আত্মদর্শনের কথা

271

বহু কালের পুরনো একটি প্রশ্ন আমি কে? সর্বকারের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, তুমি নিজেকে জান! উপনিষদে আছে আত্মানংবৃদ্ধি নিজকে জান। গৌতম বৌদ্ধ বলেছেন, ‘আত্মদীপ ভবঃ’ নিজকে প্রদীপ করে তোল এবং সে আলোয় পথ চিনে নও। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন। মাল আরাফা নাফসাহু ফাকাদ্ আরাফা রাব্বাহু যিনি নিজের নাফকে চিনতে পেরেছেন তিনি যেন আল্লাহকে চিনতে পারলেন। রবীন্দ্র নাথ তাঁর নোবেল বিজয়ী গ্রন্থ গীতাঞ্জলিতে উচ্চারণ করেছেন, ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তর তর হে, / নির্মল কর উজ্জ্বল কর সুন্দর কর হে!’ উর্দু ভাষার শ্রেষ্ঠ কবি আল্লামা ইকবাল বলেছেন খুদী দর্শনের কথা। এই দর্শনের মূল সুর নিজের অপরিমেয় অভাবনীয় শক্তিকে আবিষ্কার করে প্রবৃত্তি তাড়িত নফসের কারাগার থেকে মুক্ত হও। তখন অপরাজেয় শক্তির বিকশিত হওয়ার কারণে মানুষ পারমাণবিক বোমার চেয়ে বড় শক্তিতে পরিণত হবে। তিনি তাঁর কাব্যে বর্ণনা করেছেন:
‘খুদী কো কর বুলন্দ ইতনাকে হর তকদীর সে পহলে
খোদা বন্দাসে খোদ পুছে বাতা ত্যারী রিয়া কিয়্যা হ্যায়।’
অর্থাৎ নিজকে এমনভাবে বিকশিত কর, যেন ভাগ্য নির্ধারণের পূর্বে স্বয়ং খোদা জানতে চান, বান্দাহ বলো তুমি কি চাও ?
মানুষ এক রহস্যেময় প্রার্থী। যার আছে দু’টি সত্তা। একটি রুহ একটি নফ্স। রুহ মানব শরীরে আছে বলেই মানুষের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু সে রুহটি মানব শরীরের কোন অংশে অবস্থান তা বলা কঠিন। কেউ বলেন, ‘সমগ্র শরীরজুড়ে রুহের অবস্থান’। এমতের বিরোধীরা বলেন, সমগ্র শরীরজুড়ে রুহের অবস্থান হলে, একজন মানুষের হাত, পা কেটে দিলে তাঁর রুহ ছোট হয়ে যেত, কিন্তু তা যে ঘটে না। তাতে প্রমাণিত হয় রুহ সমগ্র শরীরজুড়ে অবস্থান করছে না।
কেউ কেউ বলেন, ‘মানব শরীরের কোন এক অংশে রুহের অবস্থান। এমত মানতে চান না অনেক দার্শনিক। তাঁরা বলেন, বিজ্ঞানের উন্নতির কারণে যে শরীরের অংশে রুহ অবস্থান করছে সেটি পরিবর্তন করলে রুহ তো পরিবর্তন হচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে রুহকে বুর্ঝা কঠিন বিষয়। এ কঠির বিষয়টি জানতে একদিন কাফেররা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, রুহ কি ? তিনি উত্তর দিকে চিন্তা করছিলেন, এমনি সময় আল্লাহর পক্ষ হতে অহি নাজিল হলো, কুলির রুহ মিন আমরি রাব্বি’ বল! রুহ হলো আল্লাহর আদেশ। আল্লাহর আদেশটি তাঁর নিকট প্রত্যাবর্তন করলেই মানুষের মৃত্যু হয়।
মহান আল্লাহ পাক জাল্লে শাহহু পবিত্র কোরআন ইরশাদ করেছেন ‘কুল্লু নাফ্সিন জাইকাতিল মাউত’ নকল নফসের মৃত্যু হবে। বলা হয়নি যে, সকল রুহের মৃত্যু হবে। রুহের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, ‘ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইল্লাইলাইহি রাজেউন’ আল্লাহর কাছ হতে আগমন আল্লাহর কাছে প্রত্যাগমন হবে। নফসের কুপ্রভৃত্তির তাড়নায় রুহের ওপর শাস্তি হয়।
অনেক তাসাউফ পন্থীদের মতে নফস তিনটি। এক. নফসে আম্মারা (জীবজগতের নফস)। দুই. নফসে লাউয়ামা (সাধারণ মানুষের নফস)। তিন. নফসে মুতমায়িল্লাহ (আধ্যাত্মিক পুরুষের নফস)।
সকল মানুষের উপর কোন না কোন নফস বিদ্যমান থাকে। আল্লাহ পাক কোরানে নফস সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন বেশ কটি স্থানে যেমন, ‘হে প্রশান্ত নফস (চিত্ত)’। (সূরা ফাজর ঃ আয়াত-২৭)। ‘আমি নফসে লাউয়ামার শপথ করছি।’ (সূরা কিয়ামাহঃ আয়াত-২) ‘অবশ্য নাফস তো মন্দের দিকে উদ্বুদ্ধ করে’। (সূরা ইউসুফ ঃ আয়াত-৫৩)
অনেক মুজতাহিদগণ বলেছেন, প্রকৃতপক্ষে, নাফস একটি কিন্তু তার গুণবাচক নাম তিনটি।
মানুষের রুহ তিন প্রকার। এক. রুহে মুকিম‘ স্থায়ী রুহ। এটাই প্রধান রুহ। দেহ হতে এই রুহ বের হয়ে গেলে মানুষের মৃত্যু হয়। দুই. ‘রুহে জার’ বা প্রতিবেশীসুলভ রুহ। এটিকে ‘রওয়া’ ও বলে। এই রুহ শরীর হতে চলে গেল মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে এবং ফিরে আসলে জেগে উঠে। এই রুহ মানুষের দু’চোখের মাঝখানে থাকে। তিন. ‘রুহে আমিন’। এটা মানব শরীর ত্যাগ করে না । মৃত্যুর পরও রুহটি দেহে অবস্থান করে। অনেকের মতে কবরে মুনকার ও নাকিরেয় প্রশ্নও এই রুহে মাধ্যমে হয়ে থাকে। (তথ্য সূত্র “ তাহযীবুস সালাত)।
রুহ ও নফস সম্পর্কে হয়রত ইবনে মান্দা (রা.) বর্ণনা করেছেন যে, এদু’টি সত্তা সম্পর্কে বিভিন্ন মতব্যক্ত হয়েছে। কোন কোন মনীষী বলেছেন, নাফস হলো মাটি ও আগুনে মিশ্রিত এবং রুহ নুর ও রুহানিয়াতের সমন্বয়ে গঠিত। রুহ সম্পর্কে আরেকটি মত হলো ‘রুহ হলো ঐশী আর নাফস হলো পার্থিব সত্তা। নাফসের দ্বারা মানুষের ভালো মন্দের পরীক্ষা করা হয়’। হাদিস বিশারদগণ মনে করেন, রুহ ও নাফসের বড় পার্থক্য আছে। নাফসের জীবন রুহের উপর নির্ভরশীল। আর নাফস হলো মানুষের আকৃতি। এটা লোভ-লালসার আশা-আকাক্সক্ষা, দুঃখ-বেদনার সাথে যুক্ত। মানুষের নাফসই বড় শত্রু। নাফস শুধু ভোগবাদী। রুহ মানুষকে পরকালের মুক্তির অগ্রাধিকার দেয়। আল্লাহ পাক শয়তানকে নাফস ও লোভের অধীন করে দিয়েছেন। ফেরেশতাদের রুহ ও জ্ঞানের সাথে মানুষের রুহের সম্পর্কে আছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর কালিম বান্দাদের ইলহামের মাধ্যমে কোন কোন সময় অদৃশ্য সংবাদ প্রদান করে থাকেন।
মহানবী হয়রত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘শহীদগণের রুহ সবুজ রংয়ের পাখির মাঝে অবস্থান করে। জান্নাতের মাঝে যেখানে ইচ্ছা উড়ে বেড়াতে পারে। আর আরশের মাঝে ফানুসের মদ্যে অবস্থান করে। অতপর আল্লাহ পাক তাদের জিজ্ঞেস করে, ‘তোমাদের ইচ্ছা কি’?
হযরত তালহা (রা.) বর্ণনা করেন, একদা তিনি এক জঙ্গলে কৃষি খামার দেখছিলেন। রাত হয়ে গেলে তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.)’র কবরের নিকট অবস্থান করেছিলেন। তিনি তাঁর কবর হতে কোরানের সুমিষ্ট তেলাওয়াত শুনতে পেলেন। একথা প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট বর্ণনা করলে তিনি ইরশাদ করলেন, তোমরা কি জান না, যাঁর রুহকে কবয করার পর আল্লাহ পাক যমরুদ ও ইয়াকুতের ফানুসে রেখে দিয়েছেন। তারপর ফানুসটিকে জান্নাতের মাঝখানে ঝুলিয়ে রেখে দিয়েছে। রাতে রুহকে কবরে ফিরিয়ে দেন এবং সকালে আবার ঐখানে ফিরে আসে।
লেখক : কলাম লেখক ও রাজনীতিক