আত্মহত্যা নয়, নিজেকে ভালোবাসুন

46

 

সবকিছুর স্থায়ী সমাধানের জন্যই মানুষ মূলত আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু নিজেকে হত্যাই কি সবকিছুর সমাধান! তা আমি অন্তত মনে করি না। সমাজে দিন দিন আত্মহত্যার পরিমাণ ভয়ানক হারে বেড়ে চলছে। বিষন্নতা, মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি অবহেলা, নিজের সাথে নিজের লড়াইয়ের মনোভাব না থাকা আত্মহত্যার প্রধান কারণ। শুধু আমাদের দেশেই নয় বরং বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই আত্মহত্যাপ্রবণতা চোখে পড়ে। প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৮ লাখ মানুষ এই পথ বেছে নেয়। যদিও প্রচলিত আইনে আত্মহত্যা অপরাধ হিসেবে গণ্য। আত্মহত্যা জীবনের একটি অমীমাংসিত সমাধান। কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, ‘যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ/মরিবার হ’লো তার সাধ।’ মরিবার সাধ- এই কথাটির মধ্যে অনেক তাৎপর্য বহন করে। স্বেচ্ছায় নিজের জীবন বিসর্জন দেয় ভীরুকাপুরুষ যারা তারা। এই কথাও সমাজে প্রচলিত রয়েছে। অথবা এটাও বলা যেতে পারে যে, যারা জীবনকে ভালোবাসে না কেবল তারাই আত্মহননের পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যা মহাপাপ। ধর্ম এটাকে সমর্থন করে না। বরং এ ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য সামাজিক সমস্যার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল সমস্যা। ১৪ থেকে ২৯ বছর বয়সিদের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ এটি। প্রতি বছরই তা বিপজ্জনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্বে আট লাখ মানুষ আত্মহত্যায় মারা যায়। মৃত্যুর হার প্রতি লাখে ১৬ জন। স্থানীয় গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যার হার প্রতি লাখে ৬ থেকে ১০ জন- যা উন্নত দেশের কাছাকাছি। বিশেষজ্ঞদের মতে, মাদকসেবন বেড়ে যাওয়া, কমর্সংস্থানের অভাব, পারিবারিক কলহ, নির্যাতন, ভালোবাসায় ব্যথর্তা, পরীক্ষায় অকৃতকার্য, বেকারত্ব, যৌন নির্যাতন, অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণসহ বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। হতাশার কারণে করোনাকালে এই প্রবণতা আরো বেড়েছে।
তবে সম্পদশালী বা অর্থশালীর আত্মহত্যা খবর খুব কমই শোনা যায়। আত্মহত্যার রকমফের আছে যেমন- বয়সি কোনো গাছের সঙ্গে রশি বেঁধে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা, এটা ইদানীং আমাদের অভিমানী নির্যাতিত তরুণীরা ফ্যানের সঙ্গে ওড়না প্যাঁচিয়ে করে। কোনো উঁচু দালান থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা, চলন্ত ট্রেনের সামনে গিয়ে আত্মহত্যা, নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কিংবা বিষপান করে আত্মহত্যা বা অতিরিক্ত ঘুমের বড়ি খেয়ে আত্মহত্যা।
ইদানীং পুরুষের চেয়ে নারীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে গেছে। আত্মহত্যার ৯৭০টি ঘটনা পর্যালোচনা করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ। তারা বলেছে, বাংলাদেশে নারীদের ওপর শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতন এবং ইভ টিজিংয়ের ঘটনা বাড়ায় অনেকে পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন। অবিবাহিত নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বাধ্য হওয়া অথবা স্বেচ্ছায় যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পর গর্ভধারণের কারণে অনেকে আত্মহত্যা করেন। বেশির ভাগ নারী আত্মহত্যা করেছেন গলায় দড়ি দিয়ে, পুরুষরা কীটনাশক খেয়ে। আবেগতাড়িত ও পরিকল্পিত এ দুই ধরনের আত্মহত্যা হয়। তবে দেশে আবেগতাড়িত আত্মহত্যার পরিমাণ বেশি, এটি একটি মানসিক সমস্যা। সঠিক সময়ে চিকিৎসা পেলে এ ধরনের ঝুঁকি থেকে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে বাঁচানো সম্ভব।
আত্মহননকারীরা জীবনের নানামুখী সমস্যা সংকট থেকে মুক্তি পেতেই নিজেকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে নেয়। প্রকৃতপক্ষে নিজেকে ধ্বংস করার ভেতর কোনো বীরত্ব নেই, নেই কোনো কৃতিত্ব। চিকিৎসকদের মতে, আত্মহত্যাকারীদের ৯৫ শতাংশই মানসিক রোগে ভোগেন। দেশে ৬৫ লাখ মানুষ আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতা। গভীর হতাশা বিষণ্নতার কারণেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে সব চেয়ে বেশি। আত্মহত্যাপ্রবণ মানুষকে সঙ্গ দেয়া, বিনোদনমূলক ও প্রকৃতিনির্ভর কোনো জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া উচিত। আর এটা করতে হবে বন্ধু আত্মীয়স্বজনকেই। আত্মহত্যা ব্যক্তি পরিবার ও সমাজকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে, এই প্রভাব খুবই নেতিবাচক। আত্মহত্যা প্রতিকারে সবাইকে এগিয়ে আসা খুব বেশি প্রয়োজন। আপনি যদি কখনো জীবনের মায়া হারিয়ে ফেলেন, তবে শুধু জীবনের খারাপ মুহূর্ত নিয়ে ভাববেন কেন? আপনার জীবনে নিশ্চয়ই এমন কিছুও রয়েছে, যেটাকে মনে করে আপনার বেঁচে থাকা উচিৎ।
নিজের খারাপ লাগাগুলো কোনো বিশ্বস্ত বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। দেখবেন জীবনে সবাই কোনো না কোনো খারাপ সময় পার করেছে। কিংবা খারাপ সময়ের প্রতিটি মুহূর্তের জন্য আপনার একান্ত সঙ্গী হতে পারে একটা ডায়েরি। ডায়েরির পাতায় নিজের খারাপ অনুভূতিগুলো ফুটিয়ে তুলতে পারেন। যা একান্তই আপনার।
নিজেকে ভালো রাখবেন, নিজেকে ভালোবাসবেন। নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেবেন। মনে রাখবেন, দিনশেষে আপনি কারো প্রিয় মানুষ। নিজেকে হত্যা মানে কিন্তু এই প্রিয় মানুষগুলোর মনকে হত্যা করা ।
জীবন সম্পর্কে যত কথাই বলা হোক না কেন- জীবনের সংজ্ঞা দেয়া কঠিন। কোনো কবি- সাহিত্যিক, মনীষী-পন্ডিত ও দার্শনিক এ পর্যন্ত জীবনের সঠিক সংজ্ঞা দিতে পারেননি। জীবনকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় না বলেই জীবন এত তাৎপর্যপূর্ণ বৈচিত্র্যময়, নানা রং ও রেখার দ্বারা জীবনের প্রতিটি পরত ও বাঁক আঁকা। তাই খুব সহজে কেউ জীবনের মায়া ত্যাগ করতে চায় না। সবাই আত্মপ্রেমে মশগুল থাকতে চায়। সক্রেটিস এও বলেছিলেন- ‘নিজেকে চেন’। তাই কোনো মানুষ এক জীবনেও নিজেকে চিনতে পারে না। অথবা এভাবে বলা যায় যে, নিজেকে চেনা সহজ নয়। নিজেকে চিনতে পারলে মানুষ ও জগৎ চেনা যায়। জীবনতো তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা যায়। এ সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন তাদের জীবন সম্পর্কে কোনো গভীর উপলব্ধি নেই। তারা মনে করেন জীবন একভাবে কেটে গেলেই হলো। অথবা গভীর হতাশাবাদী- নৈরাশ্যবাদীরা ভাবে এ ক্ষুদ্র জীবনের কী মূল্য আছে? নানা দুঃখ কষ্ট হতাশায় অপ্রাপ্তি আর বঞ্চনায় অনেকেই জীবনকে তুচ্ছভাবে। আত্মহননের মাধ্যমে জীবনের মায়া ত্যাগ করে পৃথিবী থেকে চলে যায়, ঘটাতে চায় জীবনের পরিসমাপ্তি। এটা কোনো সমাধান নয়। ভালোবাসাহীন জীবন কোনো জীবন নয়। ভালোবেসে বেঁচে থেকেই জীবনের সমাধান খুঁজতে হবে। নিজের জীবনের সমাধান জীবনের মধ্যেই নিহিত, আত্মহত্যার মধ্যে নয়। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক: কলামিস্ট