আবদুল গাফফার চৌধুরী একজন আলোকিত মহীরুহের চিরবিদায়

35

 

স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্বর আরেকটি নক্ষত্র আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিলো। একুশের গানের কিংবদন্তী স্রষ্টা আবদুল গাফফার চৌধুরী আর আমাদের মাঝে নেই ভাবতেই দেশ বিদশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি…’ বিখ্যাত এই গানের রচয়িতা এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক, কলাম লেখক, গীতিকার, সাহিত্যিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ আবদুল গাফফার চৌধুরী ১৯ মে, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ ব্রিটেনের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার ভোরে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের একটি হাসপাতালে মারা যান (ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। ভাষা আন্দোলনে নিহত শহীদদের জন্য বিখ্যাত অমর একুশের এই একটি গান তাঁকে আজীবন বিখ্যাত করে রেখেছিলো। দিনমজুর, ছাত্র, শ্রমিক, রাজনীতিক, সমাজ সংগঠক প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে কাঁপন তুলে দেয়া বিখ্যাত গানটি তাঁকে চির সজীব করে রেখে দিয়েছে। তিনি সাহিত্যিক হিসেবে রাষ্ট্রচিন্তাবিদ, কলামিষ্ট পরিচয়ের বিরাট পরিধির পরেও বিশে^র বাংলাা ভাষাভাষী মানুষের কাছে বিপুল জনপ্রিয়তাধন্য ব্যক্তি ছিলেন। আবদুল গাফফার চৌধুরী তাঁর বর্ণিল জীবনে পুরস্কার, সম্মাননা, জনপ্রিয়তা, মানুষ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতায় নিজেকে নিজেই ছাপিয়ে গিয়েছেন। আজীবন তিনি বাংলাদেশের মুক্তিয্দ্ধু, বঙ্গবন্ধুর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দেশের প্রতি প্রগাঢ় মমত্ববোধ, প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন চেতনাকে ধারণ করে গেছেন নীতি ও আদর্শের প্রতি অবিচল অটল থাকার মধ্য দিয়ে। তাঁর সেই দেশপ্রেম সম্পর্কে বিখ্যাত ছড়াশিল্পী লুৎফর রহমান রিটন বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ , স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ এবং জাতির জনকের বিষয়ে তিনি ছিলেন অতন্দ্র প্রহরীর মতো। আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যুও পর পরই কান চলচ্চিত্র উৎসবে বঙ্গবন্ধু বায়োপিক ‘মুজিব একটি জাতির রূপকার’ চলচ্চিত্রের ট্রেলার উদ্বোধন করতে এসে ফ্রান্সে অবস্থানরত তথ্য মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ শোক জানিয়ে বলেছেন, ‘ভাষাসৈনিক, সাংবাদিক, গীতিকার, কলামিস্ট, সাহিত্যিক ও রাষ্ট্রচিন্তাবিদ আবদুল গাফফার চৌধুরীর মৃত্যু বাংলাদেশ ও বাঙালির জন্য অত্যন্ত বেদনার।’
আবদুল গাফফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদরাসায় ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ঢাকাআবদুল গাফফার চৌধুরী উলানিয়া জুনিয়র মাদরাসায় ক্লাস সিক্স পর্যন্ত লেখাপড়া করে হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএ অনার্স পাস করেন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ অনার্স পাস করেন। আর্থিক অনটনের কারণে উপার্জনকে পথ খুঁজতে থাকেন তিনি। ১৯৫০ সালে ছাত্রাবস্থায় দৈনিক ইনসাফ পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে তিনি সাংবাদিকতা জগতে পা রাখেন।মাত্র ৭০টাকা বেতনে চাকরী শুরু করলেও পরবর্তীতে ১৯৫১ সালে দৈনিক সংবাদে অনুবাদক হিসেবে ১০০টাকা বেতনে যোগ দেন তিনি। ১৯৫৩ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। একই সময়ে ‘মাসিক নকীব’ সম্পাদনা ছাড়াও গাফফার চৌধুরী আিবদুল কাদির সম্পাদিত ‘দিলরুবা’ পত্রিকারও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক নিযুক্ত হিসেবে যোগ দেয়ার পর থেকে সাংবাদিকতা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ফেলেন। একে একে আজাদ অবজারভার পূর্বদেশে সহ নানা পত্রিকায় কাজ করার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হন।সংবাদপত্রে স্বাধীনতা পরবর্তীকাল ছিলো গাফফার চৌধুরীর জন্য স্বর্ণযুগ। মৃত্যুও পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত নিয়মিতভাবে দেশে বিদেশে শীর্ষ সংবাদপত্রগুলোতে চুলচেরা বিশ্লেষণধর্মী কলাম লিখে গেছেন। যা আজো পাঠক মন্তুমুগ্ধের মতো পড়ে যেতেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি বন্ধুবৎসল, ¯েœহপ্রবণ,অসাম্পদায়িক, সৃজনশীল, মানুষের মানবিক চাহিদার প্রতি সম্মান দিতে পারতেন। সহজেই মানুষের সাথে মিশে যেতে পারতেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট ভক্ত অনুরাগী হিসেবে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর যে কোন কলামে, গদ্যে আজীবন তিনি বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তি জনগণের প্রতি ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের নানা অনুষঙ্গ তুলে ধরতেন যুক্তি ও নানা ঘটনা প্রবাহের চমৎকার তথ্য বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনের মাধ্যমে। যাঁর কারণে সারাজীবন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের সংগঠন আওয়ামীলীগের নীতি ও আদর্শ প্রচারকের ভূমিকায় তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। বিদেশে থেকেও আওয়ামীলীগের উন্নয়ন সাফল্যকে তিনি সুষ্পষ্টভাবে কলম ধরেছিলেন জনগণের কাছে। তাঁর আপসহীন নীতির কারণে দুই সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ও জিয়া দীর্ঘদিন অলিখিতভাবে গাফফার চৌধুরীর দেশে আসার পথ রুদ্ধ করেছিলেন। তিনি মোটেও সেসব পাত্তা দেননি কখনো। ১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। এরপ ভিন্ন আঙ্গিকে তার প্রবাস জীবনের ইতিহাস শুরু হয়।
কবিতায় তিনি কালজয়ী,ভিন্নমাত্রার কথাশিল্প, জনগণের চাহিদা সম্পন্ন ক্ষুরধার লেখনী যুগে যুগে তাঁকে উচ্চমাত্রায় নিয়ে গেছে। আপসহীন মনোভাবের কারেেণ তাঁর সময়কাল ছাড়িয়ে কালোত্তীর্ণ হয়ে উঠেছেন সবার কাছে। তাঁর রচিত একুশের অমর গান তাঁকে মহীরূহে পরিণত করেছে। অসম্ভব মেধা, স্মৃতি প্রখরতা, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে নিরেট দেশজ ভাবনা ও অসা¤প্রাদায়িকতার জন্যে তিনি অবিস্মরণীয় হয়ে পাঠক এবং জনগণের কাছেও। তাঁর মৃত্যু প্রতিটি নাগরিককে স্মৃতিকাতরতায় ভোগাবে নিঃসন্দেহে।
বরিশাল জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার এক জলবেষ্টিত গ্রাম উলানিয়ার চৌধুরী বাড়িতে জন্মগ্রহণকারী গাফফার চৌধুরীর বাবা ছিলেন হাজি ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা মোসাম্মৎ জহুরা খাতুন। তিন ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে বড় ভাই হোসেন রেজা চৌধুরী ও ছোট ভাই আলী রেজা চৌধুরী। বোনেরা হলেন মানিক বিবি, লাইলী খাতুন, সালেহা খাতুন, ফজিলা বেগম ও মাসুমা বেগম। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮৮বছর। তিনি জন্মেছেন ১২ ডিসেম্বর,১৯৩৪ খৃষ্টাব্দ। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগতে থাকা এই কিংবদন্তী মুক্তিযুদ্ধ সময়কালীন মুজিব নগর সরকারের নিবন্ধনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা জয়বাংলা পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে গুরুত্বের সাথে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে উপস্থাপন করে গেছেন গুরুত্বের সাথে। কলামিষ্ট হিসেবে তাঁর ক্ষুরধার লেখনী যেমন বিশে^র বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কাছে সমাদৃত তেমনি কথাসাহিত্যিক হিসেবেও তিনি একজন উঁঁচু দরের লেখক ছিলেন। বরেণ্য সাংবাদিক হিসেবে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি বড়দের জন্য স্মৃতিকথা, গল্প উপন্যাস লিখেছেন। ছোটদের জন্যও লিখেছেন অকাতরে। ছাত্র জীবন থেকেই তিনি সাহিত্য চর্চার প্রতি মনোযোগী হন। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন প্রসিদ্ধ সওগাত পত্রিকায় প্রথম গল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যিক তকমা গায়ে মাখেন। আবদুল গাফফার চৌধুরীর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা মোট ৩০টি। গ্রন্থতালিকার মধ্যে রয়েছে চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান (১৯৬০)নাম না জানা ভোর (১৯৬২),নীল যমুনা(১৯৬৪),শেষ রজনীর চাঁদ(১৯৬৭), কৃষ্ণপক্ষ (১৯৫৯), সম্রাটের ছবি (১৯৫৯) সুন্দর হে সুন্দর (১৯৬০), ডানপিটে শওকত (১৯৫৩)। তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ-বাংলাদেশ কথা কয়, (১৯৭২) নাটক- ’একজন তাহমিনা’, রক্তাক্ত আগষ্ট, পলাশী থেকে ধানমন্ডি (২০০৭)। এছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনী ভিত্তিক ‘আমরা বাংলাদেশী নাকি বাঙ্গালী’নামক একটি চলচ্চিত্রের কাহিনী রচনা করেছেন তিনি। এ যাবত যে পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন সেগুলো হলো-বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৭),একুশে পদক (১৯৮৩),ইউনেস্কো পুররস্কার (১৯৬৩), বঙ্গবন্ধু পুরস্কার,সংহতি আজীবন সম্মাননা পদক (২০০৮), লন্ডন,স্বাধীনতা পদক ২০০৯, মানিক মিয়া পদক ২০০৯, যুক্তরাজ্যের ফ্রিডম অব বারা (টাওয়ার হ্যামলেটস) উপাধি, সংহতি আয়োজিতদেও পক্ষ থেকে সংবধর্না প্রদান(ঢাকা ২০০৯)। গাফফার চৌধুরীর এই চলে যাওয়া বাংলা ভাষায় অন্তপ্রাণ লাখো কোটি ভক্ত অনুরাগীর মনকে বিষাদময় করে তুলেছে। সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একজন দিকপাল হারালো। আবদুল গাফফার চৌধুরীর কালজয়ী লেখনী সৃজনশীল ভাবনা নতুন প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে পড়ুক এই প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। সেই সাথে রুহের মাগফেরাত কামনা করে মহান আল্লাহর দরবারে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের সাথে বাংলাদেশের পাঠকও আজ সমব্যথী। সমবেদনা জানাই অন্তরের গহীন থেকে।

লেখক : কবি ও শিশুসাহিত্যিক, কলাম লেখক