আত্মহত্যা একটি সংকট প্রতিরোধে চাই সামাজিক সচেতনতা

25

কেন জানি আমাদের সমাজ দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে ? ছোটখাট কারণে দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। এমন এক সময় ছিল শুধু প্রেমে ব্যর্থ হয়ে কিংবা প্রেম করে বিয়েতে মা-বাবা বা পরিবারের কোনো গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের অসম্মতির কারণে আবেগের বশে আত্মহত্যা করত প্রেমিক বা প্রেমিকা। নববধূকে শ্বশুর বাড়ির লোকজন কর্তৃক অবহেলা বা শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের কারণেও অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিত। এক সময় যোগ হয় নববধূ নির্যাতনের নতুন অনুষঙ্গ-যৌতুক। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা ঠিক সময়ে বরপক্ষের চাহিদামতো যৌতুক দিতে না পারায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে অনেক তরুণ তরুণীকে। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে আত্মহত্যার ধরন ও সংখ্যা বেড়েছে। বেরিয়ে আসছে নানামুখি কারণ। একদম তুচ্ছ কারণেও অনেক কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যার পথে ধাবিত হচ্ছে। বছর দুয়েক আগে আমাদের পাশের গ্রামের এক ছেলে আত্মহত্যা করে বাবার বকুনি খেয়ে। ছেলেটা বাবার স্মার্টফোন নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিল আনোয়ারার পারকিতে। সেখানে সে বন্ধুদের নিয়ে অনেকগুলো ছবি তোলে। বাড়িতে ফিরে এলে বাবা তাকে এই নিয়ে বকুনি দেয়। এভাবে সামান্য কারণে অকালে বিদায় নিচ্ছে অনেক কিশোর-কিশোরী, যা শুধু দুঃখজনক নয় সুস্থ, সুন্দর পরিবার ও সমাজ গঠনের পথে বড় অন্তরায়।
স¤প্রতি ‘চিন্তা রিচার্স বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান আত্মহত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে দেশে মহামারিকালীন যতজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে তার বেশিরভাগই ছাত্রী, এই সংখ্যা ৭২ শতাংশ। (সূত্র: বাংলাদেশে প্রতিদিন, তাং-১৫ জানুয়ারি ২০২২) আত্মহত্যার কারণ যা-ই হোক সংখ্যাটি রীতিমতো আঁতকে উঠার মতো। কেন এই আত্মহত্যা? এক কথায় এর কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব নেই। কারণ পরিবার, ব্যক্তি ও পরিবেশভেদে আত্মহত্যার নানা কারণ কাজ করে। প্রতিবেদনটিতে আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে ৩ জন বিশিষ্টজনের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রতিবেদক। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের মতে,’ কম বয়সীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খুব তুচ্ছ ঘটনার জেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নয়। হতাশা সহ্য করতে না পারার জন্যই কম বয়সী মেয়েরা এমনটি করে।… এছাড়াও মডেলিং এবং দেখে দেখে শিখে এবং গণমাধ্যমে খবর দেখেও অনেক মেয়ে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হচ্ছে।’ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা বোর্ডের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন এবং ন্যাশনাল ফাউন্ডেশন অব মেন্টাল হেলথের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মো. গোলাম রব্বানী এই প্রসঙ্গে বলেছেন, মহামারিতে যে মেয়ে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করেছে তারা এক ধরনের আবেগীয় তাড়নার বর্শবর্তী হয়েই এ আত্মহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে।… আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সবই প্রচার হয়। আর ঘটনাগুলো নিয়ে একজন আরেকজনের সঙ্গে আলোচনাও করে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে এ কারণগুলো দায়ি। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন আত্মহত্যার পেছনে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা বহুলাংশে দায়ি। তিনি বলেছেন, ‘করোনাকালে অনেক পরিবার অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়েছে। কারও কারও আয় উপার্জন কমে গেছে। অনেকের আবার চাকরি চলে গেছে। এই যে চাপ তৈরি হয়েছে তা একটু একটু করে একসঙ্গে মানুষের ওপর অনেক বড় চাপ ফেলেছে। এর ফলে মানুষের মধ্যে মানসিক চাপের পরিমাণও বেশি হয়ে গেছে। আর এই চাপ সব মানুষ সমানভাবে সহ্য করতে পারে না। যার ফলে তারা আত্মহত্যায় প্ররোচিত হয়।’ তবে যে বিষয়টি বড় উদ্বেগের তাহলো স্নেহ, মায়া-মমতার তথা নিবিড় পারিবারিক বন্ধন ক্রমশ শিথিল হয়ে যাচ্ছে। মায়ের আঁচল তাঁর স্কুল-কলেজ পড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটিকে আর আটকে রাখতে পারছে না। রবীন্দ্রনাথের সেই কালজয়ী পঙক্তিটি ‘ মরিতে চাহি না আমি এই সুন্দর ভুবনে’ তাও খুব একটা আর মানুষকে স্পর্শ করছে না। কেন জীবনের প্রতি এত বিরাগ?
আত্মহত্যার বহুবিধ কারণের মধ্যে বৈশ্বিক মহামারিতে নতুনভাবে যুক্ত হয়েছে কর্মহীনতা। লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনার আগে যা করত তা হয়তো হারিয়েছে নতুবা পরিস্থিতির কারণে বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। এসব কর্মহীন, বেকার, অর্ধবেকারের পরিবারে আর্থিক টানাপোড়েনের প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। দীর্ঘদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার প্রেক্ষিতে ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিরাজ করছে হতাশা। প্রাণ খুলে কথাবার্তা বলার বন্ধুদের তারা দারুণভাবে মিস করছে। এখন স্কুল-কলেজ খুললেও যে কোনো মুহূর্তে তা আবার বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ফলে দুবেলা আহার জুটলেও তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। মেজাজ হয়ে উঠছে খিটখিটে। বলতে গেলে গত ২১ মাস ধরে মানুষ আত্মীয়স্বজনের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত। কোনো পার্কে বা কোনো জায়গায় গিয়ে বেড়িয়ে আসবে সে সুযোগও ছিল না। সমাজবিজ্ঞানী ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণ আর্থিক সংকট, নিঃসঙ্গতা, আত্মমর্যাদার আঘাত, পরকীয়া এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা থেকে সৃষ্ট মানসিক হতাশাকে বৈশ্বিক মহামারিতে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির কারণ বলে ধারণা করছেন।
আত্মহত্যা মহাপাপ। এই আপ্ত বাক্যটি সবার, সব ধর্মের মানুষের জানা থাকার পরও অনেক মানুষ আত্মহত্যা করছেন । যাঁরা আত্মহত্যা করছেন তাঁদের পক্ষে যে কোনো যুক্তি নেই তা কিন্তু নয়। তাঁদের অনেকে জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এই চরম পন্থা বেছে নিচ্ছেন। তাঁরা মনে করছেন তাঁদের আর বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই। কিন্তু এই পথ মোটের ওপর সমর্থন যোগ্য নয়। তাঁদের জানা থাকার কথা সংসার পুষ্প শয্যা নয়। এটি একটি সমরাঙ্গন। এই সমরাঙ্গনে টিকে থাকতে হলে লড়াই করতে হবে সব প্রতিকূলতার সঙ্গে। সমুদ্রে ঝড় উঠলে কোনো মাঝি-মাল্লা কী হাল ছেড়ে দেন? নিশ্চিয় দেন না। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজের প্রাণ ও যাত্রীদের বাঁচাবার প্রাণপণ লড়াই করে যান বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে। ঠিক তেমনি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে আমরা কোনো কোনো লড়াইয়ে যুক্ত আছি। এই লড়াইয়ে হারজিত থাকবে। হারলে সর্বোচ্চ ধৈর্য্যধারণের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার রহমতের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু কোনোমতেই নিজেকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। নেপোলিয়ন বেনাপোর্ট বলেছেন, ‘আত্মহত্যা সবচেয়ে বড় কাপুরুষতার পরিচয়।’ কারণ নিজেকে নিজে হত্যা করার জন্য সৃষ্টিকর্তা কোনো মানুষকে দুনিয়ায় পাঠাননি। যদি তাই পাঠাতেন তিনি মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত (সৃষ্টির সেরা জীব) বলে আখ্যায়িত করতেন না। এমন সৃষ্টির সেরা জীব নিজের অমূল্য প্রাণকে নিজেই বধ করবে এমনটা হতে পারে না। তাই নিখিল পৃথিবীর সকল ধর্মে আত্মহত্যাকে নিন্দা করা হয়েছে। পবিত্র ইসলাম ধর্মে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে আত্মহত্যাকারীর স্থান জাহান্নামে। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের সুরা নিসার ২৯ ও ৩০ সংখ্যাক আয়াতে আত্মহত্যাকারীর জন্য কঠোর আজাবের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের জন্য পরম দয়ালু। আর যে ব্যক্তি সীমা লংঘন করে আত্মহত্যা করবে তাকে অগ্নিদগ্ধ করব।’ একইভাবে পবিত্র হাদিস শরীফে আত্মহত্যার অপরাধে জান্নাত হারাম হওয়ায় পাশাপাশি কঠোর শাস্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জুন্দুব বিন আবদুল্লাহ (রা) রাসুলুল্লাহ (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, ‘এক ব্যক্তি জখম হয়ে (অধৈর্য্য হয়ে) আত্মহত্যা করে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা আমার নির্ধারিত সময়ের আগেই নিজের জীবনের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমি তার ওপর জান্নাত হারাম করে দিলাম ( বুখারি,১২৭৫)।
আত্মহত্যার মতো জঘন্য প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি? কোনো পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্র এককভাবে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। কারণ সমস্যগুলো বহুমুখি। এই বিষয়ে সবচে জরুরি হলো পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করা। পরিবারে পরস্পরের মধ্যে ভালো বোঝাবুঝি থাকলে আধপেটা খেয়েও খুশি থাকা যায়। আপনার কিশোর ছেলেটি বা মেয়েটি পরীক্ষায় ফেল, কাক্সিক্ষত ফলাফল না করা কিংবা কারও সঙ্গে সম্পর্ক পাতলে তাতে বকাবকি না করে দরদ দিয়ে বুঝাবার চেষ্টা করতে হবে। এতে বরাবরই ভালো ফল প্রত্যাশা করা যায়। কখনো রাগের বশে ছেলেমেয়েদের গায়ে হাত তুলবেন না। এতে হিতে বিপরীত হয়। অভাবী পরিবারে ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকে। এক্ষেত্রে প্রতিবেশিদের উচিত তাঁদের সাধ্যমত সহযোগিতা করা। বেকারত্ব নিরসনে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে হবে। করোনাকালীন কর্মহীন লোকদের তাঁদের দক্ষতা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। ক্ষুদ্র ঋণপ্রদানকারী সংস্থাগুলোকে মানবিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। পারিবারিক ও সামাজিক সম্প্রীতির সঙ্গে নৈতিক শিক্ষার আলো মানুষের অন্তরে বিকশিত করতে পারলেই আত্মহত্যার মতো মানববিধ্বংসী প্রবণতা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক