আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন আমাদেরকে বাঁচতে দিন

13

ফজলুল হক

আপনারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, আমাদেরকে বাঁচতে দিন-এ বক্তব্য দিয়েছেন কয়েকজন চিকিৎসক, যা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলা করছে বাংলাদেশ। মৃত্যু এবং সংক্রমণের হার করোনার প্রথম ঢেউকে ছাড়িয়ে অনেক উপরে উঠেছে। কয়েকদিন আগে পর্যন্ত হাসপাতালে বিছানার সংকট, আইসিইউ সংকট, অক্সিজেনের সংকট প্রকট ছিলো। দৈনিক একশোজনের বেশি করোনা রোগী মৃত্যুবরণ করছিলো। মানুষ অ্যাম্বুলেন্সে রোগী নিয়ে এই হাসপাতাল থেকে ঐ হাসপাতালে ঘোরাঘুরি করেছে। করোনার হাত থেকে কে রক্ষা পাবে, কে রক্ষা পাবে না তার কোন ঠিক নাই। আমরা আগে ভাবতাম রাজনৈতিক নেতা, এম.পি, মন্ত্রী, শিল্পগ্রুপের মালিক, আমলা, সরকারি কর্মকর্তারা খুব শক্তিশালী। তাদের সামনে সাধারণ মানুষ কিছুই না। তাদের সামান্য অসুখ দেখা দিলে, তারা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে, প্লেন চার্টার করে সিঙ্গাপুর, লন্ডন, আমেরিকা চলে যাবে। এ ধরনের কোন মানুষের সাথে আমরা কোন ঝামেলায় যেতে সাহস করি না। তারা আমাদের উপর যা ইচ্ছে তা ঘটাতে পারেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের কাছে সবাই একাকার হয়ে গেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ব্রিটিশ রাজপ্রাসাদেও হানা দিয়েছে করোনা। পৃথিবীর অনেক শক্তিধর দেশের রাষ্ট্রনায়কদের প্রাসাদে ঢুকেছে করোনা। আমাদের দেশে মন্ত্রী, সাবেক মন্ত্রীসহ অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি করোনায় মারা গেছেন। সরকারি দল-বিরোধী দলের অনেক নেতা আক্রান্ত হয়েছেন, কেউ কেউ মারা গেছেন। আমাদের সাবেক প্রধানমন্ত্রীও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। করোনার সামনে কুলি-মজুর কিংবা ধনীর কোন পার্থক্য নাই। এই অবস্থায় আমাদের বুঝতে হবে আমাদের দেশের সকল মানুষ, গরিব-ধনী, কুলি-মজুর, আমলা-মন্ত্রী সবাই একদিকে থাকবে অন্যদিকে থাকবে করোনা। এই যুদ্ধে দেশের সকল মানুষের ঐক্যবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন। সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করতে হবে। করোনা শুধু মানুষের ফুসফুস, লিভার, কিডনী আক্রান্ত করে ছাড়ছে না। শ্রমিকদের কর্মহীন করে দিচ্ছে। পরিবহন শ্রমিক, লঞ্চ শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, ছোট্ট ব্যবসায়ী, দিনমজুর, রিক্সাচালক, ভ্যানচালক এই ধরনের পেশার মানুষেরা করোনার কারণে পুরোপুরি বেকার হয়ে গেছে। লকডাউন দিলে তারা খাবে কি? তাই তারা লকডাউন তোলার জন্য হইচই করছে। যদি উচ্চবিত্তের লোকজন, ব্যবসায়ী শিল্পপতি, রাজনৈতিক নেতারা এগিয়ে আসেন এবং এসব মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করেন তাহলে কঠোর লকডাউন দিয়ে এদের ঘরে রাখা সম্ভব।
আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় জোরদার করার বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের ৩৬ লক্ষ পরিবারকে মোবাইলের মাধ্যমে খুব দ্রæত জনপ্রতি ২৫০০ টাকা করে সহায়তা দেওয়ার জন্য সাড়ে ৯০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সরকার ওএমএস’র মাধ্যমে চাউল এবং টিসিবি’র মাধ্যমে খাদ্যপণ্য কমদামে বিক্রি করছে। সামাজিক সুরক্ষার অন্যান্য ভাতাগুলিও জোরদার করা হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন বিশেষ করে পুলিশের পক্ষ থেকে ঘরে ঘরে সাহায্য পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। অনেক স্বেচ্ছাসেবী ফাউন্ডেশন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। করোনার আগ্রাসনে আয়বঞ্চিত হওয়া সকল মানুষকে সুস্থ রাখার জন্য আমাদের সরকার, বিরোধীদল ও শিল্পপতিদের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকার। মানুষ বাহিরে ঘোরাঘুরি করলে এবং স্বাস্থ্যবিধি না মানলে করোনার আরো বড়ো ধাক্কার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কঠোর লকডাউন কেন প্রয়োজন? এটা সব মানুষের জন্য প্রয়োজন। এটা আমাদের সকলকে অনুভব করতে হবে। সরকারি এবং বিরোধীদলীয় সকল রাজনৈতিক নেতাকে পরস্পরের বিরুদ্ধে সমালোচনা না করে করোনার হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর চিন্তা করতে হবে।
করোনার নিষ্ঠুর থাবার সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ হচ্ছে ডাক্তার, নার্স, হাসপাতাল কর্মী, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট, ওয়ার্ড স্টাফ এবং চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট মানুষগণ। ডাক্তার নার্সদের হাতের উপরে প্রতিদিন শতাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে। অনেক রোগী অক্সিজেনের জন্য ছটফট করছে। ডাক্তারদের সামনে মৃত রোগীর স্বজনেরা বিলাপ করছে। যে নারীর স্বামী মারা গেল, সে হল বিধবা। যে ছেলের মা-বাবা মারা গেল, সে হল অনাথ। যে শ্রমিক করোনায় মারা গেল সে তার পরিবারকে অকুল সাগরে ভাসিয়ে চলে গেল। এই বিয়োগান্ত ঘটনার প্রথম ঢেউ লাগে ডাক্তার নার্সদের চোখেমুখে। তারা হতবিহ্বল হয়ে পড়ে।
আমার মতো অনেক মানুষ আছে যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। আমরা অন্যান্য রোগের চিকিৎসা নিতে পারছি না। অনেক ক্যান্সার রোগী, ডায়ালাইসিসের রোগী, লিভার সিরোসিসের রোগী সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি হায়দ্রাবাদ থেকে চোখের অস্ত্রোপচার করিয়ে এসেছি। পরবর্তীতে দুইবার উদ্যোগ নিয়েও সেখানে যেতে পারিনি। এখন সেখানে অবস্থা খারাপ। চিকিৎসা বন্ধ। লকডাউনের জন্য চট্টগ্রামে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে পারছি না। খুবই কষ্টের মধ্যে আছি।
যখন আমরা দেখি মানুষ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে, দূরত্ব বজায় রাখছে না, মাস্ক পড়ছে না, সাবান দিয়ে হাত ধুচ্ছে না তখন খুবই কষ্ট হয়। যখন দেখি বিভিন্ন সংগঠন দোকান খুলে দেওয়ার দাবি জানাচ্ছে এবং দোকান খুলে দিলে এখানে স্বাস্থ্যবিধি সম্পূর্ণ অবহেলিত হচ্ছে তখন খুবই কষ্ট হয়। যখন দেখি গণপরিবহন খুলে দেওয়ার দাবি জানানো হচ্ছে এবং বলছে যে তারা অর্ধেক আসনে যাত্রী নেবে, স্বাস্থ্যবিধি মানবে, তখন খুবই কষ্ট হয়। কারণ তারা অতীতে কথা রাখেনি। তারা স্বাস্থ্যবিধি না মেনে বাস ভর্তি করে যাত্রী নিয়েছে। ভারতে করোনার দাপট আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। ভারত এখন মৃত্যুপুরী। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে এর প্রধান কারণ হলো ব্যাপক জনসমাগম এবং অবাধ মেলামেশা। এর অন্য কারণ মাস্ক না পরা এবং টিকা না নেওয়া। তৃতীয় কারণ হচ্ছে অত্যন্ত শক্তিশালী ধরনের করোনাভাইরাস। অতি জনসমাগম আমাদের দেশে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই মাস্ক পরছে না। আমাদের টিকা গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যাও বেশি নয়। করোনার ভারতীয় ধরন যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করে তাহলে আগামী এক মাসের মধ্যে কি অবস্থা হতে পারে? সে বিপর্যয় দেখার জন্য না আপনি বেঁেচ থাকবেন, না আমি বেঁচে থাকবো। আপনারা যারা ভাবছেন তরুণরা আক্রান্ত হবে না, গরিবরা আক্রান্ত হবে না, কৃষকরা আক্রান্ত হবে না, গার্মেন্টস শ্রমিকেরা আক্রান্ত হবে না আপনাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হবে। আপনারা নিজেদের উদ্যোগে, নিজেদের বিবেচনায়, নিজেদের বুদ্ধি অনুযায়ী মাস্ক পরুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, ডাক্তারদের মানসিক চাপ যাতে বৃদ্ধি না পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখুন, নার্স ডাক্তারদের বাঁচতে দিন। আমাদের মতো বয়স্ক লোক এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষদের বাঁচতে দিন।
করোনার আক্রমণে ভারত মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে। কবরস্থানে, শ্মশানে মৃতদেহ দাফন, সৎকার করে কুলানো যাচ্ছে না। প্রতিদিন সাড়ে ৩ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। ভারতের মতো দেশে, যেখানে চিকিৎসা অবকাঠামো খুবই উন্নত, যেখানে চিকিৎসকগণ দক্ষ এবং মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন, সেখানে রোগী চিকিৎসা পাচ্ছে না, সেখানে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার। আপনি যদি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিভিন্ন রিপোর্ট দেখেন, তাহলে সেখানকার অনেক মানবপ্রেমীর গল্প আপনি জানতে পারবেন। মহারাষ্ট্রের করোনা পরিস্থিতি সবচাইতে খারাপ। মুম্বাই শহরে শাহনেওয়াজ শেখ (নামটা যদি আমার ভুল না হয়) এখন পরিচিত হয়েছেন অক্সিজেন ম্যান হিসেবে। কিছুদিন আগে তার বন্ধুর স্ত্রী করোনা আক্রান্ত হলে তার গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছিলো। পথে অক্সিজেনের জন্য ছটফট করতে করতে ঐ বন্ধুর স্ত্রীটি মারা যায়। এই মৃত্যু দেখে শাহনেওয়াজ বিচলিত হয়ে পড়ে। তার কাছে যে অর্থ সম্পদ ছিলো তা দিয়ে সে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে শুরু করে এবং করোনা রোগীদের বিনা পয়সায় দিতে থাকে। ধনী গরিব যেই হোক শ্বাসকষ্ট হলে তারা শাহনেওয়াজের কাছে আসে। সে তার সম্পদ বিক্রি করে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে রোগীদের দিতে থাকে। তাকে অক্সিজেন ম্যান হিসেবে গণমাধ্যম পরিচিত করে দেয়। সে তার গাড়িটি ২২ লক্ষ রুপিতে বিক্রি করে অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনে নেয়। সে বলেছে যার অক্সিজেন সিলিন্ডার দরকার হবে সে আমার কাছে আসলে, অক্সিজেনের কোন ঘাটতি হবে না। ভারতের সর্বত্র হিন্দু, মুসলমান, শিখ, জৈন, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ সবাই এক হয়ে গেছে। হিন্দুর মৃতদেহ মুসলমান সৎকার করছে। মুসলমানের লাশ কবরস্থ করছে হিন্দু। প্রকৃতির কাছে মানুষ বড়োই অসহায়।
আমাদের দেশে অনেক সংগঠনের নাম শুনতে পাচ্ছি যারা মানুষকে খাবার দিচ্ছে, অর্থ সাহায্য দিচ্ছে, মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছে, মৃতদের লাশ দাফন ও সৎকার করছে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন প্রতিদিন নাকি দশ হাজার মানুষকে খাওয়াচ্ছে। তারা আইসোলেশন সেন্টারসহ কোভিড রোগীদের অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও দিচ্ছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় একজন ডাক্তার চট্টগ্রামে একটি ফিল্ড হাসপাতাল খুলেছিল। আমার একজন আত্মীয় করোনা নিয়ে সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। আমার আত্মীয় সে হাসপাতালের প্রশংসা করেছিল। সে বলেছিল ঐ ডাক্তারের নাম বিদ্যুৎ বড়ুয়া। তখন অবশ্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রামের উৎসাহী অনেক ডাক্তারও বেশ কয়েকটি আইসোলেশন সেন্টার খুলেছিল। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল গতবছর করোনার শুরু থেকে অদ্যাবধি চট্টগ্রামের কোভিড রোগীদের সেবায় সাফল্যজনকভাবে কাজ করছে। চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) এবং চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের ভূমিকাও প্রশংসনীয়। দু-একদিন আগে শুনেছি, ডাক্তার বিদ্যুৎ বড়ুয়া অ্যাম্বুলেন্সের সাহায্যে মোবাইল কোভিড চিকিৎসাসেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। মা ও শিশু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও করোনা রোগীদের ঘরে গিয়ে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। আমাদের দেশে যে জনদরদী মানুষ নাই তা নয় কিন্তু আমাদের দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষ যারা কর্মহীন হয়ে গেছে তাদের যদি আমরা কঠোর লকডাউনের মধ্যে ঘরে রাখতে চাই তাহলে তাদের লকডাউন পিরিয়ডে খাবার দিতে হবে।
বাংলাদেশের সকল শিল্পগ্রুপ এবং ধনী ব্যবসায়ী একত্রিত হয়ে-চাইলে বস্তিবাসী ও গ্রামে বসবাসকারী কুলি-মজুর, চাষি, ভ্যানচালক, রিক্সাচালক ও বেকারদের পনেরো বিশদিন ঘরে বসিয়ে খাবারের যোগান দিতে পারেন না? নিশ্চয়ই পারে। আর যাদের টাকার অভাব নাই অভ্যাসবশত, অজ্ঞতাবশত অথবা জেদের বশে মাস্ক না পরে হাটে বাজারে ঘুরে বেড়ায়, তাদের প্রতি অনুরোধ আপনারা মাস্ক পরুন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন-আমাদের বাঁচতে দিন। আপনারাও বাঁচুন।

লেখক: সাবেক অধ্যক্ষ, কলামিস্ট