আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর চিরবিদায় একটি চেতনাজাগরণী কণ্ঠের অমরত্ব লাভ

8

 

মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা যুগের এক বজ্রকঠিন ও সত্যাদর্শী শব্দবিন্যাসী, স্পষ্টভাষী এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতার আপোষহীন চেতনাধারক, কলমসৈনিক একুশের গান ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী আমি কি ভুলিতে পারি…’ এর রচয়িতা ভাষা সৈনিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে লন্ডনের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। জানা যায়, গত কিছুদিন ধরে গাফ্ফার চৌধুরী হাসপাতালে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে সারা বাংলাদেশের মানুষের সাথে দৈনিক পূর্বদেশ পরিবারও গভীরভাবে শোকাহত। দেশে এবং বিদেশে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এক সুপরিচিত নাম। রাজনীতিসহ নানা বিষয়ে তার লেখা মন্তব্য প্রতিবেদন নিয়মিতই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। তার অন্যতম সৃষ্টি একটি কবিতা- ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী, আমি কি ভুলিতে পারি” এই কবিতা গাফ্ফার চৌধুরী লিখেছিলেন ১৯৫২ সালে। দেশে তখন ভাষা আন্দোলন চলছে, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাস্তায় তখন আপামর জনতা। ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি চলে সেই আন্দোলনে। প্রাণ হারান রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতরা। সেইদিনের সাক্ষী গাফ্ফার চৌধুরী। প্রায় এক দশক আগে ডয়চে ভেলেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এক সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, ওই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘সেসময় বাংলাদেশ আন্দোলনমুখর ছিল। কেননা, ভাষা আন্দোলন তো ৫২ সালেই শুরু হয়নি, ১৯৪৮ সালে শুরু হয়, যখন মি. জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন। তারপর এই আন্দোলন গড়াতে গড়াতে ৫২ সালে এসে রক্তাক্ত এক অধ্যায়ের সূচনা হয়।” গাফ্ফার চৌধুরী শহিদ রফিকের মরদেহ দেখেছিলেন। পুলিশের গুলিতে রফিকের মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল। ৫২’র ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ তিনি। কী দেখেছিলেন সেদিন? সেসময় ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী গাফ্ফার চৌধুরী বললেন, ‘‘আমি আরো দু’জন বন্ধু নিয়ে গিয়েছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজের আউটডোর কক্ষে। সেখানে বারান্দায় শহিদ রফিকের লাশ ছিল। মাথার খুলিটা উড়ে গেছে। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম তখন ছাত্র। তিনি তার ক্যামেরায় রফিকের ছবি তোলেন।” একটি লাশ, একটি কবিতা রফিকের মরদেহ দেখে গাফ্ফার চৌধুরীর মনে হয়েছিল, যেন তার নিজের ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে। তখনই তার মনে গুনগুনিয়ে ওঠে একটি কবিতা, ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি”। সেই কবিতা পরবর্তীতে গানে রূপ নেয়। তিনি বলেন, ‘‘এই কবিতায় প্রথমে আব্দুল লতিফ সুর দেন। তারপরে আলতাফ মাহমুদ সুর দেন। আলতাফের সুরেই এটা প্রভাত ফেরির গান রূপে গৃহীত হয়।” পরিবর্তিত বাংলা ভাষাকে আরো সমৃদ্ধ এবং সুগঠিত করতে সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে এক দশক আগে ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন এই গুণী লেখক ও সাংবাদিক। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর; বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থানার উলানিয়ায়। তাঁর মাতা জোহরা খাতুন। পিতা ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী ভূস্বামী হলেও ছিলেন ব্রিটিশশাসিত ভারতের একজন মুক্তিসৈনিক। বরিশাল জেলা কংগ্রেসের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। সদস্য ছিলেন অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির। ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনের সময় তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল। তদানীন্তন কংগ্রেসনেতা, মতিলাল নেহেরুর সেক্রেটারি হিসেবেও কাজ করেছেন ওয়াহেদ চৌধুরী। গাফ্ফার চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন করেছেন ১৯৫৯ সালে। এরপর সাংবাদিকতা করেছেন ঢাকার বিভিন্ন কাগজে। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ‘জয় বাংলা’, ‘যুগান্তর’ ও ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় কাজ করছিলেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর তাঁর লেখা ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। বিবিসি বাংলা বিভাগের দর্শকদের জরিপে এই গান বাংলা গানের ইতিহাসে তৃতীয় সেরা গানের মর্যাদা পেয়েছে। স্বাধীনতার পর, ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য তিনি সপরিবারে লন্ডনে চলে যান। সেখানে ‘নতুন দিন’ নামে একটি পত্রিকা বের করেন। প্রায় ৩৫টি বই লিখেছেন তিনি। নিয়মিত কলাম লিখছেন ঢাকা ও কোলকাতার বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইনে; বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকান্ডের ওপর গাফ্ফার চৌধুরী একটি চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন, ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি। বঙ্গবন্ধুর ওপরেই আরেকটি চলচ্চিত্র, ‘দ্য পোয়েট অব পলিটিকস’ প্রয়োজনা করছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতির জন্য জীবনে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। উল্লেখযোগ্য হল, বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৭), একুশে পদক, ইউনেসকো সাহিত্য পুরস্কার এবং স্বাধীনতা পদক (২০০৯)। তাঁর সৃষ্টিশীল কর্ম ও দেশপ্রেম তাঁকে অমরত্ব দিবে, বাংলার মানুষ চিরকাল স্মরণ রাখবে। আমরা মহৎ এ মানুষটির স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। মহান আল্লাহ তাঁকে বেহেস্ত নসিব করুন।