আবদুল মাজেদ খান (১৯১৯-১৯৭৫)

74

আবদুল মাজেদ খান একজন গবেষক, শিক্ষাবিদ। ১৯১৯ সালের আগস্ট মাসে কলকাতায় জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৩৫ সালে ফরিদপুর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৩৯ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪২ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। মধ্যযুগীয় বাংলার মুসলমান বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি পান।
১৯৪৩ সালে আবদুল মাজেদ খান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউটার হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। পরবর্তী বছর ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রভাষক এবং কলকাতার কারমাইকেল ছাত্রাবাসে সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট পদে নিয়োগ পান। ১৯৪৪ সালে তিনি বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসের অধীনে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে প্রথম প্রফেসর পদে নিয়োগ পান এবং কলকাতার ইসলামীয়া কলেজে শিক্ষাকতা শুরু করেন। পরবর্তীকালে মাজেদ খান সিভিল সাপ্লাইজ বিভাগে যোগদান করেন এবং পশ্চিম বঙ্গের জলপাইগুড়িতে কন্ট্রোলার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গ বিভাগের (১৯৪৭) পর সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তিনি গাইবান্ধা, ফরিদপুর এবং রাজাড়ীতে একই পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে শিক্ষকতা জীবনে ফিরে আসেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬৩-৬৬ সালে মাজেদ খান বিলেতে অবস্থানকালে বাঙালিদের স্বার্থ প্রচারে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য অবলোকন করে তিনি মনে করেন পাকিস্তান স্থায়ী হবেন না। যুক্তরাজ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রদের বিভিন্ন কার্যক্রমে তাঁর সক্রিয় ভূমিকা ছিল। তিনি ২১ ফেব্রæয়ারিতে অনুষ্ঠিত সভাসমিতিতে বক্তৃতা প্রদান করতেন। তিনি লন্ডনে ইস্ট পাকিস্তান হাউজ গঠনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করেন।
১৯৬৬ সালের শেষ দিকে নিউজিল্যান্ডের ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশীয় ইতিহাসে অধ্যাপনার জন্য তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দক্ষিণ এশীয় গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার হোসেন আলীর সাথে যোগাযোগ করেন। তিনি নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার সরকার ও জনগণের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যাপারটি তুলে ধরেন। কলকাতায় অবস্থানরত প্রফেসর এ. আর মল্লিকের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তিনি তাঁর পরিবারের সকল সদস্যসহ কলকাতার বাংলাদেশ পররাষ্ট্র দফতারের সঙ্গে মিলে কাজ করেন। তিনি দূরপ্রাচ্য ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি অস্ট্রেলিয়ার বিরোধী দলের নেতা নরম্যান ক্লার্ক যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং এদেশের পুনর্গঠনের জন্য তিনি উদ্বুদ্ধ হন। ১৯৭২ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ক্লার্ক আবদুল মাজেদ খানের ঘনিষ্ট যোগাযোগ স্থাপন করেন। এই সময়ে নিউজিল্যান্ড বাংলাদেশকে সাভারে একটা দুগ্ধ খামার প্রতিষ্ঠা করার জন্য ২০০টি গরু প্রদান করে। এছাড়াও ২৫ জনের বেশি পাইলটকে নিউজিল্যান্ডে প্রশিক্ষণ দান, অভ্যন্তরীণ নৌপথে চলাচলের জন্য জাহাজ তৈরিতে কারিগরি সহায়তা প্রদান, শতাধিক ছাত্রকে বৃত্তি প্রদান, অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য বড় ধরনের অনুদান প্রদান করে। নিউজিল্যান্ড এবং বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার স্বীকৃতিস্বরূপ নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আবদুল মাজেদ খানকে একটি স্মারক গ্রন্থ উপহার দেন। ১৯৭৩ সালে আবদুল মাজেদ খান এক বছারের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ওয়েলিংটনে ভিক্টোরিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যান। তিনি ওয়েলিংটনে নিউজিল্যন্ড আন্তর্জাতিক মুসলিম এ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। ওয়েলিংটনের মাকারাতে মুসলমানদের জন্য একটি গোরস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকেই প্রথম সদ্য প্রতিষ্ঠিত মাকারার গোরস্তানে দাফন করা হয়।