধরা হয়েছে। কবি বলেন-
“মানুষ অলর্ ঠশা দেইলি/মেজাজ অই যায় হরা।/মাস্ক ন ফরের ঘুরে বেড়ার্/রাস্তা ঘাটত্ তারা।/-মাস্ক পরো, ঘরত্ থাহো/ প্রচার চলের যত।/মানুষ হদুন্ মাইনতু ন চাঁর্/ঘুরে পঅলর্ মতো।/আবার আইবো বেয়াগগুনে হর্/সতর্ক অই চলি।/নিয়ম মানি,ঘরে থাহি/অইন্যরে তা বলি।”
আবদুস সালামের করোনানুভূতি একটি বিশেষ সময়ের প্রতিচিত্র। এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার আকুতি ও দীর্ঘশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে’ যদি এবার বাঁচতে পারি, করোনানুভূতি, বাঁচার আশায় হাত ধরেছি, মাস্কটা আমরা মুখে রাখি, অমানিশার দিনরাত, দীর্ঘ হলে করোনাকাল প্রভৃতি কবিতায়। “কোলাকুলি বাদ দিয়েছি/দূরে থাকা ভালো।/হাত নেড়েছি বন্ধু দেখে/মুখটা করে কালো।/ফুচকা খেতে এখন সবার/বাইরে যেতে মানা।/ভয় পেয়েছি করোনাকাল/কখন দেবে হানা।” (করোনানুভূতি) পৃষ্ঠা -১০। আবার প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির দোলাচল লক্ষ্য করি মুখ ও মুখোশ, বৈরী সময়, মেঘের ভেতর সূর্য আছে, চোখ ভিজে যায় জলে প্রভৃতি কবিতায়। “মেঘে ঢাকা আকাশ দেখে/ভয় পেলে কি চলে?/মেঘের ভেতর সূর্য আছে/জ্ঞানী গুণী বলে।/—-স্বপ্ন নিয়ে দেশের কথা/ভাবতে হবে আরো/সামনে যেতে ভয় পাবো না/দোষ দেব না কারো।” (মেঘের ভেতর সূর্য আছে, পৃষ্ঠা-১৭)।
‘করোনানানুভূতি’ গ্রন্থের ফ্ল্যাপে কবি, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক মহীবুল আজিজ বলেন, আবদুস সালাম রচিত ছড়া-পদ্য-কবিতার বই করোনানুভূতি এই রুদ্ধতার দিনে বয়ে যাওয়া প্রসন্ন হাওয়ার মতন। শিরোনামই দিয়ে দেয় বিষয়ের সন্ধান। তবে, তাঁর ছড়া-কবিতার উপজীব্য বিষয়বস্তু বিচিত্র। -প্রকৃতির মুগ্ধতা, বিবর্ণতার জন্যে হাহাকার এসবের মধ্যে অন্তর্গত বোধে উঠে আসে গ্রাম, নদী কি বাবা-মাযয়ের স্মৃতি ও সত্তা। আবদুস সালামের এ-বইয়ের আঞ্চলিক ছড়াগুলো ভিন্ন দ্যোতনাসঞ্চারী।-করোনানুভূতি একটি বিশেষ মাত্রিকতাকে শিরোনামে বহন করলেও বইটিতে স্থান পেয়েছে বিচিত্র স্বাদের কবিতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণেচ্ছু ফরাসি যুবক জ্যঁ কুয়ে’কে নিয়েও তিনি লিখেছেন কবিতা। বিষন্নতার প্রতিবেশেও চেতনাকে জাগর রাখবার অধ্যবসায়ী কবি আবদুস সালাম।”
আবদুস সালাম একজন সময় সচেতন কবি। তাঁর কাব্যভাষা সহজ সরল। তিনি করোনার সময়ে ঘটে যাওয়া মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম-ভালোবাসা, মায়ের মমতা, শৈশবের স্মৃতি প্রভৃতি বিষয় -আশয় তাঁর ছড়া-কবিতায় চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। “আমার মাকে মনে পড়ে” কবিতায় কবিকে মায়ের স্নেহমাখা চিত্র আঁকতে দেখি। তিনি আত্মজার মাঝে হারানো মাকে খুঁজে পান। “আমার মাকে মনে পড়ে/সকাল দুপুর সাঁঝে।/মায়ের ছবি আঁকড়ে ধরি/দেখি মেয়ের মাঝে।/ শিশুকালে কোলে নিয়ে/দিতেন যখন খাবার।/স্নেহমাখা হাতটি দিয়ে/আদর পেতাম বাবার।” এরকম আন্তরিক বর্ণনা প্রত্যেক মানুষের শৈশবের কথা মনে করিয়ে দেয়। পাঠক করোনানুভূতি পাঠ করে বিচিত্র ধরনের কবিতার স্বাদ পাবেন বলে আমার বিশ্বাস। কবিকে ধন্যবাদ করোনাকালের সময়কে অভিজ্ঞতার আলোকে তুলে ধরার জন্য। বইটির বহুল প্রচার কামনা করছি। সাথে পরবর্তী বইয়ের প্রত্যাশায় রইলাম।
করোনানুভূতি, প্রকাশক-অক্ষরবৃত্ত,
প্রকাশকাল- ফ্রেব্রুয়ারি ২০২১, প্রচ্ছদ-আল নোমান, মূল্য-১৬০ টাকা।