আত্মদর্শনই দেবীপূজা

51

পদ্ম-শিউলীর সুবাস ছড়িয়ে শরৎ সবার কাছেই শ্রীশ্রী মা দুর্গার আগমনী বার্তায় উদ্বেলিত করলেও প্রাসঙ্গিকভাবে চেতনায় আসে, কেন সর্বশক্তিস্বরূপিনী মায়ের পূজা করেও দিন থেকে দিন এত শক্তিহীন হচ্ছি? কেন আমরা মাকে জাগাতে পারছি না ? আমরা কি কুহেলিকার পিছনে ছুটে শুধু শক্তিমান হওয়ার পরিবর্তে শক্তিহীন হচ্ছি?
আমরা পূজায় যে কাজটুকু সম্পাদন করি, মন্ত্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক হয় না। আলোকসজ্জা বা জাঁকজমকের অভাব না থাকলেও থাকে উপাচারের অভাব। যাঁর পূজা করছি তার তত্ত¡ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞান। ফলে ব্যাপকভাবেই ভক্তির অভাব, মন্দিরের পুরোহিতদের প্রতি শ্রদ্ধার অভাব। ফলে সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ ছাড়া এসব মন্ত্রে প্রাণ সঞ্চার অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। বিগ্রহের তাত্তি¡ক রহস্য বুঝতে না পারায় আনন্দের কমতি না থাকলেও ভক্তির লেশমাত্র থাকে না। তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন বিগ্রহ, মন্ত্র, উপাচার ইত্যাদি সম্পর্কে ভক্ত ও পুরোহিত উভয়েরই সঠিক জ্ঞান লাভ করা।
এ প্রসঙ্গে দেখতে হবে পূজক যে মুহ‚র্তে পূজার আসনে বসবেন সেই মুহ‚র্তেই চারপাশের ভ‚মি, জল, অগ্নি, বায়ু, আকাশ এক কথায় বলতে গেলে পঞ্চভৌতিক জগৎ, নিজের পঞ্চভৌতিক দেহ এবং মন প্রাণ প্রভৃতিকেই দেখা যাবে। দৃষ্টি ও চিত্ত যদি এই ভ‚তে বা ভৌতিক জগতেই সীমাবদ্ধ থাকে তবে ঐ জড় মন নিয়ে পূজার অধিকারী হওয়া যাবে না। তাই প্রথমে এই ভৌতিক জগতেই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থাৎ পঞ্চভ‚তে এই সত্যই, শক্তিই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এটা অনুভব করতে হবে। সত্য প্রতিষ্ঠা হলেই অনুভব হবে পঞ্চভ‚তে বিভিন্ন নাম রূপ হলেও সচ্চিদানন্দময় আত্মা ব্রহ্মেরই অভিব্যক্তি মাত্র। আর এই অনুভ‚তি লাভ হলেই পূজার অধিকার জন্মাবে। পূজার অধিকার জন্মালেই ঠিক ঠিক সত্য প্রতিষ্ঠায় অভ্যস্ত হলে পরিদৃশ্যমান সকল বস্তুর উপাদানরূপে মন প্রাণকে দেখা যাবে। দেখা যাবে-মন প্রাণই পূজক, পূজা ও পূজ্যরূপে বিদ্যমান।
গীতার সারথী শ্রীকৃষ্ণ সখা অর্জুনকে বলেন-যিনি আমাকে সর্বত্র এবং আমাতে সব দেখতে পান তাঁর কাছে আমি অদৃষ্ট থাকি না, তিনিও আমার অদৃষ্ট হন না। এই বিষ্ণুকেই জগৎ পরিব্যাপ্ত দেখে সাধকের অন্তকরণ পরিশুদ্ধ হয়, পরিশুদ্ধ দেহেই আসন শুদ্ধি হয়।
পূজার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, ‘সংকল্প : কর্মমানসম্্’। মানসিক কর্মের নাম সংকল্প। শাস্ত্র বলেন, মনে মনে সংকল্প করবে, সংকল্পিত বিষয়টি বাক্যের দ্বারা উচ্চারণ করবে এবং কর্মানুষ্ঠানের দ্বারা তা সুসিদ্ধ করবে। এটুকু জানতে হবে, সংকল্প বাক্যে মাস পক্ষ এবং নিয়ম নিমিত্তসমূহের উল্লেখ করতে হবে। পূজক সেই মুহ‚র্তে পূজায় বসেন, তখনই তাকে দেখতে হয় বিশ্বপ্রকৃতির অবস্থা কিরূপ, সূর্য-চন্দ্রাদি কোথায় এবং কিভাবে অবস্থা করছে। এসবের মাধ্যমে পূজক নিজেকে দেবত্বে উন্নীত করেন। পূজক সাড়ে তিন হাত পরিমিত মাংসপিÐময় একটি দেহমাত্র নন, তিনি বিরাট মহান ব্যাপক বিজ্ঞানময় পুরুষ। এই আশ্বিন মাসরূপ কল্পিত কালপ্রবাহ তাঁরই অঙ্গে অবস্থিত, বিরাট রাশিচক্র রূপ অঙ্গভ‚ষণ, ঐ কন্যা রাশিগত সূর্যদেব এই অঙ্গে অবস্থিত, পূজকের অঙ্কস্থিত চন্দ্রের সপ্তম কাল অতীত হয়ে অষ্টম কলায় পূরণ হয়েছে। আর তখনই আশ্বিন মাস সময় শুক্লপক্ষময় অষ্টমী তিথিময় হয়ে জগৎ মাতা জগদ্বীশ্বরী দুর্গতিহারিনী শ্রীশ্রী দুর্গাদেবীর পূজায় ব্রতী হয়েছেন-আর এ সত্য ভাবনায় সংকল্প বাক্যের যথার্থ উদ্দেশ্য। যার সংকল্প যত দেবী সত্যে প্রতিষ্ঠিত তার সংকল্প তত তাড়াতাড়ি ফলদায়ক হয়।
আমরা বিভিন্ন মন্দিরে যে দেবী বিগ্রহের পূজা দেখতে পাই তা বৃহৎ নন্দিকেশ্বরপুরান, কালিকাপুরান, মৎস্যপুরান অথবা দেবী পুরাণোক্ত বিধিতেই হয়ে থাকে। মন্দিরের পূজা যে বিধিতেই হোক না কেন দেবী ধ্যান সর্বত্রই এক ও অনন্য। কিন্তু এক এক মন্দিরের বিগ্রহ এক এক রকম, কোথাও ধ্যান সম্পন্ন মূর্তি, কোথাও দেবী অসুর সিংহের সংযোগ নাই, কোথাও দেবী অলৌকিক মহিষবাহনা, কোথাও বা ভূমÐলের উপর দেবী ছাড়ানো আর কোথাও অসুরের ছড়াছড়ি। এই সব বিগ্রহে পূজা সম্পন্ন করার পূর্বে ধ্যান নির্দিষ্ট মূর্তি না হওয়ার কারণে পুরোহিতমÐলীকে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার প্রয়োজন। কেননা মুখ, অন্তর, দৃষ্টি এক না হলে সত্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না, সত্য প্রতিষ্ঠা না হলে পূজা করে তার ফল কুফল ছাড়া আর কিছুতেই হতে পারে না। বিগ্রহ সম্পূর্ণ একটি দর্শন আর জোর করে বা চাপিয়ে দিয়ে আদর্শ প্রতিষ্ঠা বা দর্শন সৃষ্টি করা যায় না। তাই অনেকের ক্ষেত্রেই এসব বিগ্রহে প্রাণ প্রতিষ্ঠা কতটুকু হয় বা আদৌ হয় কিনা তা ঈশ্বরই জানেন। প্রাণ প্রতিষ্ঠাকারীকে নরকের তিনটি দ্বার বন্ধ করতে হবে। নয়তো প্রাণ প্রতিষ্ঠা হবে বলে মনীষীগণ সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। পূজায় আত্মদর্শন না হলে পূজার সার্থক রূপ লাভ হয় না। দেবতার আশীর্বাদ থেকে ভক্তরা সর্বোতভাবে বঞ্চিত হন। এখানে বেদের ভাষায় বলা যায়-আত্মাকে জানো। নিজেকে জানা আত্মাকে জানার মধ্যদিয়েই জগজ্জননী ব্রহ্মময়ী স্বরূপীনিকে জানান। তাঁর আশীর্বাদ সিক্ত হওয়া ধন্য হওয়া, একের মাঝে বহুকে দেখা এবং বহুর মাঝে এককে দেখা হোক উদ্দেশ্য। আর এসব কিছু পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় আত্মদর্শনে। আমি ভক্তদের কাছে অনুরোধ জানাই, শাস্ত্র নির্দিষ্ট পথে এগিয়ে আসুন, প্রতিমা তৈরি করুন, পূজা করুন।
তবেই মন্দিরে মন্দিরে দেবতা জেগে উঠবেন, অসুরদলনী মা অসুর বিনাশে তৎপর হবেন। অন্নহীন, বস্ত্রহীন, রোগাক্রান্ত, আশ্রয়হীন, নিরাপত্তাহীন সকল সন্তানকে স্নেহ ভরে কোলে টেনে নিবেন, আবার হাসবেন। আনন্দে ভরে উঠবে জগৎ, পূজা হবে সার্থক।