আনোয়ার সেলিম- এর কাব্যগ্রন্থ ‘কুয়াশার রূপছায়া’

38

এমরান চৌধুরী

কবি আনোয়ার সেলিম তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘কুয়াশার রূপছায়া’য় শুরুতেই জীবনের কথা, বধির পৃথিবীর কথা, সন্ধ্যা নামার কথা,ঘরের ফেরার কথা এবং পাশাপাশি নিজের অমরত্ব পাবার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। এত কিছু পরও কবি অতৃপ্ত। তাই তিনি অকপটে এবং সদম্ভে উচ্চারণ করেন, কবিতা কবিতার সব কথা বলে না। আসলে এখানেই কবিতার স্বকীয়তা। ‘শেষ হয়েও হলো না শেষ’র মতো অনন্যতা কবিতার সবচেয়ে বড় অলংকার। এই অলংকার না থাকলে কবির কবিত্ব বলতে কিছু বিদ্যমান থাকে না। অন্যদিকে সব কথা বলে দিলে বা শব্দচয়নে কুশলী না হলে সেটা কবিতার ভাষা না হয়ে, হয়ে ওঠে সাধারণের ভাষা, যা কবিতার সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত হওয়ার মতো গুণ ও মান হারিয়ে ফেলে। এ প্রসঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কটি ছত্র স্মরণ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘অন্তর’ হতে আহরি বচন আনন্দলোক করি বিরচন
গীতিরসধারা করি সিঞ্চন
সংসার ধূলিজলে’
গীতিরসধারা সৃজন করতে হলে কবিতার কিছু কথা পাঠকের জন্যে তুলে রাখতে হয়। যে কথাগুলো বা শব্দমালা পাঠককে ভাবায়, ভাবনার জগতে অবগাহনে উদ্দীপ্ত করে। জাত পাঠক সে উদ্দীপনায় সিক্ত হয়ে কবিতার সেই না বলা কথাগুলোর রসাস্বাদনে ব্রতী হয়। কবি আনোয়ার সেলিমও কবিতার সব কথা না বলার অনুগামী। যেমন, দিঘির জলে পদ্মপাতায় খুঁজি দুই ফোঁটা জল
আজ যেন রংহীন রূপহীন সকল কমল উৎপল সবুজ ঘাসের দ্বীপটি খুঁজি ওই দূরে শুধুই প্রবাল মেঠোপথে হেঁটে হেঁটে খুঁজি অরুণিমা সান্যাল।(তোমাকে চাই, কুয়াশার রূপছায়া, পৃষ্ঠা-১০)
কবি আনোয়ার সেলিম একজন আমেরিকা প্রবাসী লেখক। লেখালেখিতে তাঁর অভিষেক ছোটবেলায়। তার পেছনে যাঁর অনুপ্রেরণা ক্রিয়াশীল ছিল তিনি হলেন তাঁর ছোট মামা হেদায়েতুল ইসলাম মিন্টু। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ ও সীতাকুন্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে অধ্যয়নকালীন তিনি নাটকে অভিনয়, খেলাধুলা ও কবিতাচর্চায় নিবেদিত হন। তাঁর প্রিয় খেলা ফুটবল ও ভলিবল। ১৯৭৭ সাল থেকে তিনি চট্টগ্রামের নাট্যাঙ্গনে সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রিয় শিক্ষক শিব শংকর চক্রবর্তীর নাটক ‘কেরানীর জীবন’ এর মাধ্যমে তাঁর নাট্যাভিনয় শুরু। সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমে পদচারণা থাকলেও কোনোক্ষেত্রে তিনি সুস্হির ছিলেন না। তাঁর লেখালেখিতে রয়েছে দীর্ঘবিরতি। হতে পারে তা প্রবাস জীবনের নানা টানাপোড়েন কিংবা অন্যকোনো কারণ। তবে আশার কথা হলো যে, কবি হারিয়ে যাননি। বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়ার আগেই তাঁর প্রিয়তম সহধর্মিণীর অনুপ্রেরণা আর নিউইয়র্ক সাহিত্য একাডেমির সাহিত্যপ্রেমীদের সান্নিধ্যে কবি আবার গা ঝাড়া দিয়ে নতুন উদ্যমে নেমে পড়েন কাব্য সাধনায়। কবিতার ভুবনে নিরন্তর শ্রম ও মেধার চাষে ছন্দপতন ঘটলেও অনিয়মিতভাবে যা করেছেন, করে যাচ্ছেন তা আমাদের কাছে ‘অঘ্রাণের ভরা ক্ষেতে কী দেখেছি মধুর হাসি’র মতো বড় প্রাপ্তি।
আনোয়ার সেলিম তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে বিচিত্র ও সমকালীন বিষয় নিয়ে কবিতা লিখেছেন। আমাদের যাপিত জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, পারিবারিক জীবনের টানাপোড়েনের মতো বিষয় যেমন আছে, তেমনি আছে বৈশ্বিক মহামারির দুঃসহ অনুষঙ্গ কোয়ারেন্টাইন নিয়ে-
হঠাৎ কেমন জানি হয়ে গেল পৃথিবী,
কত কাছে থেকেও নাগালের বাইরে
ইচ্ছাগুলোর উড়তে মানা, কোয়ারেন্টাইনের
সাদা চাদরে লেপটে শুয়ে আছে
সময় যেন আর চলতে চায় না, জীবন স্তব্ধ অচল
অজানা আলসে লম্বা ঘুমে
সকাল, দুপুর, সন্ধ্যাগুলো বন্দি, রাতজাগা তারারাও বন্দি আজ আইসোলেশনে।
কাছে আসতে মানা, পাশে বসতে মানা, চিবুকে নকশিকাঁথা মুখোশ অন্তরালে (কোয়ারেন্টাইন, পৃষ্ঠা -৭৬)
আসলে এক ভয়াবহ সময় পার করেছে/ করছে পৃথিবীর মানুষ। অক্সিজেনের অবাধ ভান্ডার পৃথিবীর বুকে শ্বাস নিতে না পেরে দম বন্ধ হয়ে ইতিমধ্যে মারা গেছে পৃথিবীর অর্ধকোটি মানুষ। সেই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কবির প্রচন্ড আশাবাদ Ñআবার ঝাপ দেব মেঘনায়
উঠে যাব চন্দ্রনাথ শিখরে
বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবো বকুলের, ঘাস ছোঁব
চিৎ হয়ে শুয়ে থাকব সবুজে
তুমি যদি সাথে যাও দুজনে খুঁজে নেবো
প্রতিক্ষণ জীবনের পরতে পরতে
আবার বাঁচব সুখে, আবার বাঁচব দুখে ভালোবাসির মেলায় পৃথিবীতে (কোয়ারান্টাইন, পৃষ্ঠা -৭৬)
কবি আনোয়ার সেলিম সুদূর আমেরিকায় থাকলেও তাঁর মনপ্রাণ পড়ে থাকে নিজের আঁতুড় ঘরে। সাত সমুদ্র তের নদী দূর থেকে তিনি নিয়ত মায়ের আঁচলের টান অনুভব করেন। সত্যিকার অর্থেই তাই। মানুষ যত দূরে থাকে তত বেশি অনুভব করে দেশকে, দেশের মাটিকে, মাটির সোঁদা ঘ্রাণকে। প্রিয়জন ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে পেতে বড় বেশি আঁকুপাঁকু করে মন। কবি সেই চিরচেনা আঁতুড়ঘরের চিত্র তুলে ধরেছেন নিখাদ মমতায়Ñ
বুক বেঁধে আগলে রাখি মাটি, ভাঙে আবার গড়ি
ভাঙা গড়ার এই খেলায় একি যন্ত্রণা এ কোন জীবন
তবুও সে মাটির সোঁদা গন্ধ মায়ের আঁচলের টান
হারিকেন টর্নেডো মৃত্যুযুদ্ধ মহাসমুদ্রের প্রলয় বান
ছিন্ন করতে পারেনি রক্তে প্রবহমান নাড়ির বন্ধন
সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়েও শুনি সে গর্জন
সে আকাশ সে মাটি সে নদী সে বাতাস স্পন্দন
সে আমার প্রাণ যুগ-যুগের সুকণ্ঠে হৃদয়ের গান
আমার অহংকার দ্বীপরানি জননী আমার জন্মস্হান (জন্মস্থান, পৃষ্ঠা -৪১)
আগেই উলে­খ করা হয়েছে কবি আনোয়ার সেলিমের বিষয়-ভাবনা বর্ণিল ও বিচিত্র। সাধারণ বিষয় যেমন তাঁর কবিতার অনুষঙ্গ হয়েছে, তেমনি দেশ,মাটি ও কৃষ্টির বন্দনা উঠে এসেছে স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীলভাবে। স্বাধীনতার কবি, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তিনি তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে একাধিক কবিতা গ্রন্থিত করেছেন,যাতে প্রতিফলিত হয়েছে জাতির জনকের প্রতি অপার শ্রদ্ধাবোধ। তেমনি একটি কবিতা ‘ তোমাকে ফিরে আসতেই হবে’। এই কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়ার করুণ আকুতি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়-
এই বাঙালিকে ভালোবেসে বাংলাকে ভালোবেসে তুমি ফিরে আসবে না এমনতো হতে পারে না কতটা ভালোবাসা দিলে তোমায় আবার ফিরে পাবো
কতটা আকুল মিনতিতে তুমি আবার কথা বলবে কত চোখের জল ঝরালে তুমি আবার চোখ মেলবে
সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের মুক্তির মিছিলে
হে পিতা— তোমাকে আসতেই হবে বারে বারে (পৃষ্ঠা -১২)
‘কুয়াশার রূপছায়া’র কবি আনোয়ার সেলিমের কাব্যভাষা সরলরেখার মতো। তিনি কবিতায় যে শব্দের চাষা করেছেন তা খুবই সাদামাটা। তাঁর এ কাব্যগ্রন্থে শব্দচয়নে তথা বাক্যগঠনে সযতœ প্রয়াস লক্ষনীয়। তিনি দুর্বোধ্য শব্দ পরিহারে বেশ সতর্ক ছিলেন। দু’একটি ছত্র উদ্ধৃত করা যাকÑ
১. নখের আঁচড়ে রক্ত ঝরাও, এ যে রক্ত নয় বিষ অঙ্গে
নিরাশায় হোক না আশা নতুন পৃথিবীতে নতুন ঢঙে। (আশা, পৃষ্ঠা -১৫)
২. আবার পর জনমে যদি ফিরি মেঘ হয়ে
তোমার শরীর ভেজানো এক পশলা বৃষ্টি হবো,
আবার যদি ফিরি রূপালি চাঁদ-তারা হয়ে
উদাসী আলোয় তোমার লাজুক ঠোঁটে রং ছড়াব
(আবার যদি ফিরি, পৃষ্ঠা -১৭)
কবির এটি প্রথম কাব্যগ্রন্থ হলেও মেধা ও মননে, কবিতার নির্মিতিতে, শব্দচয়ন ও বাক্যবিন্যাসে, উপমার ব্যবহারে সর্বোপরি অন্ত্যমিলেও যথেষ্ট পরিপক্কতার ছাপ সুস্পষ্ট। কাব্যগ্রন্থে গ্রন্থিত ৭১টি কবিতার মধ্যে একটি কবিতাও আবেগে গ্রন্থিত বলার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক প্রযোজক ও কবি বেলাল বেগ এই কাব্যগ্রন্থ নিয়ে একটি অনন্যসুন্দর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শুদ্ধ কবি শামসুর রাহমান জোসনা রাতে পরীর নাচ দেখেছেন। অনন্ত নীলাকাশ তলে, সীমাহীন নীল সমুদ্রের বুকের সবুজদ্বীপ সন্ধীপের সৌন্দর্য পিপাসু কবি আনোয়ার সেলিম দেখে ফেলেছেন কুয়াশার রূপাছায়া।’ আমরাও বিশ্বাস করি সচেতন পাঠকেরা এই গ্রন্থটি সংগ্রহ করলে নিশ্চিত কুয়াশার রূপছায়া দেখতে পাবেন।

কুয়াশার রূপছায়া
আনোয়ার সেলিম
প্রচ্ছদঃ উত্তম সেন
প্রকাশকঃ আদিগন্ত প্রকাশন
প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ২০২২
ঢাকা।
মূল্যঃ দুইশত টাকা।