আপিল বেঞ্চেও খালেদা জিয়ার জামিন মিলেনি

19

জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দন্ডিত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন সর্বোচ্চ আদালতেও নাকচ হয়ে গেছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ৬ বিচারকের আপিল বেঞ্চ গতকাল বৃহস্পতিবার সর্বসম্মত এই সিদ্ধান্ত দেয়। বিএনপি চেয়ারপারসনের সম্মতি থাকলে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মেডিকেল বোর্ডের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে দ্রুত ‘অ্যাডভানসড ট্রিটমেন্ট’ দেওয়ার পতদক্ষেপ নিতে বলেছে আপিল বিভাগ। জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার সাত বছরের সাজার রায়ের পর হাই কোর্টে আপিল করে জামিন চেয়েছিলেন তার আইনজীবীরা।
অপরাধের গুরুত্ব, সংশ্লিষ্ট আইনের সর্বোচ্চ সাজা এবং বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে খালেদাসহ অন্য আসামিদের করা আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত- এ তিন বিবেচনায় হাই কোর্ট বেঞ্চ গত ৩১ জুলাই আবেদনটি খারিজ করে দিলে খালেদার আইনজীবীরা আপিল বিভাগে আসেন।
আদালতের বাইরে বিএনপিপন্থি ও সরকার সমর্থক আইনজীবীদের পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ আর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে বৃহস্পতিবার শুনানি শেষে আপিল বিভাগ বিএনপি চেয়ারপারসনের আবেদনটির নিষ্পত্তি করে দিল। খবর বিডিনিউজের
খালেদা জিয়ার পক্ষে জামিন আবেদনের শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন ও খন্দকার মাহবুব হোসেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন মওদুদ আহমদ, নিতাই রায় চৌধুরী, মাহবুব উদ্দিন খোকনসহ আরও কয়েকজন।
অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে খুরশীদ আলম খান এবং রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম জামিনের বিরোধিতা করে শুনানিতে অংশ নেন।
আদেশের পর খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, জামিন চেয়ে আমরা আইনি লড়াই চালিয়েছি। সাত বছরের সাজায় জামিন না দেওয়া নজিরবিহীন। এটি সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি কলঙ্কজনক ঘটনা হয়ে থাকবে।
দুর্নীতির দুই মামলায় মোট ১৭ বছরের দন্ড মাথায় নিয়ে কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া গত এপ্রিল থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
এর আগে বিভিন্ন মামলায় জামিন হওয়ায় বিএনপি নেতাকর্মীরা তাকিয়ে ছিলেন জিয়া দাতব্য ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় তার জামিন শুনানির দিকে। এ মামলায় জামিন হলেই তার মুক্তির পথ খুলবে বলে তারা আশা করছিলেন। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালতেও জামিন না মেলায় আপাতত তার মুক্তি মিলছে না।
যা হল আদালতে : হাই কোর্ট এ মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দিলে গত ১৪ নভেম্বর আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবীরা। এর ধারাবাহিকতায় গত ২৮ নভেম্বর আপিল বিভাগ জামিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়া আগে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা জানতে মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন চায়।
গত ৫ ডিসেম্বর বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ চিকিৎসা প্রতিবেদন দিতে না পারায় এজলাসে তুমুল হট্টগোলের মধ্যে তাদের আরও ছয় দিন সময় দিয়ে ১২ ডিসেম্বর আদেশের দিন ঠিক করে আদালত। সেদিনের হট্টগোলের পর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির আদালত কক্ষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে নেয় হয় কড়া নিরাপত্তা।
আপিল বিভাগের তালিকাভুক্ত না হলে আইনজীবীদের আদালত কক্ষে ঢুকতে বাধা দেওয়ায় সকালে আদালত বসার পর প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেনে খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।
তিনি অভিযোগ করেন, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সবাই ভেতরে ঢুকতে পারলেও বিএনপিপন্থিদের তালিকাভুক্তি আছে কি না তা দেখা হচ্ছে। এমনকি তার জুনিয়রকেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
পরে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও বিএনপি চেয়ারপারসনের অন্যতম আইনজীবী জয়নুল আবেদীনের মতামতের ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি দুই পক্ষের ৩০ জন করে আইনজীবী থাকার অনুমতি দেন।
ঠিক হয়, খালেদা জিয়ার মামলার শুনানি শুরুর আগে ৫ মিনিট সময় দেওয়া হবে। তখন সবাই বেরিয়ে গিয়ে আবার ঢুকবে। উভয় পক্ষের ৩০ জন করে আদালতকক্ষে থাকতে পারবে।
কিন্তু সকাল ১০টার কিছু সময় পর আপিল বিভাগে খালেদার মামলার শুনানি শুরু হলে দেখা যায় কোনো পক্ষই বেঁধে দেওয়া সংখ্যা মানেনি। এ নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে প্রধান বিচারপতি দুই পক্ষের উদ্দেশে বলেন, আপনারা কেউ কথা শোনেননি।
পরে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আগের ও বর্তমান দুটি মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সেই প্রতিবেদনের সারমর্ম উপস্থাপন করেন।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, আপিল বিভাগ ১০ বছর সাজার আসামিকেও জামিন দিয়েছে। পাকিস্তানের মত বর্বর দেশেও নওয়াজ শরীফকে মেডিকেল গ্রাউন্ডে জামিন দিয়েছে, লন্ডনে পঠিয়েছে। মানবিক বিবেচনায় আমরা তার (খালেদা জিয়া) জামিন চাইছি।
বেলা ১১টার দিকে আদালত বিরতিতে যায়। সাড়ে ১১টায় আবার শুনানি শুরু হলে জয়নুল আবেদীন বক্তব্য উপস্থাপন করেন। জয়নুলের পর বক্তব্য উপস্থাপন করেন খালেদার আরেক আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।
পরে রাষ্ট্রপক্ষে জামিন আবেদনের বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, দুই মামলায় তিনি (খালেদা জিয়া) ১৭ বছরের সাজা ভোগ করছেন। এটাকে শর্ট সেনটেন্স বলা যায় না। তাছাড়া দুই মামলাতেই আপিল শুনানির জন্য রেডি। এই অবস্থায় জামিন হওয়া উচিৎ নয়।
দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সর্বশেষ মেডিকেল রিপোর্ট থেকে উদ্ধৃত করে শুনানিতে বলেন, চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়ার সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে চিকিৎসকরা তার যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারছেন না। আমরা তার জামিন আবেদন নাকচ করার আর্জি জানাচ্ছি।
বেলা ১টায় শুনানি শেষে মিনিট দশেক বিরতি দিয়ে সিদ্ধান্ত জানায় আপিল বিভাগ। হাই কোর্টের জামিন খারিজের আদেশই তাতে বহাল থাকে।
পরবর্তী করণীয় ঠিক করবেন সিনিয়র আইনজীবীরা : জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজের বিষয়ে পরবর্তী করণীয় সিনিয়র আইনজীবীরা ঠিক করবেন বলে জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন।
তিনি বলেছেন, এখন আদালত যে আদেশ দিয়েছেন সেখানে কোনো রিজন (কারণ) উল্লেখ করা হয়নি। দেখবো, কী কারণে আমাদের আবেদন খারিজ করা হয়েছে। সে বিষয় দেখে আমাদের একটা সিনিয়র আইনজীবী প্যানেল আছে, ওই প্যানেলের আইনজীবীরা বসে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন।
বৃহস্পতিবার খালেদা জিয়ার আবেদনের ওপর আদেশ দেওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের অডিটরিয়ামে তিনি সাংবাদিকদের কাছে এ মন্তব্য করেন।
এ সময় জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সদস্য সচিব ফজলুর রহমানসহ বিএনপিপন্থি আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ খালেদার জামিন আবেদন খারিজ করে দেন।