‘আত্মবিশ্বাসের’ জায়গায় কতটা টিকে থাকতে পারবে বিএনপি

12

এম এ হোসাইন

জ্বালানি তেলসহ দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ার প্রতিবাদে সভা-সমাবেশ করছে বিএনপি। দলটির সমাবেশে মানুষের ব্যাপক সমাগমও হচ্ছে। নেই আগের মতো প্রশাসনের নানা ঝামেলাও। এসব দেখে আত্মবিশ্বাস বাড়ছে দলটির নেতাদের মধ্যে। বড় পরিসরে জনসভা করে উজ্জীবিত হয়ে স্বপ্ন দেখছেন সরকার পতনের।
তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এসব বিষয়কে ‘কর্পূরের’ মতোই দেখছেন। মাঠে নামলে বিএনপি অলিগলিতেও খুঁজে পাওয়া যাবে না মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। এ অবস্থায় আন্দোলনের মাঠে বিএনপি টিকে থাকতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন আবার নতুন করে দেখা দিয়েছে।
দলের কর্মসূচিতে ‘জনতার সুনামি’ দেখতে পাচ্ছেন মন্তব্য করে গত বৃহস্পতিবার নয়া পল্টনে জনসভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বক্তব্য রাখেন। ওই জনসভার পরদিন গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আরেক কর্মসূচিতে তিনি বলেন, আজকে জনগণ জেগে উঠেছে, পতন তাদের অনিবার্য। মানুষ এই রাজপথ দখল করলে জনতার যে ঢল নামবে, সমুদ্রের যে ঢেউ উঠবে; সেই ঢেউয়ে যে সুনামি সৃষ্টি হবে, সেই সুনামিতে এই ভয়াবহ দানবীয় ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার ভেসে চলে যাবে।দেশে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে সমাবেশ থেকে বিএনপি নেতারা সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবী জানিয়েছেন।
ঢাকার সমাবেশগুলোতে ব্যাপক মানুষের সমাগম হয়। জ্বলানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার চট্টগ্রামেও সমাবেশ করে দলটি। চট্টগ্রামের সমাবেশেও বিপুল সংখ্যক সমর্থকের জমায়েত হয়। আগামি ক’দিন একই দাবিতে বিএনপি জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে বিক্ষোভ-সমাবেশ করবে। সমাবেশ থেকে বিএনপি বলছে, সরকার তাদের দাবিতে কান না দিলে বিএনপি রাস্তায় জোরদার আন্দোলন শুরু করবে। মানুষকে সম্পৃক্ত করা যায় এমন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকার পতন করতে চায় দলটি। সমাবেশগুলোতে ব্যাপক জনসমাগমে দলটির মধ্যে আত্ম বিশ্বাস বেড়েছে। সরকার পতনের মতো শক্তি দলটির হাতে আছে এমনটা মনে করছেন দলের নেতারা। সে আত্মবিশ্বাস কতটা কাজে লাগাতে পারবে সেটা আন্দোলনের গতিপথই বলে দিবে।
আত্মবিশ্বাস নিয়ে যখন বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতনের স্বপ্ন দেখছে; তখন মাঠে নামার প্রস্তুতির কথা জানান দেয়া হয় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকেও। বিএনপি মহাসচিব যখন রাজপথ দখলের কথা বলছেন, তখন রাজপথ ছাড়েনি জানিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলছেন, ‘মাঠে নামলে বিএনপি কর্পূরের মতো উড়ে যাবে’।
অন্যদিকে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী বলেছেন, ‘হারিকেন ধরা বিএনপিকে হয়তো হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না’।
গতকাল শুক্রবার একটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও স¤প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, মুসলিম লীগের প্রতীক প্রথমে ছিল সাইকেল। পরে প্রতীক করে হারিকেন। কিন্তু হারিকেন দিয়েও বর্তমানে মুসলিম লীগকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তেমনি বিএনপি তাদের ধানের শীষ মার্কা বাদ দিয়ে হারিকেন ধরেছে। তাই আমার মনে হয় হারিকেন দিয়ে খুঁজেও বিএনপিকে পাওয়া যাবে না।
এর আগে বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেন, ফখরুল সাহেব বারবার শুধু এই কথা বলছেন, পালানোর কথা! স্বপ্ন দেখছেন ময়ূর সিংহাসন? ময়ূর সিংহাসন, সোনার হরিণ; দিন যায় রাত যায় সপ্তাহ যায় মাস যায় বছর যায়, সোনার হরিণ; ময়ূর সিংহাসনের দেখা আজও পেলাম না। কোথায়, কবে আসবে কেউ জানে না। কোথা থেকে আসবে ময়ূর সিংহাসন? স্বপ্ন আবারও রঙিন খোয়াবের মতো, স্বপ্ন কর্পূরের মতো উড়ে যাবে, আওয়ামী লীগ যখন মাঠে নামবে।
তিনি বলেছেন, বিএনপি প্রতিদিনই বলে সরকার পালিয়ে যাবে। কোথায় পালাবে? আমাদের দেশ এই বাংলাদেশ, পালানোর ইতিহাস আমাদের নেই। প্রয়োজনে দেশের মাটিতে জেলে যাব, পালাব না। আওয়ামী লীগ পালানোর দল নয়, পালানোর দল তো আপনারা। আপনাদের দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তিনি কোথায়? টেমস নদীর তীরে কিভাবে গেছেন? জরুরি সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে এখান থেকে চলে গেছেন।
অনুমতি, রাস্তায় নামতে না দেয়াসহ পুলিশের সাথে সমাবেশ নিয়ে প্রায় নানা ঝামেলা হলেও সাম্প্রতিক কর্মসূচিতে বিএনপিকে এসব ঝামেলায় পড়তে হয়নি। ঘরোয়া সমাবেশের অনুমতি নিয়ে রাস্তায় অবস্থানও করেছে বিএনপি। গতকাল চট্টগ্রামের সমাবেশেও নূর আহমদ সড়ক দখলে নিয়েছিল দলটি। তবে পুলিশের ভূমিকা মারমুখী ছিল না।
অবশ্য বিএনপি মহাসচিব এক বক্তব্যে ‘বিদেশি চাপ থাকায় সরকার সভা-সমাবেশে ঝামেলা করছে না’ বলে মন্তব্য করেছেন’।
চট্টগ্রামের সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির ভাইস চেয়াম্যান ও সাবেক মন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন বলেছেন, গতকাল ঢাকায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির সমাবেশ ছিল ৭ নম্বর বিপদ সংকেত। আর চট্টগ্রামের সমাবেশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ১০ নম্বর বিপদ সংকেত। আওয়ামী লীগের হাতে দেশ নিরাপদ নয়। তারা ১৯৭৫ সালেও গণতন্ত্র হত্যা করে মনে করেছিল সারাজীবন ক্ষমতায় টিকে থাকবে। কিন্তু পারেনি। জনরোষের মুখে সরকারের পতন হয়েছে।
একই সামবেশে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহব্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, আজকের জ্বালানি সংকট, অর্থনৈতিক সংকট, বিদ্যুতের লোডশেডিং, বিদ্যুতের সংকট সবকিছুর মূলে এই সরকারের দুর্নীতি। লুটপাট ও চুরি করে সরকার দেশকে ফোকলা করে দিয়েছে। বর্তমান সরকার টিকেই আছে মানুষকে প্রতারণা করে। কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টের নামে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। তাদের নিজস্ব লোকজনকে মুনাফা পাইয়ে দিয়েছে। আজকে বাংলাদেশে যে অর্থনৈতিক সংকট, বাংলাদেশ যে দেউলিয়াত্বের দিকে যাচ্ছে, তার জন্য সম্পূর্ণ দায়ী এই আওয়ামী লীগ সরকার। এর জবাব তাদের দিতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সভা-সমাবেশের ব্যাপক উপস্থিতির মাধ্যমে বিএনপির মধ্যে আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। এই আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে মাঠে অবস্থান তৈরি করতে হবে। অতীতেও বিএনপি বিভিন্ন সময়ে মাঠে অবস্থান নিতে গিয়ে আবার পিছনে ফিরেছিল। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যে সৃষ্ট ঝামলাকেও বিএনপি নিজেদের অবস্থান জানান দেয়ার চেষ্টা করেছিল। এখন সাধারণ মানুষের পক্ষে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মাঠে নামতে চায় তারা। বিএনপি মাঠে অবস্থান নিলে বাধা দিবে ক্ষমতাসীন দল। পুলিশ প্রশাসন এখন নিরব ভূমিকায় থাকলেও সরকারের পক্ষে অবস্থান থাকবে তাদের।
সব মিলিয়ে বিএনপি আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাঠে নামলেও কতটুকু সফল হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে তাদের পদক্ষেপের উপর নির্ভর করবে টিকে থাকার শক্তি।